শেখ মুজিবুর রহমান: একটি ঝড় ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়

সারসংক্ষেপ

যে যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি, সেই যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে একটি দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হলেও, শুরু থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বিদ্যমান ভিন্নতাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি, যা বর্তমানে বাংলাদেশ, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণের ফলে সাংস্কৃতিক ভিন্নতাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন প্রকট রূপ ধারণ করে। এসব কারণে মানুষ বরাবরই নিজেদের মুক্ত দেশের, মুক্ত নাগরিক হিসেবে দেখার প্রয়োজন অনুভব করতে থাকে। এই আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের সৃষ্ট বিশেষ বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ কীভাবে ধীরে ধীরে জন-আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়, তা এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়। মুজিব তাঁর বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের যে নিজস্ব স্বাধীন সত্তা রয়েছে, সে বোধ সাধারণ জনগণের মধ্যে জাগ্রত করেন। মুজিব নিজে যেমন এই পরিস্থিতি-জাত একজন নেতা ছিলেন, তেমনি তিনি নিজেও এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭১ সালের মার্চের মধ্যে মুজিব এক আদর্শ সৃষ্টি করেছিলেন, যেটা বাঙালি বিবেককে একটা সামষ্টিক রূপ দিতে সক্ষম হয়। মুজিব কিছু প্রতীক নির্মাণ করেছিলেন, যেটা মানুষের আবেগকে রাজনৈতিক লক্ষ্যে মাঠে নামার জন্য পরিচালিত করে—শেষমেশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের দিকে ধাবিত করে। এই প্রতীকগুলো নির্মাণে তত্কালীন বাস্তবতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস ইত্যাদি বিষয় কী ধরনের ভূমিকা পালন করেছিল, তা এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ

শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ, ছয় দফা, নির্বাচন, স্বায়ত্তশাসন, মুক্তি, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, প্রতীক ধর্ম।

ভূমিকা

না, স্রেফ ‘ঔপনিবেশিক শোষণ’, ‘নৃতাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা’ বা ‘শ্রেণিস্বার্থ’ দিয়ে মানুষকে রাস্তায় বন্দুকের ধোঁয়া ওঠা নলের সামনে পাঠানো যায় না। যদিও এসব বর্গ ব্যবহার করে অনেক লেখক (জাহান ১৯৭২ এ ও ১৯৭২ বি; মদন ১৯৭৪ ও মনিরুজ্জামান ১৯৮০ ও ১৯৮২) বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সুচিন্তিত সামাজিক কাঠামোগত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আবার শুধু আর্থসামাজিক বৈষম্যের কারণেও মানুষ গণহারে এভাবে আন্দোলন করেনি, এমনকি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ব্যাপক বলপ্রয়োগ সত্ত্বেও। এটা বোঝার জন্য বিশ্ববীক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি যে মানুষের মধ্যে অভিন্ন প্রতীকী মূল্যবোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে তাকে অনুপ্রাণিত করে, তা বোঝা দরকার। এই প্রবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের সৃষ্ট বিশেষ বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধে আলো ফেলা হয়েছে।

এই প্রতীকী আচরণ মানুষের এক অপরিহরণীয় সামাজিক সত্য, মানুষ হওয়ার এক মৌলিক উপাদান। মানুষ যখন একে অপরের সঙ্গে কথা বলে, বস্তুর নামকরণ করে, কোনো কিছুর দাবি করে ও কিছু মাত্রায় পরস্পরকে বুঝতে পারে, তখন তারা একরকম প্রতীকী ব্যবহারের মধ্যে প্রবেশ করে। মানবীয় এই প্রতীকী ব্যবস্থাই আসলে মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিক মনস্তত্ত্বের ছাঁচ গড়ে দেয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতীকী মডেল ও বৃহত্তর বিশ্বের প্রক্রিয়াকে মেলানোর মাধ্যমে মানুষ আসলে বুঝতে পারে, সে কে। ব্যক্তি হিসেবে সমাজের মধ্যে তার স্থান কোথায়।

কথা হচ্ছে, শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মুখপাত্র হিসেবে বক্তৃতার মাধ্যমে শ্রোতাদের মধ্যে আত্মসত্তার বোধ এবং সামাজিক শ্রেণির অন্তর্গত মানুষ হিসেবে তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন, সেই বোধ সৃষ্টি করেছেন। গার্টজের ভাষায় (১৭৩: ২১৮-২০), মুজিব মানুষকে আদর্শের সন্ধান দিয়েছেন। পাকিস্তানের সামাজিক ব্যবস্থায় এসব ঐতিহাসিক উপাদান না থাকলে মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের মুখপাত্র হওয়া সম্ভব ছিল না। মুজিব বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক প্রতীকের সাপেক্ষে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণ করেছেন। এই প্রতীক ছাড়া মুখপাত্র মুজিবের বলার কিছু ছিল না। নিচের সারণি ১-এ দেখানো হয়েছে মুজিব কীভাবে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রতীকী মডেলকে আরও দানা বেঁধে উঠতে সহায়তা করেন।১

আসলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে ঘিরে জনপরিসরে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা গড়ে উঠতে শুরু করে, সাইক্লোন-পরবর্তী সরকারের পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে যেটা জনরোষে পরিণত হয়, নির্বাচনের পর যা আবার আনন্দময় আর মার্চের শেষের দিকে রমরমা হয়ে ওঠে। এর প্রতিটি স্তরেই এমন সম্ভাবনা ছিল যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে পেছন থেকে ছুরি মারা হতে পারে। মুজিব যেমন এই পরিস্থিতি-জাত একজন নেতা ছিলেন, তেমনি তিনি নিজেও এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে ভূমিকা পালন করেছেন।

সারণি-১: ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও তার পরিণাম

বিশেষ করে সাইক্লোন-পরবর্তী পরিস্থিতিকে মুজিব খুব ভালোভাবে ব্যবহার করতে পেরেছেন। এই দুর্যোগের পর তিনি প্রচারণার মাধ্যমে বাঙালিদের কেন্দ্রীয় সরকারের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিলেন। বিশেষ করে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে তিনি এই প্রচারণাকে এক অনন্য জায়গায় নিয়ে গেলেন। সাইক্লোন কোনো সংকট নয়। এটা পূর্ব পাকিস্তানের জীবনের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। কিন্তু এই সাইক্লোনের পর মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের জনমনে এ ধারণা সৃষ্টি করতে পারলেন, তাঁদের জীবনের ওপর এক হুমকি রয়েছে। আর যতক্ষণ তাঁরা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটাতে না পারছেন, ততক্ষণ এই হুমকি থেকেই যাবে।

১৯৭১ সালের মার্চের মধ্যে মুজিব এক আদর্শ সৃষ্টি করলেন, যেটা বাঙালি বিবেককে একটা সামষ্টিক রূপ দিতে সক্ষম হয়। ব্যাপারটা এমন জায়গায় চলে গেল যে মানুষ তখন শুধু প্রতিবাদ করতে নয়, দীর্ঘদিনের অধীনতাকে সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ করার জায়গায় নিয়ে যায়। মুজিব কিছু প্রতীক নির্মাণ করলেন, যেটা মানুষের আবেগকে রাজনৈতিক লক্ষ্যে মাঠে নামার জন্য পরিচালিত করে শেষমেশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের দিকে ধাবিত করে। অনেকেই মনে করতেন, মুজিব বাংলাদেশকে যে প্রতীকী রূপ দিয়েছিলেন তার জন্য লড়াইও যেমন করা যায়, তেমনি প্রাণও দেওয়া যায়।

এক. নির্বাচনী প্রচারণা

১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সভা গঠন করার কথা ছিল, যার মাধ্যমে পাকিস্তানে বেসামরিক শাসন ফিরে আসবে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিটি প্রদেশের জন্য জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত হওয়ার কথা ছিল, যেটা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা। আগের নির্বাচনে পাকিস্তানের দুটি অংশের সমান প্রতিনিধিত্ব ছিল। ফলে যে অংশের জনসংখ্যা বেশি ছিল, তারা বঞ্চিত হতো। এই প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের সামনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা লাভ করার সুযোগ এল। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ভাবলেন, পশ্চিম পাকিস্তান এত দিন তাঁদের সঙ্গে যে অন্যায় করে আসছিল, সেগুলো নিরসন করার সুযোগ এসেছে। ফলে নির্বাচনের প্রচারণা ছিল ব্যাপক আর মানুষের আগ্রহও ছিল তুঙ্গে।

যদিও প্রচারণার সময় মুজিবের কথামালায় এসব প্রতীকী উপাদান ছিল, যেগুলো পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রতীকে রূপান্তরিত হয়, সেগুলো তখনো ক্যারিশম্যাটিক রূপ লাভ করেনি। নভেম্বরের সাইক্লোনের পর সেটা এই রূপ লাভ করে। তাঁর প্রচারণার আবেদনের সারমর্ম দাঁড়ায় এ রকম: ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন জরুরি, শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন যৌক্তিক ও আইনানুগ।

নির্বাচনের প্রচারণার সময় শেখ মুজিব এ বিষয়ে জোর দেন যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে কোনো আপস করা হবে না। তিনি এই নির্বাচনকে আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবির ন্যায্যতার প্রশ্নে গণভোট মনে করতেন। বাংলাদেশের জন্য যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন শেখ মুজিব, যদি তিনি জনগণের রায় পান। তাঁর ব্যবহূত প্রতিটি শব্দের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন।

স্বায়ত্তশাসন

১৯৭০ সালের মধ্যে ‘স্বায়ত্তশাসন’ পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরোধীদের পবিত্র দাবিতে পরিণত হয়। আসলে এই শব্দটি দিয়ে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা কর্মসূচিতে যে আলগা ফেডারেশনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সেটাই বোঝানো হয়েছে, যেখানে স্বাধীন পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মুক্ত নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। মুজিব সব সময়ই স্বাধীনতা ও মুক্তির সঙ্গে স্বায়ত্তশাসনকে মেলাতেন। ইংরেজিতে মুজিব এই তিনটি শব্দের পার্থক্য করতে পারতেন। ‘স্বাধীনতা’ বলতে তিনি আসলে ১৯৪৭ সালের ব্রিটেন থেকে পাওয়া স্বাধীনতাকে বোঝাতেন। ‘মুক্তি’ বলতে স্বাধীন দেশে ‘মুক্ত নাগরিকদের’ অধিকার বোঝাতেন। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তান স্বাধীন। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, শেখ মুজিব বাংলা ভাষায় এই তিনটি শব্দের মধ্যে পার্থক্য করার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন না। মুজিব ইংরেজিতে যা বোঝাতেন, বাংলাতেও যে সেটা বোঝাতেন, তা নয়। ফলে মুজিব ইংরেজিতে যা বলতেন, সেটা রাজনৈতিকভাবে আপত্তিজনক না হলেও, বাংলা ভাষা ব্যবহারের এই দ্ব্যর্থবোধকতার কারণে তাঁর বিপ্লবী ও স্বাধীনতাকামী সমর্থকেরাও সন্তুষ্ট হতেন।

ছয় দফা কর্মসূচি

আওয়ামী লীগের ১৯৬৬ সালের ছয় দফা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে স্বায়ত্তশাসন অর্জন করা হবে। মূলত ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর শেখ মুজিব এ প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। এই যুদ্ধের শুরুতে অধিকাংশ বাঙালি মুসলমানই পাকিস্তানের পক্ষেই ছিলেন। যদিও যুদ্ধ যত এগোতে শুরু করল, ততই এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন, আর ভারতীয় আক্রমণের মুখে সে একদম প্রতিরক্ষাহীন। এই বিচ্ছিন্নতার কারণে অনেকের মনে গভীর নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়। আইয়ুব সরকারের পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক নীতির পরিণতি কী হতে পারে, এই যুদ্ধ থেকে সেটা পরিষ্কার বোঝা গেল। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুজিব ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন: প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকার, ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন, যার হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র, প্রাদেশিক সরকারের হাতে নিজস্ব মুদ্রাব্যবস্থা, রাজস্ব বিভাগ, বৈদেশিক বাণিজ্য ও আধা সামরিক বাহিনী থাকবে।

এই ছয় দফার সঙ্গে আগের স্বায়ত্তশাসনের দাবির পার্থক্য হলো, এতে রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্যের চুক্তি করার ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে দেওয়া হয়েছে। যাহোক, এই ছয় দফা দাবি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির গতিমুখ বদলে দেয়। এর আগে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক তত্পরতার মাজেজা ছিল এ রকম, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আরও বেশি কিছু করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে দেন-দরবার করা। এবার আওয়ামী লীগ দাবি করল, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের নিজেদের জন্য আরও বেশি কিছু করার সুযোগ দিতে হবে।

আইয়ুব খান সরকার খুব দ্রুত এই ছয় দফা কর্মসূচি দমন করল। মুজিবসহ অন্য শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। আর ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে ষড়যন্ত্র করে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। বিচারের সময় পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে ছয় দফা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় ছয় দফার ভিত্তিতে যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা হয়েছিল, সে প্রশ্নে আর আপস করার সুযোগ থাকল না। মুজিব আর তখন ছয় দফার সঠিকতা, বেঠিকতা বা সম্ভাব্যতা নিয়ে কথা বলেননি। আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাহলে এসব দাবি সংবিধানে যুক্ত করা হবে।

বাংলাদেশ

মুজিবের প্রচারণায় তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি ছিল দেশ (নিজের ভূখণ্ড)। বাঙালির কাছে দেশ মানে হচ্ছে বাস্তুভিটা ও তার আশপাশের খেত। সেটা হয়তো আরও একটু সম্প্রসারিত হয়ে পাশের গ্রাম, বাজার ও সংশ্লিষ্ট শহর পর্যন্ত যায়। এ ছাড়া আর সবকিছুই বিদেশ। মাটিই হচ্ছে দেশের প্রধান অনুষঙ্গ। যে মানুষেরা এই মাটির জাত, একই খাবার খায়, একই ভাষায় কথা বলে, একই পোশাক পরে, তারা একই দেশের মানুষ। আঞ্চলিক ভাষায় দেশ শব্দটি দিয়ে বাঙালিরা কাউকে সমগোত্রীয় মনে করে, আবার কাউকে আলাদা করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা এই শব্দটিকে আরও বৃহত্তর অর্থ দিতে চেয়েছেন, তাঁরা এটার অন্তজেলা ব্যঞ্জনাকে আন্তজেলায় রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়, সেই ১৯২০-এর দশকে সি আর দাশ পুরো বাংলার পরিপ্রেক্ষিতে দেশ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। মুজিব যে বাংলাদেশ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তাতে তিনি বেশ নিরাপদভাবেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্যের মধ্যেই থেকেছেন, যদিও তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে কথাটি বলেছেন। মুজিবের যুক্তি ছিল এ রকম: যারা বাংলাদেশের মাটিতে থাকে, তারা সবাই একই চেতনাসম্পন্ন মানুষ। ফলে এই মাটিতে যা হচ্ছে, তার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেওয়ার নৈতিক অধিকার তাদের আছে। পাকিস্তান প্রদেশ হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ সেই অধিকার পায়নি। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের শিকার হয়েছে।২

মুজিব যে দেশের কথা বলেছেন, তা মানুষের মনে এক আদিম সন্তুষ্টি উত্পাদন করেছে, যেটা আবার বাঙালির লক্ষ্যকে প্রতীকী মূল্যও দেয়। অবাঙালি মুসলমানেরা দেশকে বিদেশ (পাকিস্তান) থেকে আলাদা হিসেবেই দেখল। নির্বাচনী প্রচারণায় শেখ মুজিব খুব সতর্কতার সঙ্গে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটির ব্যবহার পূর্ব পাকিস্তানের প্রদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেন। কিন্তু দেশের মতো একটি স্থানীয় ও আঞ্চলিক শব্দকে সর্বজনীন রূপ দেওয়ার যে অন্তর্নিহিত দ্ব্যর্থবোধকতা রয়েছে, তার ফলে মুজিবের কিছু সমর্থক বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবিও তোলেন। স্বাধীনতার (স্বায়ত্তশাসন ও মুক্তি) মতো দেশের নানামাত্রিক অর্থ রয়েছে। মুজিবের কথামালার এই নানাবিধ ব্যঞ্জনার কারণে তাঁর প্রচারণার আবেদন আদর্শের রূপ নেয়, অংশত। ফলে মুজিব নতুন শব্দ ব্যবহার না করেও অনেক সময় বেশ বিপ্লবী হয়ে যেতে পারতেন।

শহীদের রক্ত

মুজিব বলতেন, বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবি সঠিক ও যৌক্তিক। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে যাঁরা রক্ত দিয়েছেন, তাঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে। এই শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর প্রথাটা ১৯৭০ সালের দিকে একরকম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এমনিতে ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হচ্ছে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মূল জায়গা। সব স্কুল-কলেজেও শহীদ মিনার আছে। অন্যদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদেরও ১৯৭০ সালের মধ্যে শহীদ হিসেবে গণ্য করা হলো।৩ ১৯৬৭ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যাঁরা সামরিক কারাগারে মারা গিয়েছিলেন, তাঁরাও শহীদের কাতারে নতুন করে স্থান পান। কালো পতাকা তোলা, কালো ব্যাজ পরা ও খালি পায়ে শহীদ মিনারে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর রীতি গড়ে ওঠে। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি সত্যিকার অর্থেই বাঙালির জাতীয় দিবসে পরিণত হয়।

বিষয়টা আরও জটিল হয়ে যায় এ কারণে, শহীদদের রক্ত যেমন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী প্রতীকে পরিণত হয়, তেমনি এই রক্ত মুসলমানদেরও প্রতীকে পরিণত হয়। এই প্রতীকের ধর্মীয় ভিত্তিও আছে। ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে হজরত মুহাম্মদের (দ.) মৃত্যুর পর মুসলিম উম্মাহ্র নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হয়। নবীর নাতি বংশধর হিসেবে নেতৃত্ব দাবি করলে আরেক দল এর বিরোধিতা করে বলে, জন্মসূত্রে নয়, যোগ্যতার গুণেই নেতৃত্ব নির্ধারিত হবে। প্রথমত, হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়, এরপর হুসেন ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে কারবালার যুদ্ধে প্রাণ হারান। প্রতিবছর মহররমের সময় তাঁদের এই শাহাদাতবরণের দিবস পালন করা হয়। এ দিনটি মুসলিম ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছরের প্রথম দিন। তবে বাঙালি সুন্নি মুসলমানেরা এ দিনটি উত্তর ভারতের মুসলমানদের মতো জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করে না। বাঙালিরা আসলে মহররমের মিছিলের সঙ্গে ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলের মিল খুঁজে পায়। এ ছাড়া যে অবাঙালি মুসলমানদের হাতে বাঙালি শহীদ হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই আবার শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। এই অসামঞ্জস্যটি বাঙালি মুসলমান ভুলতে পারেনি।

যে ভাষা আন্দোলনে বাঙালি প্রথম শহীদ হয়, সেটি কিন্তু নিঃসন্দেহে নৃতাত্ত্বিক, জাতীয়তাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাপার ছিল। তা ছাড়া এই আন্দোলন কিন্তু ইসলামের জাতি গঠনের ভূমিকা থেকে একদম বিচ্ছিন্ন নয়। পূর্ব পাকিস্তানের অনেক মুসলমানই এটা মনে করতেন, পাকিস্তান, যার অর্থ হচ্ছে পবিত্র ভূমি, সেই পাকিস্তান নামক দেশে কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। সেই পাকিস্তান আবার কীভাবে বাঙালি মুসলমানদের হত্যা করছে। কথা হচ্ছে, আওয়ামী মুসলিম লীগ যে ১৯৫৩ সালে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ হলো, সেটা কিন্তু মুসলিম মূল্যবোধকে অস্বীকার করে হয়নি। পাকিস্তানের নেতারা ইসলামের নামে যে সাম্প্রদায়িকতা শুরু করেছিলেন, তাতে বিরক্ত হয়ে তাঁরা মুসলিম শব্দটি নাম থেকে বাদ দিয়েছিলেন। মুজিবুর রহমান এ সময় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিপক্ব হয়েছেন। বাঙালি শহীদের রক্ত কথাটি তখন তিনি বহুবার ব্যবহার করেছেন। আসলে এই শহীদের রক্ত ছিল পূর্ব পাকিস্তানের দাবির ইসলামি যুক্তি, যেটা বাংলা ভাষার চেয়েও অনেক কার্যকর প্রতীক ছিল।

মুজিব এ দাবিও করেছিলেন, শহীদদের রক্তের প্রতি সত্যনিষ্ঠ থাকতে বাঙালিদের দাবির ব্যাপারে অবিচল থাকতে হবে। তখন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া শহীদদের রক্তের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর শামিল ছিল। এ ধরনের দৃঢ়তা প্রয়োজনীয় ছিল, কারণ নির্বাচন হবে কি না, সে নিয়েই অনেক সন্দেহ ছিল। তিনি বারবার এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিতেন, ফলে মানুষের সন্দেহ আরও পাকাপোক্ত হতো। শিক্ষক, ছাত্র, দোকানদার, রিকশাচালক—সবাই এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে নির্বাচন হবে না। বন্যার কারণে নির্বাচন অক্টোবর থেকে পিছিয়ে ডিসেম্বরে নিয়ে যাওয়ার কারণে এ সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়।

মুজিব এই সন্দেহ কাজে লাগিয়ে শহীদদের রক্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গণ-আন্দোলন শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এতে তাঁর প্রচারণায় মানুষের উত্সাহ সৃষ্টি হয়। নির্বাচন হোক বা না হোক, তিনি ইতিবাচক ও ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

শেষমেশ সাংস্কৃতিক বীর হিসেবে মুজিব যে ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন, তাতে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়ে যায়। মানুষের মনে যে জাতীয়তাবাদী শহীদ নেতাদের স্মৃতি ছিল, তার সঙ্গে মুজিবের বেশ মিল ছিল। কারণ, বাংলাদেশের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি বহুদিন জেল খেটেছেন। আর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার প্রকাশ্যে করার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যিক, ছাত্র, কর্মী ও জনতা এতটা সহিংস হয়ে উঠেছিল, যার জেরে আইয়ুব খানের পতন হয়। তবে তার আরও কিছু কারণ ছিল। শেখ মুজিব ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যেদিন ছাড়া পান, সেদিন ঢাকায় এক বিশাল বিজয় মিছিল হয়েছিল। সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়। এ ধরনের উপাধি সাধারণত বাঙালি রাজনৈতিক বীরদের দেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালে মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন, অন্য কোনো রাজনীতিক তাঁর ধারেকাছে যেতে পারেননি। তাঁর জনসভায় নিয়মিতই লাখ দশেক লোক হতো। মুজিব নিজের ক্যারিশমা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, সে কারণে তিনি সব সময়ই নিজেকে পূর্ব পাকিস্তানের মুখপাত্র হিসেবে দাবি করতেন।

মোদ্দা কথা হলো, মুজিব বিভিন্ন প্রতীকের এক জটিল সমন্বয় তৈরি করেছিলেন, যেটা বাঙালির আগ্রহকে রাজনৈতিক লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করেছিল। ‘বাংলাদেশ’, ‘স্বায়ত্তশাসন’ প্রভৃতি শব্দের দ্ব্যর্থবোধকতার জন্য এবং ছয় দফা কর্মসূচির অযথার্থ ও আদর্শ রূপের জন্য মুজিবের পক্ষে এটা দাবি করা সহজ ছিল যে তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে হুমকি জানাচ্ছেন না। ফলে একই সময়ে মুজিবের বিপ্লবী সহচরদের পক্ষে নিজের প্রতীক ও শব্দ ব্যবহার করেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা প্রচার করা সম্ভব হয়েছে। একই শব্দের এ রকম ভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে এসব প্রতীক জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছে। আর নভেম্বরের সাইক্লোনে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হওয়ায় এসব প্রতীক পুনর্বিন্যাস করা সম্ভব হয়েছে। এতে তাঁর পক্ষে শহীদদের রক্তের প্রতীকের ওপর জোর দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

দুই. সাইক্লোন

১২-১৩ নভেম্বর রাতে বাংলাদেশের উপকূলে যে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোন হয়, তাতে লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। জানমালের ক্ষতিও হয় ব্যাপক। এর ব্যাপকতা সম্পর্কে জানতে একটু সময় লেগে যায়। তবে ১৬ নভেম্বর থেকে সংবাদপত্রে খবর আসতে থাকে, পাকিস্তান সরকার এ ব্যাপারে চরম ঔদাসীন্য ও অমনোযোগ দেখাচ্ছে। সংবাদপত্রগুলো অভিযোগ করে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে ত্রাণ না পাঠিয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষদের না খাইয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আবার অনেকেই পূর্বাভাসব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়ে সোচ্চার হন। বন্যানিয়ন্ত্রণ ও বাঁধ নির্মাণে সরকারের ব্যর্থতার জন্যও অনেকে সমালোচনা করেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মওলানা ভাসানীও সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা ঘোষণা করে গণ-আন্দোলনের ডাক দেন (পাকিস্তান অবজারভার, ২৫ নভেম্বর)।

সাইক্লোনের সময় মুজিব আক্রান্ত এলাকাতেই নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। পরবর্তী দুই সপ্তাহে তিনি উপদ্রুত এলাকা একদম চষে ফেলেন। তিনি সরকারের অবহেলার তীব্র সমালোচনা করেন। ২৭ নভেম্বর ঢাকা ফিরে তিনি সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করে নিজের অবস্থানের সারসংক্ষেপ পেশ করেন (রহমান ১৯৭২: ১৩-১৯)। এই বিবৃতির কারণে তাঁর প্রচারণার আবেদন অন্য স্তরে পৌঁছে যায়। মুজিবের ভাষায়, প্রত্যেক বাংলাদেশিই তখন সত্যিকার অর্থেই হুমকির সম্মুখীন। মুজিবের নালিশই হচ্ছে এই বিবৃতির প্রাণ:

স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সকল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদে। সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকার ও আমলাতন্ত্রের হাতে। বাংলাদেশের প্রতি অপরাধমূলক অবহেলা ও বৈষম্য করার জন্য আমি আজ তাদের অভিযুক্ত করব, যার কারণে আমরা প্রকৃতির খেয়ালের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছি। আমাদের ১০ লাখ মানুষ মারা গেছে। আর ৩০ লাখ মানুষ মৃত্যু ও ধ্বংসের মাঝে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

শেখ মুজিব অভিযোগ করেন, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সাইক্লোনের মাধ্যমে সচেতনভাবে মানুষকে হত্যা করছে। তারা ১০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে। হ্যাঁ, বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে তিনি কিছুটা নিষ্ঠুর হয়েছেন। কিন্তু এই সংকটের সময় এটা শক্তিশালী রাজনৈতিক উেপ্রক্ষায় (metaphor) পরিণত হয়, যেটাকে স্রেফ অযৌক্তিক অতিরঞ্জন বলা যাবে না। গার্টজের (১৯৭৩: ২১০-১৩) মতে, একটি সফল রাজনৈতিক উেপ্রক্ষার মধ্যে কয়েক স্তরের অর্থময়তা থাকে, যেখানে এক স্তরের অসামঞ্জস্য, আরেক স্তরে অর্থের অন্তঃপ্রবাহ সৃষ্টি করে। গার্টজ বোধ করেন, উেপ্রক্ষা যত বেশি নির্মম হবে, তথ্যগত দিক থেকে যত ভুল হবে আর সে কারণে অসামঞ্জস্য থাকবে, ততই সেই উেপ্রক্ষা সফল হবে।৪ সন্দেহ নেই, সাইক্লোন সৃষ্টির মাধ্যমে একটি সরকার মানুষ হত্যা করেছে—এমন অভিযোগ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু এই অভিযোগ বাংলাদেশিদের মনে সরকারের অবহেলার কারণে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল, তাকে এক বিন্দুতে নিয়ে আসে। ফলে প্রত্যেক বাংলাদেশির মনে যে জীবনের হুমকিস্বরূপ যে সংকট ছিল তার তুলনায় এই অসামঞ্জস্য গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। ঘটনার ভয়াবহতার মাত্রা, জীবনহানি এবং এ রকম বিপর্যয় ভবিষ্যতে আবারও ঘটবে কি না, সে-বিষয়ক যে অনিশ্চয়তা ছিল, তার কারণে পল ব্র্যাসের ভাষায় (১৯৮১: ১-২০) সাইক্লোনটা সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সংকটে পরিণত হয়।

মুজিব জীবনঘাতী সংকট হিসেবে সাইক্লোনের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে তিনি বাঙালি মুসলমানের মৃত্যুবিষয়ক মনোভাব নিয়ে খেলা করেছেন।

ইসলাম ধর্মানুসারে, মানুষের যে চারটি বিষয় আল্লাহর হাতে তার একটি হচ্ছে মৃত্যু (মওত); অন্যগুলো হচ্ছে জন্ম, রিজিক বা জীবিকা ও সম্পদ। মানুষের জীবনের এই চারটি দিক নিয়েই তার ভাগ্য গঠিত হয়। এটা প্রতিষ্ঠা করেছেন আল্লাহ স্বয়ং। প্রতিবছর শবে বরাতের (থর্প ১৯৭৮: ৫৫-৭, ১০৯-১১) রাতে এই ভাগ্যের নবায়ন হয়। এমনকি সাইক্লোনে যে পরিমাণ মানুষের মৃত্যু হলো, তা বাঙালি মুসলমানের কাছে সংকট নয়। প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার জন্য তা হুমকিও নয়। এই এত মানুষের মৃত্যুকে আল্লাহর ইচ্ছা বলে ব্যাখ্যা করা যায়। বাংলাদেশি মুসলমান এই চারটি জিনিসের যে ধারণা পোষণ করে, তাতে বিশ্বাসীর দিক থেকেও সাড়া দেওয়ার আহ্বান থাকে। একজন মানুষ মৃত্যু, জীবিকা ও সম্পদ হারানোর ঘটনায় কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানদের আদর্শ ও গৃহীত আচরণ অনুসারে প্রত্যেক মুসলমানকে সাড়া দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। আল্লাহ এর মাধ্যমে ইসলামের প্রতি মানুষের সমর্পণের মাত্রা পরীক্ষা করেন। ব্যক্তির কাছ থেকে যেমন যথাযথ আচরণ প্রত্যাশা করা হয়, তেমনি যাঁরা ইসলামের ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাস করেন, তাঁদের সবার কাছ থেকে যথাযথভাবে যৌথ সাড়া প্রত্যাশা করা হয়। মুজিব সাইক্লোনের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার নজর ছিল সমাজের প্রতিক্রিয়ার দিকে, যেটা ভালো মুসলমানের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা যায়। মুজিবের অন্তর্নিহিত যুক্তিটি ছিল এই রকম যে এই মাত্রার একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনায় দেশের মুসলমানদের সাড়া দেওয়া উচিত। পাকিস্তান সরকার সেটা না করে মুসলমান রাষ্ট্রের মতো কাজ করেনি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, সাইক্লোনে যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের শহীদ আখ্যা দিয়ে মুজিব বোঝাতে চাইলেন, সরকারের এই অবহেলা পূর্বনির্ধারিত, সে কারণে এটা হত্যাকাণ্ড। আর মুজিব যখন একবার এটা প্রতিষ্ঠিত করলেন যে সরকার গণহারে মানুষ মেরেছে, তখন পাকিস্তান সরকারের আর কোনো বৈধতা রইল না। পাকিস্তানের মুসলিম শাসকেরা সবচেয়ে নিকৃষ্ট পর্যায়ের অবিশ্বাসীর কাজ করেছে। তারা প্রতিটি বাংলাদেশির জন্যই হুমকি। কারণ, তারা যদি একবার এত মানুষকে মারার মতো ঔদাসীন্য দেখাতে পারে, তাহলে তারা আবারও সে কাজ করতে পারে। মুজিব দেশবাসীর কাছে আবেদন জানালেন, তাঁরা যেন আবারও এভাবে মারা না পড়েন। তাঁরা যেন এই অন্যায় পরাধীনতা মেনে না নিয়ে লড়াই করে শাহাদাতবরণ করেন। ২৭ নভেম্বর তিনি এই আলটিমেটাম দিয়ে দোষারোপের রাজনীতি শেষ করেন:

বাংলাদেশ এখন জেগে উঠেছে। যদি নির্বাচন বানচাল না হয়, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা রায় দেবে। আর তা করা হলে বাংলাদেশের মানুষ মনে করবে...

এই লাখ লাখ শহীদের উেপ্রক্ষাটি প্রচারণা পর্বকে সাধারণ দেওয়া-নেওয়ার রাজনীতি থেকে বের করে আনে। অর্থাত্ মুজিব এর মধ্য দিয়ে একটি প্রক্রিয়া শুরু করেন, ‘সাংস্কৃতিক বন্ধন’ নির্মাণের প্রচেষ্টা, যেটা এক অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে (টারনার, ১৯৭৭: ৯৪-১১৮), যেটা চূড়ান্ত পর্যায়ে ওঠে মার্চ মাসে।৫ মুসলিম পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে মুজিব পাকিস্তানের কাঠামো বদল করার চেষ্টা করেছেন। লাখ লাখ শহীদের চিত্রকল্প তৈরি করে মুজিব এক অপরিবর্তনীয় বাংলাদেশের নিয়ম প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন। তিনি এমন এক দেশের আহ্বান জানান, যেখানে সত্যিকার অর্থেই মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব থাকবে। ফলে মুজিব আর তখন স্বাধীন পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করছিলেন না। মুজিব যেহেতু পরবর্তী মাসগুলোতে নিজের যুক্তি প্রমাণ করছিলেন, বাঙালি তখন বুঝতে পারে, অবলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে হলে নতুন ব্যবস্থা নির্মাণ নৈতিকভাবে জরুরি। মুজিবের প্রচারণার আবেদন ছিল এ রকম: লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন লাভ করা সঠিক ও ন্যায্য/ছয় দফা দাবির আলোকে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন লাভ করা খুবই জরুরি।

মুজিবের প্রচারণার আবেদনে শুধু রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ছিল না, তার মধ্যে নতুন এক আদর্শও ছিল, যেটা এক নতুন জাতি নির্মাণ করতে পারত।

এখন মুজিব হয়ে গেলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদী ক্যারিশম্যাটিক মুখপাত্র (দেশের প্রতিশব্দ)। এদিকে মুজিব ‘১০ লাখ শহীদের’ প্রতীক ও স্লোগান ব্যবহার করা শুরু করার পরপরই অন্য রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করে বসে, নির্বাচন আবারও পেছাতে হবে। আপাতভাবে এর কারণ ছিল, ত্রাণ তত্পরতা পরিচালনা করা। তবে বাস্তবতা ছিল এ রকম, আওয়ামী লীগের কাছে তাদের পরাজয় একদম দৃশ্যমান ছিল। তাদের আন্দোলন যখন ব্যর্থ হলো ও শুধু আক্রান্ত অঞ্চলের নির্বাচন স্থগিত করা হলো, তখন তারা নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিল। এরপর দেখা গেল, ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ৫৮ শতাংশ ভোটার ভোট দিলেন। ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৫৩ শতাংশ আসন পেল। বিস্ময়করভাবে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি দ্বিতীয় সংখ্যাগারিষ্ঠতা পেল। এরা পশ্চিম পাকিস্তানের ২৭ শতাংশ আসন পেল। মূলত পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে তারা বেশি আসন পেয়েছিল (মনিরুজ্জামান, ১৯৮০: ৭১-২: সেনগুপ্ত ১৯৮১: ২২৬; জাহান, ১৯৭২ বি: ১৯০)। ওদিকে ভুট্টো প্রকাশ্যেই ছয় দফা দাবির বিরুদ্ধে ছিলেন। আর নির্বাচনে জয়ের ব্যবধানের কারণে তিনি আরও বেশি আপসহীন হয়ে ওঠেন। ওদিকে মুজিবও যে নির্বাচনে এত বড় ব্যবধানে জিতবেন, সেটা ভাবা যায়নি। তিনি জনসমক্ষে বলেছিলেন, ৯০ শতাংশ ভোট পাবেন তিনি (ডন, ১০ অক্টোবর)। বস্তুত, তিনি ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। ফলে একটি স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশকে হাতের নাগালেই দেখা যাচ্ছিল।

তিন. শিলীভূতকরণ

মুজিব যখন গণপরিষদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তাঁর ব্যবহূত প্রতীকগুচ্ছ আদর্শের রূপ নিচ্ছিল। গার্টজ (১৯৭৩: ২১৮-২০) একে আদর্শ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অর্থাত্ এটা এক মিথস্ক্রিয়ামূলক প্রতীকের ব্যবস্থা, যার মধ্য দিয়ে পরস্পর ক্রিয়াশীল অর্থের সুনির্দিষ্ট ধরন গড়ে ওঠে, যার মধ্যে অন্তত কাজের আধা বাস্তব এক পরিকল্পনা দৃশ্যমান হয় (মুলিনস, ১৯৭২: ৫০৭)। আদর্শের এই প্রতীকী বিন্যাসের মধ্য দিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির জন্য যৌথ চেতনা গড়ে ওঠে। কথা হচ্ছে, মুজিব যে লাখ লাখ শহীদের কথা বলেছেন, তা কিন্তু তিনি শুধু রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য বলেননি (জাহান, ১৯৭২ বি: ১৯১)। এই প্রতীক পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের রাগ-ক্ষোভকে ভাষা দিয়েছে। এই প্রতীকের মধ্য দিয়ে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, প্রতিটি মানুষের জীবনই হুমকির মুখে রয়েছে, সংকটাপন্ন। প্রত্যেক বাঙালিই শহীদ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আর এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মুজিব দেশবাসীকে একটি পরিকল্পনাও দেন। আর নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে মুজিব ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করতে সক্ষম হন, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত হবে। অর্থাত্ মানুষের সংকটের নিরসন হবে। ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত মুজিব এ প্রতীকগুলো এস্তেমাল করেছেন। একই সঙ্গে, তিনি কাজের পরিকল্পনাও পেশ করেছেন, যাতে প্রতিটি শ্রেণি-পেশার বাঙালি বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নৈতিক বল পায়। মুজিব আসলে একগুচ্ছ প্রতীক নির্মাণ করেছিলেন, যেটা বাঙালির আবেগকে সংকল্পবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে নিয়ে গেছে, যেটা শেষমেশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ নেয়।

মুজিব নিজের নেতৃত্ব কায়েম করতে সময় অপচয় করেননি। প্রথমত, তিনি ঘোষণা দেন, বাংলাদেশের মানুষ ছয় দফা অনুমোদন করেছে, তাই সংবিধান ছয় দফার আলোকেই প্রণীত হবে (পাকিস্তান অবজারভার, ১০ ও ২০ ডিসেম্বর)। দ্বিতীয়ত, মুজিব সুনির্দিষ্টভাবে দাবি করেন, কেন্দ্রীয় সরকার ত্রাণ কার্যক্রমের দায়িত্ব যেন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের হাতে দেয়। তিনি সরাসরি মঞ্জুরি দাবি করেন, ঋণ নয়। তৃতীয়ত, মুজিব সব রাজনৈতিক নেতার মুক্তি দাবি করেন (পাকিস্তান অবজারভার, ৩০ ডিসেম্বর)। চতুর্থত, ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রমনার রেসকোর্সে এক বিশাল সমাবেশে মুজিব আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত প্রতিনিধিদের শপথবাক্য পাঠ করান। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। এসব ঘটনায় মুজিবের বাংলাদেশ এক নাটকীয় রূপ পায়।

৩ জানুয়ারির অভিষেক সমাবেশ এক অসাধারণ প্রথার রূপ পায়। বক্তার ডায়াসটি ছিল ১২০ ফুট লম্বা, সেটি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার আদলে বানানো হয়েছিল। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। সেখানে সাইক্লোনে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ দোয়াও করা হয়। সমাবেশের সভাপতি হিসেবে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকেরা মুজিবকে গার্ড অব অনার দেন। বিউগলের সুরে পার্টির পতাকাও৬ তোলা হয়। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানের সঙ্গে মুজিব নৌকা-আকৃতির ডায়াসের পর্দা উন্মোচন করেন। নৌকার পালে বাংলাদেশের মানচিত্র ও পার্টির স্লোগান ‘জয় বাংলা’ লেখা ছিল। মুজিব ১৭টি সাদা পায়রা উড়িয়ে দেন, ছয় দফার জন্য ছয়টি এবং ১১ দফার জন্য ১১টি সাদা পায়রা। দেখা গেল, একটি পায়রা পালের জয় শব্দটার ওপর গিয়ে বসল। লোকে এটাকে শুভ লক্ষণ হিসেবেই দেখল। দর্শকেরা রবীন্দ্রসংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইলেন। এরপর প্রায় ১০ লাখ মানুষের সামনে মুজিব শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। তিনি আল্লাহ ও শহীদদের নামে তাঁদের প্রতি আহ্বান জানান, তাঁরা যেন জীবনের বিনিময়ে হলেও ছয় দফা ও ১১ দফার প্রতি আস্থাভাজন থাকেন। প্রতীকী কাজ ও মৃদুস্বরে কথা বলা হচ্ছে যেকোনো আচার-অনুষ্ঠানের প্রাণ। এসব সুনির্দিষ্ট কাজ ও শপথের ভাষা আওয়ামী লীগের একতা ও সংকল্পকে দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ দিয়েছিল। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে বাংলাদেশিদের সামষ্টিকভাবে এই আবেগ লালন করতে আকৃষ্ট করা হলো।

এরপর মুজিব সমাবেশের মূল ভাষণটি দিলেন। তাঁর ভাষণের মধ্যে বিজয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু তার মধ্যে আসন্ন বিপদের আশঙ্কাও ছিল। তিনি ১০ লাখের বেশি জনতাকে উদ্দেশ করে বলেন, যদিও তাঁরা নির্বাচনে জিতেছেন, আসল সংগ্রাম কেবল শুরু হয়েছে:

আমরা জনগণের প্রতিনিধি, আমরা একটি সংবিধান রচনা করব। আমাদের মহান নেতা সোহরাওয়ার্দীর কথা উদ্ধৃত করি: ‘জাতির কাজ-কারবারে জনগণের রায়ই চূড়ান্ত।’ কেউ যদি এই রায়ে নাক গলায়, তাহলে রক্তপাত হবে। আর সঙ্গে হবে বিদ্রোহ, যেটা কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। (রহমান ১৯৭২: ৩৬)

এই নাক গলানোর ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। কারণ, ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর কয়েক দফা হামলা চালানো হয়েছিল। এমনকি এমন গুজবও ছিল, মুজিবকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে (ডন, ১৩ ডিসেম্বর)। চট্টগ্রাম ও খুলনায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে (পাকিস্তান অবজারভার, ১২ ও ২৪ ডিসম্বের)। মুজিব সমবেত জনতাকে বলেন, তাঁরা যেন তাঁদের মধ্যকার সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করেন:

রাতের বেলা ছুরি মেরে মানুষ হত্যা করে বিপ্লব করা যায় না। আমি এই তথাকথিত সন্ত্রাসী, তাদের দালাল ও উপদেষ্টাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, এ রকম সহিংসতা তারা যেন আর না করে। দলের লোকদের বলব, তারা যেন এদের প্রতিহত করতে প্রস্তুত থাকে। প্রতিটি গ্রামে দলকে সংগঠিত করুন। বাঁশের লাঠি ও সুন্দরী কাঠ দিয়ে এই সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করুন। কিন্তু আমি না বলা পর্যন্ত আপনারা এই লাঠি ব্যবহার করবেন না। আপনারা এমন কিছু করবেন না, যাতে শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে। এখন শান্তিও দরকার। সে কারণেই উসকানি, যেমন—আমাদের দলের লোকেদের খুন করা, সত্ত্বেও আমরা সহিষ্ণুতা দেখাচ্ছি। (রহমান, ১৯৭২: ৩৯)

নির্বাচনের পর এক মিশ্র পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। ছিল দোদুল্যমানতা। একদিকে যেমন আনন্দ ছিল, অন্যদিকে তেমনি ছিল আশঙ্কা—এরপর কে শহীদ হবেন? আবার সাইক্লোনের কারণে যে জীবন হারানোর সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, সেটিও চলছিল। আওয়ামী লীগের বিজয়ের ব্যবধানের কারণে দেশে উত্তেজনার মাত্রা বেড়ে যায়। বাঙালিদের একটি পার্টি এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, এটা পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক নতুন বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর মধ্য দিয়ে আগের রাজনীতি থেকে একটা বিচ্যুতিও ঘটে। আবার মার্চের অসাধারণ ঘটনার জন্য প্রস্তুতিও ছিল।

এই সময় মুজিব মানুষকে সতর্ক থাকার যে আহ্বান জানিয়েছেন, তাতে তিনি বারবার লাখ লাখ শহীদের স্মৃতি জাগানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি আদর্শ উপস্থাপনের এক নতুন প্রতীকী তরিকা পেশ করেন। তিনি আবার বারবার মানুষকে লাঠি প্রস্তুত রাখার আহ্বান জানান। যারা মানুষের ইচ্ছাকে নাকচ করার চেষ্টা করবে, তাদের প্রতিহত করে শহীদের রক্তের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। লাঠি বাংলাদেশের নিজস্ব এক অস্ত্র। লাঠিখেলায় এর ব্যবহার হয়। মহররমের মিছিলেও কখনো কখনো লাঠিখেলার আয়োজন করা হয়। তবে মুজিব যে লাঠি প্রস্তুত রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন, তা কোনো নতুন রাজনৈতিক রীতি ছিল না। সেই ১৯ শতকের ফরায়েজি আন্দোলনে লাঠি প্রতীকী শক্তি ও সংকল্পের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে (এম খান, ১৯৬৫)। ১৯৭১ সালে লাঠি এক জনপ্রিয় প্রতীকে পরিণত হয়, যার মধ্যে সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় উপাদানের সমন্বয় ঘটেছিল। আর অস্ত্র হিসেবে তো তার একটা উপযোগিতা ছিলই। বিশেষ করে, শেখ মুজিবের বাড়িতে ছুরি বহন করার সময় এক কথিত হত্যাকারীকে ধরার পর লাঠি আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে (পাকিস্তান অবজারভার, ৯ জানুয়ারি)। সংসদের অধিবেশন বসতে কোনো কারণে দেরি হতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে মুজিব বাংলাদেশিদের একতার ওপর জোর দেন। তিনি আহ্বান জানালেন, নিজেদের অধিকার রক্ষায় প্রয়োজনে রক্ত দিতে হতে পারে। আর যারা জনগণের আকাঙ্ক্ষা নস্যাত্ করার চেষ্টা করবে, তাদের রক্ত ঝরানোর জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।

মধ্য ফেব্রুয়ারিতে যখন ঘোষণা করা হলো, ৩ মার্চ ঢাকায় অধিবেশন বসবে, তখন ভুট্টো ঘোষণা দিলেন, তাঁর পার্টি অধিবেশনে যোগ দেবে না (পাকিস্তান অবজারভার, ১৬ ফেব্রুয়ারি)। বাংলাদেশের মানুষ বুঝে গেল, সব অপকর্মের কলকাঠি কে নাড়ে। ভুট্টোর যুক্তি মুজিবের মনে ধরল না। ভুট্টো বলেছিলেন, পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগের শাসন চলতে পারে, কিন্তু সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে পঞ্চায়েতের মতো সম্মতির ভিত্তিতে (পাকিস্তান অবজারভার, ২২, ২৮ ও ৩১ জানুয়ারি)। ২১ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব আহ্বান জানালেন, বাঙালিদের অবিচলিত থাকতে হবে। সামনে লড়াই হবে, তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বাঙালিদের আর শহীদ হলে চলবে না, তাদের গাজি (বিজয়ী) হতে হবে (পাকিস্তান অবজারভার, ২১ ফেব্রুয়ারি)। সেদিনের অনুষ্ঠানে সব বক্তাই আসন্ন শক্তি প্রদর্শনের ওপর ব্যাপক জোর দিলেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একতা ও রক্তের বদলে রক্ত নেওয়ার অঙ্গীকার করা হলো। ১৯৭১ সালে কেউ হালকাভাবে এই শপথ নেননি। তদুপরি, বহু মানুষ এই শপথ নেন। তবে মুজিবের বাংলাদেশ আদর্শের প্রতীকগুচ্ছের আন্তসম্পর্কিত অর্থময়তার গতি-প্রকৃতির কারণে আপস-রফার সম্ভাবনা কঠিন হয়ে ওঠে।

চার. ক্রান্তিকালীন চূড়ান্ত পরিণতি

এই ব্যাপারটা মূলত ধর্মীয় আচারের সঙ্গে সম্পর্কিত (টারনার, ১৯৭৭: ৯৪-১১৩)। ধর্মীয় আচারে অংশগ্রহণকারীরা সাধারণ সামাজিক কার্যক্রম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে অনুষ্ঠানের বিশেষ সময়ে ধর্মীয় গুরু হিসেবে নিজেদের হাজির করেন। এই সময় তাদের সত্তাগত অবস্থানের এক ধরনের পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনের ধারায় সাধারণ সামাজিক জীবনের এক ক্রান্তিকালে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধিতায় সমাজের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।  সেই সাথে সামাজিক কাঠামোগত পার্থক্যগুলো যেমন বয়স, লিঙ্গ, শ্রেণি, বর্ণ, ধর্ম, পেশা প্রভৃতি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। ধর্মগুরুরা এ সময় তাঁদের ব্যক্তিত্বেও পূর্ণাঙ্গ সত্তার অভিজ্ঞতা লাভ করেন। সাধারণ সামাজিক কাঠামোতে তাদের যে ব্যক্তিসত্তা থাকে, এ সময় যেন তাঁদের সেখান থেকে উত্তরণ ঘটে (টার্কল, ১৯৭৫:৯১)। এসব কারণে তাঁরা নিজেদের চূড়ান্ত মূল্যবোধগুলো অনুধাবন করতে পারেন, জীবনের পূর্ণাঙ্গতা অনুভব করতে পারেন।

কথা হচ্ছে, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসেও এ দেশের মানুষ সাধারণ সত্তা থেকে মুক্ত হয়ে এক ক্রান্তিকালীন চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল। আগে থেকেই এমন একটা পরিস্থিতি ছিল, যার কারণে ওই সময়টা বিশেষ হয়ে উঠেছিল। ওটা সাধারণ পরিস্থিতি ছিল না। বিষয়টা হচ্ছে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন পাকিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। নভেম্বরের সাইক্লোনে লাখো মানুষের মৃত্যু, মুজিবের মৃতদের শহীদ আখ্যা দেওয়া এবং আওয়ামী লীগের এমন সর্বব্যাপক বিজয়ের কারণে বাংলাদেশে এক বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এরপর যখন ১ মার্চ অধিবেশন স্থগিত করা হলো, তখন পরিস্থিতি বদলে গেল। ব্যাপারটা এমন মনে হলো, যেন এক সর্বব্যাপক রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল উপস্থিত হয়েছে, যেটা পরবর্তী সময়কে সাধারণ সময় থেকে আলাদা করে ফেলল। বিশেষ করে, ঢাকা নগরের মানুষের কাছে ব্যাপারটা এমন মনে হলো, কারণ এ শহরটি ছিল সব রাজনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্র। সরকার সাধারণ ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক কাঠামো বজায় রাখতে চাইল। তাদের কাছে স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ ছিল চূড়ান্ত মাত্রার কাঠামোবিরোধী। সংসদের অধিবেশন বসলে যেসব পরিবর্তন হতো, সেটা তারা মেনে নিতে পারত না। অন্যদিকে বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই নতুন কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়েছিল। ফলে অধিবেশন স্থগিত করার কারণে তারা পাকিস্তানের পুরোনো ও বাংলাদেশের নতুন কাঠামোর মধ্যে পড়ে গেল। তার অবস্থা হলো এ রকম—না ঘরকা, না ঘাটকা।

মুজিব তাঁর আদর্শের প্রতীকের সাপেক্ষে বাংলাদেশের ব্যাপারে মানুষের এমন আগ্রহ সৃষ্টি করলেন, যার কারণে মার্চ মাস সময়ের সেরা সময় হয়ে উঠল। বাংলাদেশ যেন তখন ‘সমাজ’ গঠনের এক অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠে, যে সমাজ পেশা, শ্রেণি, ধর্ম ও আত্মীয়তার বেড়াজাল কাটিয়ে উঠেছিল। দৃশ্যত, বাংলাদেশে তখন এক নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে উঠেছিল। প্রায়ই যে সমাবেশ হতো, তাতে এই সমাজ গঠিত হওয়ার ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। একই সঙ্গে এখান থেকে এক উত্সবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মানুষ একটা মিছিল থেকে আরেকটি মিছিল বা বিক্ষোভ সমাবেশে যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে এই উত্সবমুখর পরিবেশটা বজায় রাখতে চেয়েছে। এ ছাড়া মার্চের মধ্যভাগের মধ্যে দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রমের অনেক কিছুই মুজিবের হুকুমে চলতে থাকে। ফলাফল হিসেবে বাঙালি দেখল, তাদের কাঠামোবিরোধী দাবি বাংলাদেশের ব্যবস্থায় রূপ নিচ্ছে। মার্চের ঘটনাপ্রবাহের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে এই ব্যাখ্যাই পাওয়া যাবে।

মুজিব প্রায়ই যে গণ-আন্দোলনের ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, অধিবেশন স্থগিত করার পর তা শুরু হলো। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এল। শেখ মুজিব তখন আওয়ামী লীগের এক বৈঠকে ছিলেন, মানুষ তাঁর কাছেই গেল। মুজিব এতে সত্যিই বিস্মিত হন। তিনি ছিলেন অপ্রস্তুত। ক্ষুব্ধ জনতার উদ্দেশে তিনি বললেন, ৭ মার্চ শনিবার কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। অর্থাত্ কিছুটা সময় নিলেন তিনি। তিনি ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেন। আক্ষরিকভাবেই মানুষ সব দিক থেকে প্রতিবাদে শামিল হতে শুরু করল। ফলে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ করতে মুজিব সমস্যায় পড়ে গেলেন।

২ মার্চ ঢাকা মিছিলের শহরে পরিণত হয়। সকালের দিকে সেনাবাহিনী বিমানবন্দরে সড়কের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে জনতার ওপর গুলি করে, এতে দুজন নিহত হন। গুলির খবর ছড়িয়ে পড়লে মানুষ লাঠি মিছিল নিয়ে ওই মোড়ের দিকে আসতে শুরু করে, যেখানে গুলি করা হয়েছিল। একপর্যায়ে সব মিছিল একত্র হয়ে এক মিছিলে পরিণত হলো। এরপর তারা অত্যন্ত দৃঢ়সংকল্প নিয়ে ঢাকার রাস্তায় মিছিল করতে থাকে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল, ঢাকার একটি বাণিজ্যিক এলাকা অতিক্রম করতে এই বিশাল মিছিলের ৪৫ মিনিট সময় লাগল। মিছিলকারীদের হাতে লাঠি, লোহার রড, কালো পতাকা ছিল, আক্ষরিকভাবেই তারা রক্ত নেওয়ার গর্জন করছিল। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্ন সহিংসতা হচ্ছিল। রাত নয়টায় সেনাবাহিনী কারফিউ জারি করে। কিন্তু জনতা কারফিউ অগ্রাহ্য করল। পরিণামে সেনাবাহিনী জনতার ওপর গুলি চালাল। কারফিউয়ের সময় মিছিলের স্লোগানও বদলে গেল। এর আগে মিছিলকারীরা বলত, ‘জাগো বাঙালি, জাগো’, এবার তারা বলল, ‘আমরা জেগেছি’। পূর্ব পাকিস্তানে এর আগের সব মিছিলের মতো এই মিছিলও স্বতঃস্ফূর্ত ও লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরতে থাকল। কিন্তু পার্থক্য একটাই, এবার সেনাবাহিনী মিছিল থামাতে পারল না।

প্রতিশ্রুতিমাফিক গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করতে হলে মুজিবকে এই মিছিলের নিয়ন্ত্রণ নিতে হতো, যাতে এটা সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলায় পর্যবসিত না হয়। ১৯৬৮-৬৯-এর গণ-আন্দোলনের সময়ও এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল (জাহান, ১৯৭২ বি: ১৬৮-৯; মনিরুজ্জামান, ১৯৮০: ৬১-৬)। তাঁর উদ্বেগের মূল কারণ ছিল, অবাঙালিদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতা, যার রাশ তাঁকে টানতে হতো। একই সঙ্গে, এই অধিবেশন স্থগিতের বিরুদ্ধে তাঁকে কার্যকর একটা অবস্থানও নিতে হবে। গণমাধ্যমে বিবৃতি ও ৩ মার্চ ঢাকার এক সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার মধ্য দিয়ে মুজিব নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে মার্চ মাস বাঙালির রাজনৈতিক জীবনের এক বিশেষ ক্রান্তিকালীন অভিজ্ঞতা হিসেবে হাজির হয়।

৩ মার্চ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভের জন্য কী করতে হবে, মুজিব তাঁর রূপরেখা পেশ করলেন। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকেই তিনি একটি বিষয়ে কথা বলছিলেন। এবার তিনি সেটার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিলেন (পাকিস্তান অবজারভার, ১ ও ৪ জানুয়ারি)। তিনি বললেন, বাংলাদেশের মাটিতে যাঁরা বসবাস করছেন, তাঁরা সবাই বাংলাদেশি। বিশেষ করে, যে মুসলমানেরা ভারত থেকে এখানে এসেছেন, তাঁদের বেলায় এটা বিশেষ করে সত্য, অর্থাত্ বিহারিরা। মুজিব এই মুসলমানদের বারবার উত্সাহিত করেছেন, যাতে তাঁরা এই মাটির মানুষ হয়ে বাংলাদেশের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হন। বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক ধারণায় মাটি একটা ক্ষমতায় ঠাসা জিনিস (থর্প, ১৯৭৯)। মুজিব ও তাঁর সামনের অন্য রাজনীতিকদের কাছে এই মাটির স্পর্শ ও তার খাদ্য গ্রহণই এই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভের জন্য যথেষ্ট। মুজিব জোর দিয়ে বললেন, এই মাটির নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আছে, তার জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ উপায়ে সকল ভিন্নতার অবসান ঘটাতে হবে। এরপর মুজিব চেষ্টা করলেন, সেনাবাহিনীর হাতে যে বাঙালিরা একের পর এক মারা পড়ছেন, শ্রোতাদের মনোযোগ সে দিকে নেওয়ার। জনতার ওপর সেনাবাহিনীর এই গুলিবর্ষণকে তিনি গুপ্তহত্যা আখ্যা দিলেন। কেউই নিরাপদ নয়, যে কেউ ওই লাখো শহীদের কাতারে চলে যেতে পারে। সাইক্লোনের হুমকি এখনো দূর হয়নি। এই বক্তৃতায় তিনি মাটি ও শাহাদাতবরণের আদর্শিক প্রতীকের যে সমন্বয় ঘটালেন, তার তাত্ক্ষণিক প্রভাব টের পাওয়া গেল। আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের পাহারাদারির কারণে এটা আরও সহজ হয়। এরপর মুজিব বিহারিদের ওপর সহিংসতা কমাতে যথেষ্ট সক্ষম হলে ৫ মার্চ থেকে রাতের বেলা কারফিউ তুলে নেওয়া হয়।

৩ মার্চের সমাবেশে মুজিব দ্বিতীয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেন। তিনি ঘোষণা করেন, বাংলাদেশজুড়ে যেভাবে মানুষের প্রতিরোধের আকাঙ্ক্ষা দেখা গেছে, তাতে পশ্চিম পাকিস্তান ও বিশ্বাবাসীর কাছে এটা স্পষ্ট হওয়া উচিত, বাংলাদেশিদের আর দাবিয়ে রাখা যাবে না (রহমান, ১৯৭২: ৮০)। এরপর মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সামরিক আইন প্রত্যাহার ও জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে কার্যকর ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে। মুজিব সবাইকে কাজ বন্ধ করার আহ্বান জানালেন। কিন্তু বিশেষভাবে ঢাকার আমলাতন্ত্র অচল করে দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। এই আহ্বানে সবাই সাড়া দেন। সব কার্যালয় ও শিল্প বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় সবার ছুটি হয়ে যায়। কিন্তু এটা অন্যান্য ছুটির মতো নয়, যখন মানুষ গ্রামের বাড়িতে ছোটে।

৭ মার্চ মুজিব রমনার রেসকোর্সে আবারও এক বিশাল সমাবেশে বক্তৃতা দেন। শহীদদের রক্তের নামে মুজিব ঘোষণা করেন, সেনাবাহিনী ব্যারাকে না ফেরা পর্যন্ত এবং গুলিবর্ষণের ঘটনার তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত এই অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চলবে। সামরিক আইন প্রত্যাহার ও জনগণের প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত অধিবেশন বসবে না। এই সমাবেশের পর ঢাকার আকাশে-বাতাসে একধরনের আনন্দ৭ বইতে শুরু করে। মুজিব সহিংসতার রাশ টেনে ধরেন। অন্যদিকে তিনি আমলাতন্ত্র অচল করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে সেনা সরকারকে ভালো রকম হুমকিই দেন। শহরের মানুষের মধ্যে ক্রমেই এ ধারণা ছড়িয়ে পড়ে যে দেশের নিয়ন্ত্রণ কার্যত বাংলাদেশিদের হাতেই। মার্চ মাসটা সত্যিই ছিল এক অসাধারণ ও বিশেষ সময়। বাংলাদেশিরা বিশ্বাস করতে শুরু করে, সবকিছুই করা সম্ভব। আর পাকিস্তানের জায়গায় নতুন এক নিখুঁত ব্যবস্থা গড়ে উঠতে যাচ্ছে। মুজিব নিজ আদর্শের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পুনরায় জোর দিয়ে মার্চের প্রথম সপ্তাহে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেন। আরও আরও শহীদের রক্তে মাটি ভিজতে থাকায় দেশ নিজেই হুমকির মুখে পড়ে যায়। ছয় দফার ভিত্তিতে যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল, সেটা স্রেফ মুক্ত দেশের মুক্ত নাগরিকের অধিকারে পরিণত হলো। আর মুজিব যে কাজের মধ্যে নানা সময় বিরতি দিতেন, সেটা ছয় দফার চেয়ে আরও সুনির্দিষ্ট ও তাত্ক্ষণিক হলো।

মার্চের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য মুজিবের ওপর ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করা হলো। অনেকেই আশা করেছিলেন, মুজিব মার্চের জনসভায় ওই ঘোষণা দেবেন। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও মুক্ত দেশে মুক্ত নাগরিকত্বের যে আহ্বান তিনি জানালেন, ছয় দফার চেয়ে তা অনেকটা স্বাধীনতার কাছাকাছিই ছিল। ১৫ মার্চের মধ্যে অসহযোগ আন্দোলনের ওপর মুজিবের দৃঢ় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, যার কারণে আমলাতন্ত্র ও ব্যবসা-বাণিজ্য একরকম স্থবির হয়ে পড়েছিল। ১৫ মার্চ তিনি বাংলাদেশের প্রশাসনিক কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার যে বিবৃতি দেন, তাতে আন্দোলন আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। তিনি এমন কিছু নির্দেশনা দেন, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের সরকারের ওপর তাঁর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুজিব ঘোষণা করেন, তিনি এ পদক্ষেপ নিচ্ছেন এই কারণে, যাতে বাংলাদেশের মানুষ মুক্ত ভূমিতে মুক্ত নাগরিক হতে পারে। তিনি ঘোষণা দেন, বাংলাদেশিদের পরাজিত করা যাবে না, কারণ এ দেশের প্রতিটি মানুষ এই লক্ষ্যের জন্য প্রাণ দিতে পারে (রহমান, ১৯৭২: ১০৫-১১)। মনে হচ্ছিল, মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে চাচ্ছিলেন। সামরিক সরকারের কর্তৃপক্ষ তখন পর্যন্ত কোনো স্তরে হস্তক্ষেপ করেনি, আর মুজিব একের পর এক সতর্ক পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছিলেন।

এর মধ্যে ইয়াহিয়া খান মুজিবের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য ১৫ মার্চ ঢাকা এলেন। সংবাদপত্রগুলো এমনভাবে এর প্রতিবেদন করছিল, যাতে তা বাংলাদেশের জন্য অনুকূল হয়। ২১ মার্চ ভুট্টোও ঢাকায় এলেন। তখন শোনা যাচ্ছিল, একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হতে পারে (পাকিস্তান অবজারভার, ২১ মার্চ)। ২৩ মার্চ মনে হলো, মুজিব ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর কাছ থেকে সব দাবি আদায় করে নিয়েছেন। এই দিনটি তাত্পর্যময় ছিল। কারণ, সেদিন ছিল পাকিস্তান দিবস। সেদিন ছিল সরকারি ছুটি। ১৯৪০ সালের এই দিনে লাহোর প্রস্তাব পেশ করা হয়, যার ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়। মুজিব দাবি করলেন, ২১ মার্চ হচ্ছে লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন দিবস। কারণ, মূল লাহোর প্রস্তাবটি ছিল ছয় দফা দাবির ভিত্তি (রহমান, ১৯৭২: ১২৫-৮)। ঢাকার ছাত্র সংগঠনগুলো এ দিনটিকে প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করল। তারা সব সরকারি ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের আহ্বান জানাল। ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের ওই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে এই পতাকা দেখা গিয়েছিল, আওয়ামী লীগের ৭ মার্চের জনসভায়ও এটা দেখা গেছে। লাহোর প্রতিরোধ দিবসে ঢাকার প্রতিটি ভবনে এই পতাকা ওড়ানো হয়েছে। তবে স্বাভাবিকভাবেই, গভর্নর হাউস, সেনানিবাস ও প্রেসিডেন্ট হাউসে পাকিস্তানের চাঁদ-তারাখচিত পতাকা ওড়ানো হয়েছে। ঢাকার প্রতিটি যানবাহনে এই পতাকা লাগানো হয়েছিল। মানুষ জামার ওপর ছোট লাল, সবুজ ও স্বর্ণালি পতাকা পরেছে। বাংলাদেশি ‘সমাজ’ যেন তখন শিখরে উঠে গেছে। মানুষ অনুভব করছিল, তাদের আন্দোলন সফল হয়েছে, যদিও তারা আসলে কী অর্জন করেছে এটা তখনো পরিষ্কার নয়।

২৩ মার্চ আসলে ছিল উদ্যাপনের দিন। সেদিন মুজিবের আদর্শের প্রতীকী ছাঁচ সুস্পষ্টভাবে প্রদর্শিত হয় ওই লাল-সবুজের পতাকার মধ্য দিয়ে, যেটা পাকিস্তানের চাঁদ-তারাখচিত পতাকার জায়গায় ঢাকার আকাশে শোভা পাচ্ছিল। এই পতাকা ব্যতিক্রমীভাবে মুজিবের আদর্শের এক বহুস্বরিক প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশি হওয়ার অবধারণ বোধ ও শারীরবৃত্তীয় (টার্নার, ১৯৬৯: ৯-১০) দিক উভয়ই ছিল। পতাকার রঙের মধ্যেও দেশের নানা বৈশিষ্ট্য আছে, যেমন সবুজ হচ্ছে উর্বর মাঠের প্রতীক, লাল হচ্ছে উষ্ণতা-বিকিরণকারী সূর্যের প্রতীক আর সোনালি পাকা ধানের। এই চিত্রকল্পেও অনেকটাই কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানে পাওয়া যায়। একই সঙ্গে, এই রঙের সঙ্গে বাংলাদেশি হওয়ার শারীরবৃত্তীয় যোগ আছে। সবুজ হচ্ছে জীবনের প্রতীক, যেটা জীবনের অন্যান্য রঙের সঙ্গে সম্পর্কিত। লাল তো রক্তের প্রতীক। এখানে তা বিশেষভাবে শহীদের রক্ত। শারীরবৃত্তীয়ভাবে সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সোনালি রঙে দেশের রূপরেখা কল্পনা করা। সাধারণভাবে ‘সোনা’ নারীর যৌনাঙ্গের সুভাষণ হিসেবে ব্যবহূত হয়। বাংলাজুড়ে ‘দেশ’ একদম নির্ভুলভাবে নারী হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু নারীত্ব কদাচিত্ পরিষ্কারভাবে প্রদর্শিত হয়। শহীদের রক্ত জীবন সৃষ্টি করেছে, আর এই রক্তে স্নাত হয়েই জন্ম নিয়েছেন বাংলাদেশের নাগরিকগণ। শহীদেরা তাঁদের পিতা, আর দেশ মা। আর নিশ্চিতভাবে সূর্যের কিরণ মাটিতে পড়ে সোনালি ধান উত্পাদন করেছে।

বাংলাদেশের পতাকার প্রতীকী তাত্পর্য

            মান-নির্ধারক               আকাঙ্ক্ষা-সংক্রান্ত

            মাটি=সবুজ                   সোনা=মাতৃভূমি

                        সূর্য=লাল=শহীদ

            ধান=সোনা                   সবুজ=জীবন

কথা হচ্ছে, পতাকার প্রতীকী তাত্পর্যের সচেতন মান নির্ধারক অংশের সঙ্গে এর মূলত অসচেতন প্রতীকী তাত্পর্যের মিশ্রণের ফলে তা বাংলাদেশি সত্তার শক্তিশালী মূর্ত রূপ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। ২৩ মার্চ যাঁরা পতাকা উড়িয়েছিলেন ও গায়ে জড়িয়েছিলেন, তাঁরা মুক্ত স্বদেশে মুক্ত নাগরিক হিসেবে বাঁচতে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। অথবা এই বাস্তবতা সৃষ্টি করতে বুকের রক্ত ঢেলে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তাঁদের বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি।

ধর্মীয় আচার বা প্রথাগত অনুষ্ঠানে যেমন ‘ভ্রাতৃত্বের শক্তিশালী অনুভূতির’ একটা জায়গায় এসে থামতে হয়, তেমনি মার্চের এই ক্রান্তিকালীন অভিজ্ঞতারও একটা সমাপ্তি থাকে। তা ছাড়া পাকিস্তানের সামাজিক গড়নের সাধারণ ধরনের পুনঃ আবির্ভাব ঘটেনি। এদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবকে হঠাত্ পুনরায় গ্রেপ্তার করে এই ‘শক্তিশালী ভ্রাতৃত্ববোধের’ অবসান ঘটায়। তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। ছাত্র, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ অভিযান চালানো হয়। বিশেষ করে, ঢাকার হিন্দু অধিবাসীরা সন্দেহের তালিকায় ছিলেন। তাঁদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল, ইয়াহিয়া খান যেমন ১৯৬৯ সালে সামরিক আইন পুনরায় জারি করে হঠাত্ই গণ-আন্দোলন থামিয়ে দিয়েছিলেন, এবারো তিনি সেভাবেই তা থামিয়ে দেবেন। কিন্তু এবার মুজিবের জনপ্রিয় বাংলাদেশ আদর্শের জের দীর্ঘস্থায়ী হয়, মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দীর্ঘ প্রতিরোধ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়।

মুজিব দেশ প্রতীকের মধ্যে সফলভাবে বাংলাদেশিদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ধারণ করেছিলেন, যেটা লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি মানুষকে সাধারণ ও আধা বাস্তব কর্মসূচিও দিয়েছিলেন। প্রথমত, পাকিস্তানের মধ্যে ছয় দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয়ত, মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মার্চের মানুষের মধ্যে যে অভিন্ন ‘ভ্রাতৃত্ববোধ’ গড়ে ওঠে, তাতে পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বাঙালিদের লড়াই করার সংকল্প আরও তীব্র হয়। মার্চের শেষ নাগাদ বাংলাদেশিদের মধ্যে অভিন্নপরিচয় ও লক্ষ্যের বোধটা একদম চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে। ওদিকে মুজিব বারবার দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাতে থাকেন, বাংলাদেশের সম্মান ও অখণ্ডতা রক্ষা করতে প্রয়োজনে আরও ১০ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হবে। ২৫ মার্চ রাতে সেনা অভিযানে সেই শহীদের তালিকা প্রস্তুত হতে শুরু করে। পুলিশ সদস্য, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ও সেনাবাহিনীর কিছু বাঙালি ইউনিট সীমিত আকারে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে। তাঁদের অনেকেই শহীদ হন। তবে মুজিব যে সবকিছু বাজি রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা গেল, ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতালাভের আগ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীতে যোদ্ধার সংখ্যা বাড়তেই থাকে।

উপসংহার

আমরা এখানে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করলাম, তাতে আদর্শ একধরনের প্রতীকী ব্যবস্থা। এটা সামাজিকব্যবস্থার একটা ছকবদ্ধ রূপ তৈরি করে, যার কারণে স্বায়ত্তশাসনের (মানুষের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন) রাজনীতি সম্ভব হয়ে ওঠে। আদর্শ থেকে একধরনের কর্তৃত্বপরায়ণ ধারণা সৃষ্টি হয়, যার কারণে রাজনীতি করা সম্ভব হয়ে ওঠে। আদর্শ নৈতিক চিত্রকল্প তৈরি করে, যার বদৌলতে রাজনৈতিক কার্যক্রমের লক্ষ্য ও প্রক্রিয়াকে কাণ্ডজ্ঞানে বোঝা যায়, তাকে রূপ দেওয়া যায়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপের মুখে আদর্শ নির্মাণ হয়। এটা সেখানেই গড়ে ওঠে, যেখানে মানবীয় আচরণের গৃহীত ও প্রথাগত ছক আর কোনোভাবে প্রযোজ্য হয় না (গার্টজ, ১৯৭৩: ২১৮-৯)।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সেই ঐতিহ্যবাহী ধারা, অর্থাত্ ব্যক্তি মালিক সম্মতিভিত্তিক সমাজে সমমনা মালিকদের সঙ্গে বাস করছে ও আদমের প্রতি আল্লাহর মাটি চাষ করার নির্দেশ মেনে চলছে, অভিজাতকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে কখনোই প্রযোজ্য ছিল না। দেশভাগের আগে ও পরে কখনোই এটা ছিল না। এই গোষ্ঠীটি গ্রামের ঐতিহ্যবাহী ধারা ও আধুনিক সমাজের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারার মধ্যে আটকে পড়েছিল (ডুমন্ট, ১৯৭০: ৩১-২)। প্রথাগত গ্রামীণ সমাজে মুসলিম মূল্যবোধ অন্য সব বিবেচনার ঊর্ধ্বে। তার ভিত্তিতেই সামাজিক বিন্যাস হয়ে থাকে। কিন্তু আধুনিক সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে মানুষ নিজের মতো করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শৈল্পিক কার্যক্রম করে থাকে। আধুনিকতার প্রবক্তারা অনেক কষ্ট করে আদর্শ সৃষ্টি করেছেন। এই আদর্শ তাঁদের উক্ত ক্ষেত্রে স্বাধীন তত্পরতা চালানোর ভিত্তি নির্মাণ করে। কিন্তু এখানে হলো কি, এই আদর্শকে আবার গ্রামে বসবাসরত সিংহভাগ ঐতিহ্যবাহী মানুষকে স্পর্শ করতে হতো, যাদের এখন ভোটার বলা হচ্ছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির এই জনপ্রিয় ভোটের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আর সেটা পেতে হলে তাদের স্বীয় কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা দিতে হতো, যেটা একদিকে সুপ্রতিষ্ঠিত আধুনিক সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে, তেমনি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইস্যুভিত্তিক রাজনীতিতেও তাকে অর্থবহ হতে হতো।

শেখ মুজিবুর রহমান যে অবিভক্ত পাকিস্তানের শেষ দিনগুলোতে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের প্রতীকীব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, এই পত্রে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মুজিব যে বাস্তবতার সামনে পড়েছিলেন, তার আলোকে তিনি ইসলামের অনুপ্রেরণায় একটি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তাঁর এই আদর্শ দেশভাগের আদর্শের মতো ছিল না, যেটা খোলাখুলিভাবে ধর্মভিত্তিক ছিল। মুজিব শক্তিশালী মুসলিম ধারণাগুলো ধারণ করলেন ইসলামের নাম না নিয়েই। এতে কাজ হলো। কারণ, তিনি এটি দিয়ে আধুনিক ও নাগরিক অভিজাতদের সঙ্গে গ্রামের প্রথাগত মানুষদেরও এক কাতারে আনলেন। আর এই আদর্শকে সংহত করার ক্ষেত্রে লাখ লাখ শহীদের উেপ্রক্ষাটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে, যার মধ্যে নানা অসদৃশ্য অর্থের সমন্বয় ঘটেছিল। আবার এই বিসদৃশ অর্থের আন্তসম্পর্কের মধ্য দিয়েই চূড়ান্ত প্রতীকের প্রকাশ ক্ষমতা ও অলংকারবহুলতার শক্তি গড়ে ওঠে (গার্টজ, ১৯৭৩: ২১৩)। এই প্রতীক মানুষের মধ্যে এক শক্তিশালী বোধ গড়ে ওঠে। সেটা হলো, মুসলমান পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে বাংলাদেশিদের মারা পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। লাখ লাখ শহীদ—চিত্রকল্প হিসেবে এটি যথেষ্ট বোধগম্য, যার কারণে মুজিব বাংলাদেশের মুখপাত্রের কর্তৃত্ব পেয়ে যান। এই শহীদদের কেন্দ্র করে মুজিব অন্যান্য যে চিত্রকল্প সৃষ্টি করেন, তার কারণে যাঁরা এটি ব্যবহার করেছেন, তাঁরা জনসমক্ষে ও যথোচিতভাবে এই শহীদদের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন। শেষমেশ পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই শহীদের কাতারে আরও অসংখ্য মানুষকে যুক্ত করে।

বাংলাদেশের জন্মের জন্য মুজিব যৌক্তিক ও শক্তিশালী এক শক্তিশালী আদর্শ নির্মাণ করেন। তা সত্ত্বেও এই আদর্শ ছিল সীমিত ও সুনির্দিষ্ট। এটা ক্রান্তিকালের মুসলিম প্রতীকগুচ্ছের এক জটিল সমন্বয়। আমরা যে ঐতিহাসিক কালের প্রসঙ্গে এখানে আলোচনা করলাম, সেখানে এটা কাজ করেছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এটি নিজস্ব রাজনৈতিক ধারা নির্মাণ করতে পারেনি। এই আদর্শ কিছু দ্বান্দ্বিক প্রতীকের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল, যার কার্যকারিতার জন্য বহিঃস্থ অন্যায্য কর্তৃপক্ষের উপস্থিতি দরকার ছিল। কিন্তু সেই শক্তিটি তিরোহিত হলে সংকটেরও অবসান ঘটে। কথা হচ্ছে, স্বাধীনতাযুদ্ধে আরও ১০ লাখ মানুষ মারা গিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী একবার আত্মসমর্পণ করলে আর কোনো বাংলাদেশির শহীদ হওয়ার সুযোগ থাকে না। জীবনের ওপর হুমকিস্বরূপ যে সংকট ছিল, তা-ও শেষ হয়ে যায়। দেখা যায়, মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের ‘চার স্তম্ভ’ (জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র) ঘোষণার পর এই শহীদের উপমা খুব কমই ব্যবহার করেছেন। যদিও তিনি এটাকে ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের (বিশ্বাস, নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ) সঙ্গে তুলনা করে গ্রামীণ ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি মানুষের আবেগকে জাতি গঠনের কাজে ব্যবহার করতে পারলেন না। যদিও তিনি আগে লাখো শহীদের উপমা ব্যবহার করে জনপ্রিয় আবেগকে স্বাধীনতাকামী তত্পরতায় রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন।

আদর্শ প্রথাগত প্রতীকের মতো নয়। প্রথাগত প্রতীক মানুষের মধ্যে এক পূর্ণাঙ্গতা ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থার অনুভূতি তৈরি করে। কিন্তু আদর্শ এর ধারকদের মধ্যে ক্ষণস্থায়ী ও পরিস্থিতি-নির্দিষ্ট ব্যবস্থার বোধ তৈরি করে। আধুনিক ও ব্যক্তিবাদী বিশ্বের মানুষেরা মনে করে, প্রতিটি জগতের জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা হবে। কোনো ব্যবস্থায় কিছু অসম্পূূর্ণতা থাকলে বা কোনো কিছুর ঘাটতি থাকলে তারা সামাজিক মানদণ্ডের বিভিন্ন মাত্রার অনুপস্থিতি বোধ করে। বাস্তবে আধুনিক মানুষ ক্রমপরিবর্তনশীল জীবনে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হিমশিম খায়। আর রাজনীতির নিজস্ব জগতে এর অর্থ হলো, আদর্শকে সব সময় সংশোধন ও বদলাতে হয়। পাকিস্তানের পরিপ্রেক্ষিতে মুজিব খুবই শক্তিশালী একগুচ্ছ শৃঙ্খলা-উত্পাদনকারী প্রতীক তৈরি করেন। তবে বাংলাদেশ একবার পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হলে তিনি এমন কোনো শক্তিশালী ধারণা ও বোধগম্য চিত্রকল্প তৈরি করতে পারেননি, যা শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে, যেটা তাঁর আগের আদর্শে ছিল। তাঁর ব্যর্থতা বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আর তাঁর পরিবার ও নিজের জন্য বিয়োগান্ত।

তথ্যসূত্র ও টীকা

১. পাকিস্তান অবজারভার এবং ডন পত্রিকাতে এই ঘটনাগুলো এবং এই ঘটনাগুলোর প্রতি মুজিবের প্রতিক্রিয়া বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়। মাঝেমধ্যে এগুলোতে অনিশ্চিত পরিস্থিতির কথা উঠে আসত। তবে এখানে ক্রমবর্ধমানভাবে ক্ষুব্ধ জনপরিস্থিতির (public atmosphere) যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং উল্লিখিত ঘটনাগুলোর পর্যবেক্ষণনির্ভর। ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার প্রতিনিয়ত যোগাযোগ ছিল, যদিও আমি তাদের প্রেষণাকে ধারণ করতাম না।

২. আওয়ামী লীগের প্রচারণার পোস্টারগুলোতে (সেনগুপ্ত, ১৯৭৪:৮০) নিচের তুলনাগুলো উপস্থাপন করা হয়:

            বৈষম্যের ক্ষেত্রসমূহ       বাংলাদেশ         পশ্চিম পাকিস্তান

            রাজস্ব ব্যয়       ১,৫০০ কোটি রুপি        ৫,০০০ কোটি রুপি

            উন্নয়ন ব্যয়      ৩,০০০ কোটি রুপি        ৬,০০০ কোটি রুপি

            বৈদেশিক সহায়তা        ২০%     ৮০%

            আমদানি          ২৫%     ৭৫%

            কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি           ১৫%     ৮৫%

            সামরিক বাহিনীতে চাকরি       ১০%     ৯০%

            প্রতি মণ চাল    ৫০ রুপি            ২৫ রুপি

            প্রতি মণ আটা  ৩০ রুপি           ১৫ রুপি

            প্রতি সের সরিষার তেল            ৫ রুপি  ২.৫ রুপি

            প্রতি তোলা স্বর্ণ ১৭০ রুপি         ১৩৫ রুপি

৩. যাঁরা ১৯৬২, ১৯৬৬ এবং ১৯৬৮-৬৯-এর বিক্ষোভের সময় শহীদ হন (মনিরুজ্জামান, ১৯৮০: ২৪, ৬০-৬৬)।

৪. অন্য রাজনীতিবিদেরা উপমা (metaphor) ব্যবহার করলেও, সেগুলো ততটা গুরুত্ব লাভ করেনি। সাইক্লোনের ত্রাণ বিতরণ অবস্থার সমালোচনা করতে গিয়ে ভাসানী ‘একটি স্বায়ত্তশাসিত এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ’ দাবি করেছিলেন (পাকিস্তান অবজারভার, ৫ ডিসেম্বর)। তাঁর উপমার এই ব্যবহার খুব কম মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল এবং পরে মানুষ তা ভুলেও যায়।

৫. এখানে আলোচিত অভূতপূর্ব ঘটনাগুলোর অভিজ্ঞতা অর্জন এবং পরে তা বিশ্লেষণ করার সুযোগ খুব অল্পসংখ্যক সমাজ বিজ্ঞানীই পান। দুজন লেখক ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সে সংঘটিত শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের কথা আলোচনা করেছেন (টার্কল, ১৯৭৫: ৬৮-১০০; জলবার্গ, ১৯৭২: ১৮৩-২০৪)। দুজনের মতেই ওই সময়কার সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতি বিশেষ ধরনের ছিল এবং তা ঘটনাপ্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তবে, এ রকমটা কেন ঘটে, তা সমাজ বিজ্ঞানীরা বেশ জড়তার সঙ্গেই ব্যাখ্যা করেন এবং অধিকাংশই আচরণের এই বিষয়টি এড়িয়ে যান। ফলে ক্ষণস্থায়ী কিন্তু খুব প্রভাবশালী বড় মাত্রার জনঘটনাগুলোর (public occurrences) একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন শুরু করার জন্য টার্নারের করা ধর্মীয় আচরণের বিশ্লেষণ একটি যথাযথ ক্ষেত্র। মার্চ মাসের ঘটনাগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের অভিজ্ঞতাগুলোকে নতুন কিছুর দিকে যাত্রা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। এই পর্যবেক্ষকের কাছে, জ্ঞাতিসুলভ মনোভাব (fellow-feeling), টার্নারের কাছে যা ‘কমিউনিটাস’, ঢাকাতে বেশ প্রগাঢ় ছিল। এটি কোনো ব্যক্তি যেকোনো ধর্মীয় আচরণের অভিজ্ঞতা যেভাবে অর্জন করেন বা সেখানে একজন অংশগ্রহণকারী পর্যবেক্ষক হিসেবে তিনি যে অনুভূতি পোষণ করেন, ঢাকায় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মনোভাব তেমনটিই ছিল। সাইক্লোন-পরবর্তী ঘটনাগুলোর আচরণগত প্রবণতা সম্পূর্ণ ধারণাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রায়োগিক অংশ, যা অন্ততপক্ষে একবার হলেও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা প্রয়োজন।

৬. আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে শিক্ষার্থীদের ১১ দফা আন্দোলনের সময় প্রথম এই পতাকা তৈরি করা হয়। আওয়ামী লীগের সমান্তরালে শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম চলতে থাকে। মুজিব এই আন্দোলনের সুবিধা গ্রহণ করেন এবং এটিকে নির্দেশনা দিয়ে সহায়তা দেন; একই সঙ্গে তিনি এই আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিতও হন (মনিরুজ্জামান, ১৯৮০: ৫২-৬৮)। এই মিছিল যখন হয়, তত দিনে এই স্বেচ্ছাসেবকেরা একটি আধা সামরিক সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। তাদের নিজস্ব পরিচয় চিহ্নও ছিল: ছয়টি সাদা তারকাচিহ্নিত সবুজ ক্যাপ।

৭. এখানে ‘আনন্দ’ (euphoria) শব্দটি জিল্লুর খানের (১৯৭৪) পরামর্শে ব্যবহার করা হয়েছে। এর দ্বারা এই সময়ের ইতিবাচক উত্তেজনা এবং একই সঙ্গে তীব্র সন্দেহের সঙ্গে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য মানুষের অপেক্ষাকে নির্দেশ করা হয়েছে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

গ্রন্থপঞ্জি:

                Brass, Paul, ‘Draft Statement for South Asian Political Economy III Project’, paper prepared for Social Science Research Council Conference on Order and Anomie in South Asian Society and Culture, New Delhi, 28-30 December 1982.

                Dumont, Louis, ‘Religion, Politics, and Society in the Individualistic Universe’, Proceedings of the Royal Anthropological Institute, 1970, pp. 31-41.

                Geertz, Clifford, The Interpretation of Cultures (New York,1973).

                Greenough, Paul, ‘The Death of Chittaranjan Das’, paper prepared for Social Science Research Council Conference on Order and Anomie in South Asian Society and Culture, New Delhi, 28-30 December 1982.

                Hughes, Thomas P., Dictionary of Islam (New Delhi, 1976).

                Jahan, Rounaq, 1972a, ‘East Pakistan during the Decade of Ayub’, in P. Bertocci (ed.), Prelude to Crisis: Bengal and Bengal Studies in 1970 (East Lansing, 1972), pp.1-28.

                ---1972b, Pakistan: Failure in National Integration (New York, 1972).

                Khan, Muin-ud Din Ahmed, The History of the Fara’idi Movement in Bengal (1818-1906) (Karachi, 1965).

                Khan, Zilur R., personal communication, 1974.

                Madan, T.N., ‘The Dialectic of Ethnic and National Boundaries in the Evolution of Bangladesh’, in S. Navlakha (ed.), Studies of South Asian Social Development, No.2 (Delhi, 1974), pp.158-83.

                Maniruzzaman, Talukder, The Bangladesh Revolution and its Aftermath (Dacca, 1980).

                Group Interests and Political Changes: Studies of Pakistan and Bangladesh (New Delhi, 1982).

                Mullins, W.A., ‘On the Concept of Ideology in Political Science’, American Political Science Review 66, 1972, pp. 498-510.

                Rahman, Sheikh Mujibur, Bangladesh, My Bangladesh: Selected Essays and Statements, 28 October 1970 to 26 March 1971, edited by Ramendu Majumdar (New Delhi 1972).

                Sengupta, Jyoti, Bangladesh in Blood and Tears (Calcutta, 1981).

                Thorp, John P., ‘Master of Earth: Conceptions of "Power" among Muslims of Rural Bangladesh’, PhD thesis, University of Chicago, 1978.

                ---‘Bengali Muslims and the Symbolism of Earth: A Geertzian Analysis’, in J. Morgan (ed.), Understanding Religion and Culture: Anthropological Perspectives (Washington, D.C., 1979).

                Turkle, Sherry R., ‘Symbol and Festival in the French Student Uprising (May-June 1968)’, in Sally Moore and Barbara Myerhoff (eds.), Symbol and Politics in Communal Ideology (Ithaca, 1975), pp. 68-100.

                Turner, Victor, ‘Forms of Symbolic Action’, in Victor Turner (ed.), Forms of Symbolic Action (Seattle, 1969), pp. 3-25.

                ---The Ritual Process (Ithaca, 1967).

                Zolberg, Aristide, ‘Moments of Madness’, in Politics and Society, Winter 1972, pp. 183-207.