ব্যাংকিং নৈতিকতা

 [নুরুল মতিন ছিলেন বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের একজন অন্যতম পথিকৃত্। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদকে অলংকৃত করেছেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) তিনি অন্যতম একজন প্রতিষ্ঠাতা। প্রথিতযশা রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ অমিয় কুমার বাগচি ২০১৪ সালে এই নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতাটি প্রদান করেন। সামগ্রিক মার্ক্সীয় ও বাম কেইনেসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অর্থনৈতিক ইতিহাসসহ ব্যাংকিং ও অর্থায়নের ইতিহাস, শিল্পায়ন ও অ-শিল্পায়নের অর্থনীতি এবং উন্নয়ন অধ্যয়ন বিষয়ে বাগচির রয়েছে বিশেষ অবদান। সাম্রাজ্যবাদ ও অনুন্নয়ন তত্ত্বের জন্য তিনি ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বিশ্বের অনেক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়ান। বেশ কিছু প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি ছাড়াও অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেছেন।— সম্পাদক]

শুরুতেই ১৪তম নুরুল মতিন মেমোরিয়াল লেকচার দেওয়ার সুযোগ দিয়ে আমাকে সম্মানিত করার জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম), এবং বিশেষভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান ও বিআইবিএমের ডিরেক্টর জেনারেল ড. তউফিক আহমেদ চৌধুরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। মাত্র ৫০ বছর বয়সে অকালপ্রয়াত নুরুল মতিনকে আমার যেভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে, সব বিচারেই তিনি ছিলেন একজন অসাধারণভাবে নিষ্ঠাবান ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। নবগঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নৈতিক ব্যাংকিং কার্যক্রম নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিধিমালা ও প্রক্রিয়ার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ক্ষেত্রে তিনি খুবই তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এটাই সংগত হয়েছে যে তাঁর স্মরণে অনুষ্ঠিত বক্তৃতা দিয়েছেন বাংলাদেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধান বিচারপতিরা, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক উচ্চপদস্থ উপদেষ্টা কিংবা বাংলাদেশ ও ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের কেউ—যাঁদের একজনকে পড়ানোর সৌভাগ্য আমার হয়েছে, কিংবা পেশাদার অর্থনীতিবিদেরা, যাঁদের মধ্যে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান, সনত্কুমার সাহা এবং ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে বন্ধু হিসেবে জানার সৌভাগ্য হয়েছে। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম আমার কলেজ প্রেসিডেন্সি কলেজের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী। আমি খুবই আনন্দিত যে প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি এই অনুষ্ঠানকে আলোকিত করতে সম্মত হয়েছেন।

কৃষি অর্থনীতিতে নৈতিক ব্যাংকিং

ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিনিময় প্রথার মতোই প্রাচীন। দক্ষিণ এশিয়ার জাতক কাহিনিগুলোতে প্রায়ই শ্রেষ্ঠীদের প্রধান চরিত্র হিসেবে দেখা যায়। তাঁদের অনেকেই ছিলেন প্রচুর সম্পদশালী। কিন্তু তাঁদের কাছে যেটাকে ন্যায্য উপলক্ষ মনে হতো, সে জন্য তাঁরা তাঁদের সম্পদ ব্যয় করতে প্রস্তুত ছিলেন। যেমন শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডক গৌতম বুদ্ধের বসবাসের জন্য পুরো বাগান স্বর্ণে পরিপূর্ণ ধরে নিয়ে সেই মূল্যে বাগান (জেতাবন) কিনেছিলেন।

আমাদের কালের আরও নিকটবর্তী, যেমন মোগল ভারতে, এবং বাহাদুর শাহ ও ১৭৯৯ সালে ব্রিটিশরা তাদের সবচেয়ে জাঁদরেল শত্রু টিপু সুলতানকে পরাজিত ও হত্যা করার মাঝামাঝি সময়ে মোগল-উত্তরকালে অনেক ধনী ব্যাংকার ছিলেন। এমনকি পরেও ব্রিটিশ কর্তৃত্বাধীন অনেক নেটিভ স্টেটে ভারতীয় ব্যাংকাররা তাঁদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিলেন।

বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে এই ভারতীয় ব্যাংকারদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করলে সুবিধাজনক হবে। শীর্ষস্তরে ছিলেন যাঁরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাষ্ট্রকে সেবা প্রদান করতেন। যেমন ফতেহ চাঁদ ও জগত্ শেঠ, যাঁদের পরিবার বাংলার নবাবদের ব্যাংকারে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তী স্তরে ছিলেন এমন ব্যাংকাররা, যাঁরা নবাব বা সুবাদারদের ঋণ দিতেন এবং কোনো একটা অঞ্চলের মালিকানার দাবিদার জমিদাররা, যাঁরা নবাব বা সুবাদারদের রাজস্ব পরিশোধের জন্য দায়ী থাকতেন। তৃতীয় স্তরে ছিলেন সেসব মহাজন, যাঁরা জমির প্রকৃত চাষিদের অর্থঋণ দিতেন। ব্রিটিশরা জমিসংক্রান্ত বিভিন্ন অধিকারকে (যেমন সরকারি কোষাগারে ভূমিকর পরিশোধের অধিকার) সম্পূর্ণভাবে বিপণনযোগ্য১ করে তোলার আগে ব্যাংকার, মহাজন, জমিদার কিংবা কৃষকেরা একটা পারস্পরিক সহনশীলতার নীতি মেনে চলতেন। শুধু সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবেই ঋণ প্রদানে অক্ষমতার ফলে জমিদারি হাতবদল হতো কিংবা ঋণগ্রস্ত কৃষকেরা খুব কমই তাঁদের জমি হারাতেন (বাগচি ২০০২, পৃ. ২৫-২৬)। তা ছাড়া, ভারতের বিভিন্ন অংশে এ রকম প্রথা চালু ছিল, যেখানে ঋণদাতা কখনো আসলের দ্বিগুণ দাবি করতে পারত না (দামদুপাট নীতি) (দেখুন, ডেকান রায়টস কমিশন ১৮৭৬)। এ রকম কিছু প্রাক-ব্রিটিশ প্রথা বারোদার মতো অনেক নেটিভ স্টেটে চালু ছিল।

যখন ব্রিটিশ প্রশাসন মহাজনদের যেকোনো হারে সুদ নির্ধারণ, কৃষকের বন্ধকি জমি খালাসের অধিকারহরণ (foreclose) কিংবা জমি দখল করার (take over) অনুমোদন দিল, তখন থেকেই সারা ব্রিটিশ ভারতের কৃষকেরা তাঁদের জমির মালিকানা হারাতে শুরু করলেন কিংবা খাইখালাসি বন্ধকি (usufructuary mortgage) শর্তের বেড়াজালে পড়ে নিজেদের জমিতেই ভূমিদাসে (serf) পরিণত হতে হলো। কৃষকদের অধিকাংশই ছিল অশিক্ষিত। যেহেতু আদালতের এখতিয়ার গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে বহুদূরের শহর ও মফস্বলের আদালতে সীমাবদ্ধ রাখা হয় এবং যেহেতু বিচরকেরা শুধু ওয়াকিবহাল ও মোটামুটিভাবে স্বনির্ভর মামলাকারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই বিচার করতেন, ফলে কৃষক যে অল্প পরিমাণ অধিকার পেতেন, সে ক্ষেত্রেও তাকে মারাত্মক দুর্দশার শিকার হতে হয়। এ পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কৃষিজীবীদের কাছ থেকে অকৃষিজীবীদের কাছে জমি হস্তান্তর নিয়ন্ত্রণ করতে বোম্বে প্রেসিডেন্সি ও পাঞ্জাবে সুনির্দিষ্ট আইন চালু করতে বাধ্য হয়। ফলে সেসব প্রদেশে সমস্যা কমে এসেছে, কিন্তু কোনোভাবেই তার মূলোচ্ছেদ হয়নি। প্রথমত, ধূর্ত মহাজনেরা চাইলে বেনামি লেনদেন ব্যবহার করে কিংবা দুই ধরনের কাগজপত্র—একটা অফিশিয়াল লোকদের দেখানোর জন্য এবং অন্যটা প্রকৃত লেনদেন রেকর্ড করার জন্য—সংরক্ষণ করে আইন ফাঁকি দিতে পারতেন। দ্বিতীয় ধরনের কাগজপত্র চ্যালেঞ্জ করার মতো অবস্থান কৃষকদের ছিল না বললেই চলে।২ তা ছাড়া, বহু ধনী কৃষক নিজেরাই মহাজন হিসেবে আবির্ভূত হন এবং প্রকৃত চাষিরা ভূমিচ্যুত শ্রমিকের দলে অন্তর্ভুক্ত হতে থাকেন।

বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি এবং যুক্তপ্রদেশের আগ্রা ও অযোধ্যার মতো জমিদারি কিংবা তালুকদারি এলাকায় কৃষকদের ঋণগ্রস্ততা ও পর্যায়ক্রমে মালিকানাচ্যুতির সমস্যা বিশেষভাবে প্রকট ছিল। কর পরিশোধসংক্রান্ত বিভিন্ন পর্যায়ের অধিকার ইজারা দেওয়ার দীর্ঘ প্রক্রিয়া এসব প্রদেশে এক অবিশ্বাস্য প্রকৃতির উপসামন্ততান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়া (sub-infeudation) তৈরি করে এবং অধিকাংশ প্রকৃত চাষিকে তাঁদের চাষকৃত জমিতে কোনো ধরনের আইনি অধিকারবিহীন ভাগ-চাষির পর্যায়ে নামিয়ে আনে। বাংলায় ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের সিরিজ সংশোধনের মাধ্যমে তথাকথিত ভোগদখলকারী চাষিদের কিছু মধ্যস্বত্ব অধিকার প্রদান করা হয়, কিন্তু তাঁরা ছিলেন প্রকৃত কৃষকদের একটা ছোট্ট অংশ মাত্র। ১৯২৬ সালে শুরু হওয়া এবং ১৯৩০-এর দশকজুড়ে চলতে থাকা কৃষি বাজারের মন্দা চরম অনিশ্চিত ও আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে (সান্যাল ২০০৪)।

১৯৩৫ সালে দ্য বেঙ্গল অ্যাগ্রিকালচারাল ডেটরস অ্যাক্ট (বিএডি) পাস হয়। এর কারণ হিসেবে গোপনীয় অফিশিয়াল নথিতে বলা হয়, ‘বঙ্গদেশ বিশেষত এর উর্বর এবং আগেকার সবচেয়ে উর্বর জেলাগুলোর কৃষিজীবীরা এমনভাবে ঋণে জর্জরিত যে, তা পরিশোধ করা তাদের সামর্থ্যের বহু ঊর্ধ্বে এবং যদি প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, এর ফলাফল হবে প্রদেশের জন্য বিপর্যয়কর’ (আহসান ২০০২, পৃ. ১৭৬)।

এই আইনের বিধান অনুযায়ী, জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে (ঋণদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের বিচার করার ক্ষমতা দিয়ে) ঋণ সালিসি বোর্ড গঠন করা হয়। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের সমর্থন নিয়ে কৃষক প্রজা লীগের শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলে এই আইন আরও জোরালোভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যা-ই হোক, এসব বোর্ডের কার্যক্রম ছিল হতাশাব্যঞ্জক :

‘১৯৪৩ সাল পর্যন্ত নিষ্পত্তির জন্য বোর্ডে জমাকৃত সর্বমোট আবেদনের মাত্র ৩১% আংশিক বা সম্পূর্ণ নিষ্পত্তি হয়, ২৯% ঝুলন্ত ছিল এবং ৪০% বদলি কিংবা বাতিল করা হয়’ (আহসান ২০০২, পৃ. ১৭৭)।

ঋণ সালিসি বোর্ডের কার্যক্রম কয়েকটি সমস্যার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। প্রথমত, ময়মনসিংহের কালেক্টর যেমন পর্যবেক্ষণ করেছেন:

‘খুব কম চাষিরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উদ্বৃত্ত আয় থাকে। যদি কোনো বছর ফসল স্বাভাবিক পরিমাণের চেয়ে কম হয় কিংবা পরিবারের উপার্জনক্ষম কোনো সদস্য বছরের কোনো সময় অসুস্থ থাকে, তখন তথাকথিত উদ্বৃত্ত ঘাটতিতে পরিণত হয়। ফলে, খুব কম ঋণদাতাই বিশ্বাস করেন যে, ঋণগ্রহীতারা (ঋণ সালিসি বোর্ডের) মীমাংসার শর্তানুযায়ী ঋণ পরিশোধ করতে পারবে।’ (প্রাগুক্ত)

দ্বিতীয়ত, দুপক্ষের জন্য সম্মানজনক কোনো মীমাংসায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ঋণদাতা ও গ্রহীতা দুপক্ষকেই অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে পড়তে হতো। ১৯৪০ সালে পাসকৃত বেঙ্গল মানিলেন্ডারস অ্যাক্টের শাস্তিমূলক বিধানগুলোও অবস্থার বিশেষ তারতম্য ঘটাতে পারেনি। তৃতীয়ত, বিশেষ করে ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বাংলার মন্ত্রিসভায় মুসলিম লীগের আধিপত্য দেখা দেয়। মুসলিম লীগ নেতৃত্ব পরিচালিত হতো বড় জমিদারদের স্বার্থে, ঋণ সালিসি প্রক্রিয়ায় যাদের ন্যূনতম স্বার্থও ছিল না।

আগ্রা ও অযোধ্যা নিয়ে গঠিত যুক্ত প্রদেশের ঝাঁসির মতো কিছু কিছু জেলার সম্ভাব্য ঋণগ্রহীতা চাষি বা পশুচারণজীবীরা জমির মালিক ও মহাজনদের মধ্যকার প্রাক-ব্রিটিশ সম্পর্কের ওপর আস্থা রেখে ‘নমনীয়’ (accommodating) মহাজনদের বস্তুত নিজেদের গ্রামে বসতি স্থাপনের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন (কফ্ [Kolff] ১৯৭৯, পৃ.৬১)। যা-ই হোক, এসব নমনীয় মহাজন প্রথমে ঋণগ্রহীতাদের বিশাল অঙ্ক পর্যন্ত ঋণ অনুমোদন করেছেন এবং তারপর ব্রিটিশ ভারতীয় আইন অনুযায়ী ঋণের বদলে ঋণগ্রহীতাদের বন্ধকি সম্পত্তি খালাসের অধিকার হরণ করে তাঁদের জমি দখল করে নিয়েছেন। এভাবে ঝাঁসির মহ তহশিলে ১৮৬৫ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত ঠাকুর, আহির ও কুর্মি জমিদার, পশুচারণজীবী ও চাষিরা তাঁদের সর্বোচ্চ পরিমাণ জমি হারিয়েছেন এবং সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন মাড়োয়ারি, বেনিয়া ও কায়স্থরা (কফ্, ১৯৭৯, পৃ.৫৮, টেবিল ১১)।

দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্ দুটি অঞ্চলের দুটি কেস স্টাডি থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, যদি শোষণের কারণে কৃষকেরা নিরক্ষর ও দরিদ্র থেকে যান, যদি তাঁদের কোনো ধরনের প্রণোদনা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির—যেমন সেচ ও সার—প্রবেশাধিকার না থাকে, তাহলে ঋণের শর্ত-প্রশ্নে কোনো ধরনের সমাধানের চেষ্টাই নৈতিক ব্যাংকিংয়ের কোনো কাঠামো উপহার দিতে পারবে না।

এমনকি ঔপনিবেশিক ভারতেও কৃষিকাজ সরাসরি দেখাশোনা করতেন এমন চাষি বা বড় কৃষকেরা যদি সরাসরি সরকারি কোষাগারে ভূমি কর দেওয়ার অধিকার ভোগ করতেন—যে অধিকার তাঁরা রাইয়তিব্যবস্থার অধীনে ভোগ করতেন—তাহলে তাঁরা সস্তা ঋণের আরও ভালো প্রবেশাধিকার পেতেন। একইভাবে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি অর্থাত্, বর্তমানের তামিলনাড়ু ও কর্ণাটকের বহু জেলায় ‘নিধি’ ও ‘চি’ তহবিল গজিয়ে উঠেছে। এসব ফান্ডে মহাজন ও চাষি উভয়ের শেয়ার থাকত এবং চাইলে তাঁরা এই ফান্ড থেকে ঋণ নিতে পারতেন (রায়, ২০০৪)। এ রকম কিছু ফান্ড পরবর্তীকালে জয়েন্ট-স্টক কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া দুটি ব্যাংকের উত্থানের সাক্ষী এই অঞ্চল—ক্যানারা ব্যাংক ও সিন্ডিকেট ব্যাংক, যাদের প্রধান কাজ ছিল জমির মালিক ও চাষিদের ঋণ প্রদান করা। ১৯৬৯ সালে ১৪টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে জাতীয়করণের বহু আগেই তারা এসব ঋণগ্রহীতার জন্য আনুষ্ঠানিক ঋণ (formal credit) সরবরাহ নিশ্চিত করেছিল।

অকৃষিজ খাতে নৈতিক ব্যাংকিং ও সম্পর্কসূচক ব্যাংকিং

কিছুকাল আগে আমি লিখেছিলাম, ‘ব্যাংকারগণ সব সময় যার স্বীকৃতি দিয়ে আসছিলেন এমন একটি বিষয়কে সম্প্রতি অর্থনীতিবিদগণ তত্ত্বরূপ দিয়েছেন। সেটা হলো—ঋণের বাজার নিশ্চিতভাবেই ত্রুটিপূর্ণ এবং দর বৈষম্য (rate discrimination) ও ঋণ রেশনিং এখানে বিশ্বজনীন ব্যাপার। ঋণ-বাজারের ত্রুটিপূর্ণতার তৃতীয় মাত্রাটি হলো—কোনো সুনির্দিষ্ট ঋণদাতা কোনো সুনির্দিষ্ট ঋণগ্রহীতাকে কত সময়কালের জন্য ঋণ দিতে প্রস্তুত’ (বাগচি ১৯৯৭বি, পৃ.৪২)।

ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তাদের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করার ক্ষেত্রে এসব বিচিত্র মাত্রার পাশাপাশি তাদের অবাধ ক্ষমতা ও বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করতে হয়। কাজে কাজেই, ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সের ক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রশ্ন প্রধান হয়ে ওঠে।

তথ্য জোগাড় করার প্রক্রিয়া থেকেই নৈতিকতার প্রশ্ন উত্থাপিত হতে শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান শুধু যেটাকে বলা হচ্ছে ‘সম্ভাব্যতামূলক বৈষম্য’ (probabilistic discrimination), তার ওপর ভিত্তি করেই ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সেটা (সম্ভাব্যমূলক বৈষম্য) হলো—সম্ভাব্য ঋণগ্রহীতার প্রকৃত ঋণ-প্রাপ্যতা (creditworthiness) নিখুঁতভাবে অনুসন্ধান না করে একটা পুরো গ্রুপের গত্বাঁধা কাঠামোর ওপর নির্ভর করা। সামঞ্জস্যহীন তথ্যের প্রভাব কমানোর একটা উপায় হলো ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করা। এ রকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্য থেকে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করাকে ‘সম্পর্কসূচক ব্যাংকিং’ (relationship Banking) বলা হয় অর্থাত্ এমন একটা কাঠামো, যেখানে সম্পৃক্ততার পুনরাবৃত্তি থাকবে, ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক থাকবে (বেসাঙ্কো ও ঠাকুর, ২০০৪, পৃ.১)। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রধানত বৃহত্তর জ্ঞাতিসম্পর্কের নেটওয়ার্কের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্কসূচক ব্যাংকিং উনিশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ডে শিল্পকারখানা এবং খনি ও বিদ্যুত্ উত্পাদনের বিকাশে সহায়তা করেছে (Lamoreaux, 1986)।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) অর্থায়ন ঘটেছে সম্পর্কসূচক ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এই একবিংশ শতকের শুরুতেও শিল্পায়িত দেশগুলোর ৯০ শতাংশ ফার্ম এখনো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অন্তর্ভুক্ত এবং দুই-তৃতীয়াংশ কর্মশক্তি এই খাতে কাজ করে (বাস ও জার্মানি, ২০০৫)। জার্মানিতে মিটেলস্ট্যান্ড উদ্যোগগুলোর [জার্মান-ভাষী রাষ্ট্র, বিশেষত জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ডের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে বোঝাতে Mittelstand শব্দটি ব্যবহূত হয়।] অর্থায়ন হয়েছে সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাশাপাশি স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের আঞ্চলিক সেভিংস ব্যাংকের মাধ্যমে। জার্মানির ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো প্রত্যক্ষ অফিশিয়াল নীতি দ্বারা সমর্থিত। তাদের ব্যাংকগুলোর কাঠামোতে আছে ‘স্পার্কাসেন’ (মিউচুয়াল সেভিংস ব্যাংক) (sparkassen mutual saving banks) ও ‘ভলস্ব্যাংকেন’ (volksbanken) বা ‘কো-অপারেটিভ’ ব্যাংকের মতো বিশালসংখ্যক আঞ্চলিক ও স্থানীয় ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান, যাদের প্রধান সম্পদ হলো স্থানীয় {মিটেলস্ট্যান্ড} গ্রাহকদের কাছাকাছি থাকা। এই নৈকট্য {মিটেলস্ট্যান্ড} ঋণের ঝুঁকি সম্পর্কে উত্কৃষ্টতর মূল্যায়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে সহায়তা করে (পাওস্ট, ২০১৪)।

আমি জার্মান মিটেলস্ট্যান্ড বা এসএমই সম্পর্কে একটু মনোযোগ দেব। কারণ, জার্মানি এখনো ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হিসেবে টিকে আছে এবং নিরাশাবাদীদের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করে জার্মানির এসএমই খাত বিশ্বায়নের প্রবল চাপের মধ্যেও বিকশিত হয়েছে। জার্মানিতে উনিশ শতাব্দী থেকে প্রথমে স্টিল ইন্ডাস্ট্রি এবং পরবর্তী সময়ে অটোমোবাইল ও ই-ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি ইন্ডাস্ট্রিতে বৃহত্ ও উল্লম্বভাবে অঙ্গীভূত ‘autackic’ বা স্বনির্ভর ফার্মগুলো বিকশিত হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে Constituent Lander বা আঞ্চলিক সরকারের হাতে কিছু আইনি ও আর্থিক ক্ষমতা প্রদান করার ফলে এমনকি ওহোমাইন রাইখ [১৮৯০-১৯১৪] ও ভাইমার রিপাবলিকের [১৯১৮-১৯৩০] আমলেও বৃহত্ কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি কুটির শিল্পভিত্তিক এসএমইগুলো বিকশিত হয়েছে (হেরিগেল, ১৯৯৬, অধ্যায় ৩)। ১৯৪৫ সালের পর এই কাঠামো পুনর্গঠন করা হয় এবং তা ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে জার্মান অর্থনৈতিক উন্নয়নে গতিশীলতা আনয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রথমে মনে হয়েছিল নব্য উদারনৈতিক বিশ্বায়নের চাপে পিষ্ট হয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো টিকবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ফোর্ডিস্ট (‘স্বনির্ভর’) শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এবং অটোমোবাইল ও অন্য সব ধরনের মেশিন-যন্ত্রাংশের আউটসোর্সিং খাতের ক্রম অবনতির ফলে জার্মান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো নবজীবন লাভ করেছে (হেরিগেল, ১৯৯৬, অধ্যায় ৫; পাওস্ট, ২০১৪)।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর এই গতিশীলতার একটি প্রধান ভিত্তি হলো জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থা। সেখানে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে বাধ্যতামূলক এবং ১৮ বা ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত আংশিকভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে বাধ্যতামূলক উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা দেওয়া হয়। অধিকাংশ ছাত্র ১৫ বছর বয়স থেকে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে এবং তাদের অধিকাংশই কোনো না কোনো দক্ষতাভিত্তিক পেশায় নিয়োজিত হয়। যদিও কারিগরি শিক্ষার্থীদের মধ্যেও কেউ কেউ তাদের পছন্দের বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় (হিপ্পাচ-স্নাইডার, খাউজা ও ওল ২০০৭; লহমার ও এখার্ড ২০১৩)। দক্ষ শ্রমিকদের অনেকেই পরিবারের মালিকানাধীন এসএমইতে যোগ দেয়, যার ফলে শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক মজবুত হয় এবং নিজেদের এলাকার জন্য সামাজিক দায়িত্বমূলক প্রকল্প হাতে নিতে তারা উত্সাহিত হয় (পাওস্ট, ২০১৪)। ফার্মের এই ধরনের গঠনপ্রক্রিয়া অ্যাংলো-সেক্সন, নব্য উদারনৈতিক ‘শেয়ারহোল্ডারই রাজা’ মডেলের ফার্মকাঠামো ও কার্যক্রমের সম্পূর্ণ বিপরীত (বাগচি ১৯৯৭এ)। জার্মানির প্রায়োগিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ফ্রনোওফার সোসাইটির (Fraunhofer Society) সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে সেখানকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের কার্যক্রমকে প্রযুক্তিগতভাবে আরও উন্নত করা হয়েছে। ২০১৩ সালে ফ্রনোওফার সোসাইটির বার্ষিক বাজেট ছিল ১ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ইউরো। তারা প্রায় ৬ হাজার প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা দিচ্ছে এবং প্রতিবছর প্রায় ৪০০টি নিবন্ধিত পেটেন্ট উত্পাদন করছে (হল্জ, ২০১৩)। দক্ষিণ-এশিয়ার অনেক শিল্পায়িত অর্থনীতি, বিশেষত গণপ্রজাতন্ত্রী চীন (পিআরসি) ও তাইওয়ানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো আয়, চাকরি ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চীনে যেমন ‘জিডিপিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের অবদান ৬০ শতাংশ এবং কর্মশক্তির ৮২ শতাংশ এই খাতে নিয়োজিত’ (পাওস্ট, ২০১৪)। ছোট রাষ্ট্র তাইওয়ান যদিও আধা পরিবাহী পদার্থ উত্পাদনের ক্ষেত্রে পৃথিবীর নেতৃত্বস্থানীয় কয়েকটি বৃহত্ প্রতিষ্ঠানের গর্বে গর্বিত দেশ, ২০০৯ সালে ‘তাইওয়ানের ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সে দেশের সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ৯৮ শতাংশ। এ খাত রাষ্ট্রের সর্বমোট বিক্রির ৩১ শতাংশ ও রপ্তানি ১৭ শতাংশ উত্পাদন করে’ (ওয়াং, ২০১০)। সাফল্য অর্জনকারী জার্মানির মতোই বর্তমানের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে ফান্ড বরাদ্দের ক্ষেত্রে শক্তিশালী সরকারি সহায়তা, কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অভ্যন্তরীণ স্পেসের সুরক্ষা এবং চিহ্নিত খাতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গবেষণা ও উন্নয়ন (ইউএন এসকাপ, ২০১৪, অধ্যায় ৫)।

জার্মানি ও তাইওয়ানের সাফল্যের গল্প থেকে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয় যে শেষ পর্যন্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তব্য হলো প্রকৃত অর্থনীতিকে সহায়তা করা; অনিয়ন্ত্রিত ফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রিকে নয়, যা ফিন্যান্স-ব্যারনদের আরও অর্থশালী করার জন্য তহবিল শুষে নেয় এবং পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তোলে। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয় যে অনিয়ন্ত্রিত অর্থায়ন যুক্তরাষ্ট্র (ওরহানগাজি, ২০০৮), যুক্তরাজ্য এবং আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো ও তুরস্কের মতো পৃথিবীর উদীয়মান ফিন্যান্সনির্ভর অর্থনীতিগুলোকে এক মারাত্মক ধসের পথে নিয়ে গেছে (দেমির, ২০০৬)।

অনিয়ন্ত্রিত অর্থায়ন এবং অপরিহার্য জন-কর্মকাণ্ড থেকে রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রত্যাহার অন্তর্ভুক্তিমূলক সম্পর্কসূচক ব্যাংকিংকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে

যখন অত্যাবশ্যকীয়ভাবে অনিয়ন্ত্রিত ব্যাংক কিংবা আর্থিক কোম্পানিগুলোকে অর্থায়ন ব্যবসায় নামার অনুমোদন দেওয়া হয় এবং ফার্মগুলোকে অনিয়ন্ত্রিত ক্যাপিটাল মার্কেটে প্রবেশ করতে প্ররোচিত করা হয়, তখন সম্পর্কসূচক ব্যাংকিং অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে (বেসাঙ্কো ও ঠাকুর, ২০০৪)। চারটি ভুল ধারণাকে সমর্থন করার জন্য প্রধানত নব্য ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদেরা বিশাল আবর্জনার স্তূপ পরিমাণ (অর্থনীতি) সাহিত্যকে বিকৃত করেছেন। প্রথম ভুল ধারণাটি হলো— শেয়ারহোল্ডাররাই একমাত্র স্টেকহোল্ডার, যাঁরা কোনো ফার্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা জোগানদার কেউই বিবেচ্য হওয়ার নয়। দ্বিতীয় ভুল ধারণা হলো—হঠাত্ কোনো একমুহূর্তে স্টক মার্কেট কোনো ফার্মের অন্তর্নিহিত মূল্য (fundamental value) প্রকাশ করতে পারে। তৃতীয় ভুল ধারণা—যা দ্বিতীয়টির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত, তা হলো স্টক মার্কেট কার্যকরভাবে কাজ করে, এই অর্থে যে স্টক মার্কেটে ব্যবসা করে কেউ লাভবান হতে পারে না।

চূড়ান্ত ভুল ধারণাটি হলো, স্টক মার্কেট কর্তৃক প্রকাশিত অন্তর্নিহিত মূল্যের ভিত্তিতে আপনি ডিরাইভেটিভসের মূল্যের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন (বাগচি, ১৯৯৭এ)। এই শেষ ভুল ধারণার তত্ত্বরূপ দেওয়ার জন্যই ১৯৯৭ সালে রবার্ট মার্টন ও মাইরন স্কোলসকে অর্থনীতিতে সুইডিশ ব্যাংক পুরস্কারে (যেটাকে ভুলভাবে অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার বলা হয়) ভূষিত করা হয় (স্টক মার্কেটকে বিপজ্জনক করে তোলা বহুবিধ অকার্যকারিতার একটা জরিপ পাওয়ার জন্য, দেখুন শ্লেইফার, ২০০০)। মার্টন ও স্কোলস লং-টার্ম ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট এলপি (LTCM) এর প্রধান শেয়ারহোল্ডার ও বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের সদস্য ছিলেন। মার্টিন ও স্কোলসের সুইডিশ ব্যাংক পুরস্কারপ্রাপ্তির মাত্র এক বছরের মধ্যে এই ফার্মের অতিমাত্রায় লেভারেজ্ড মাস্টার হেজ ফান্ড লং-টার্ম ক্যাপিটাল পোর্টফোলিও এলপি ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি এক্সপোজার নিয়ে ১৯৯৮ সালের শেষদিকে মুখ থুবড়ে পড়ে। ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের নেতৃত্বে ১৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের পুঁজিকাঠামো পুনর্বিন্যাস (recapitalization) ও বেইল আউটের (bail out) লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল ব্যাংকারস ট্রাস্ট বারক্লেইজ, বিয়ার স্টিয়ার্নস, চেইজ ম্যানহাটন ব্যাংক, ক্রেডিট অ্যাগ্রিকোল, ক্রেডিট সুইসি ফার্স্ট বস্টন, ডাটসি ব্যাংক, গোল্ডম্যান স্যাক্স, জেপি মরগ্যান, লেহম্যান ব্রাদার্স, মেরিল লিঞ্চ, মরগান স্ট্যানলি, প্যারিবাস, সলোমন স্মিথ বার্নে, সোসিয়েতে জেনারেলে ও সুইজারল্যান্ডের ইউবিএস (গ্রিনস্প্যান, ২০০৭, পৃ. ১৯৩-৫)। লং-টার্ম ম্যানেজমেন্টের পতনের ফলে ব্ল্যাক-মার্টন-স্কোলস ফরমুলার প্রয়োগ বন্ধ হয়। কিন্তু কোলাটেরালাইজড ডেট অবলিগেশন (CDOs) এবং অনেক ব্যাংক ও হেজ ফান্ডের ঋণ অফ-ব্যালেন্স শিট অ্যাকাউন্টে দেখানো ইত্যাদি যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ডিরাইভেটিভসের বিস্তৃতি বন্ধ হয়নি। যারা LTCM-এর বেইল আউটের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের অধিকাংশই যেমন—বিয়ার স্টিয়ার্নস, লেহম্যান ব্রাদার্স ও মেরিল লিঞ্চ ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দায় দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ১৯৮০-র দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রি সমৃদ্ধি লাভ করে। আর্থিক খাতের মুনাফা যোগ্যতা (profitability) প্রকৃত পণ্য খাতের মুনাফা যোগ্যতাকে ডিঙিয়ে অনেক দূর ছাড়িয়ে যায় এবং অফিশিয়ালদের গড় বেতন অর্থনীতির অন্যান্য খাতের তুলনায় ১৮১ শতাংশ বেড়ে আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের পদ্ধতিতে ফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রি শত শত মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে পারে হোয়াইট হাউস ও ক্যাপিটল হিলে লবি নিয়োগ কিংবা রাজনীতিবিদদের প্রচারণার জন্য, যারা স্বাভাবিকভাবেই তাদের বশংবদ হয়ে থাকবে। যেহেতু প্রকৃত বিনিয়োগে অর্থলগ্নি করার সুযোগ রুদ্ধ হয়ে যায়, ফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রি ঊর্ধ্বমুখিন হলেও ব্যাংক, বহুজাতিক ফিন্যান্স করপোরেশন ও মর্টগেজ লেন্ডার প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্ন থেকে নিম্নতর মানের প্রকল্পে অর্থায়ন করতে শুরু করে এবং সব সময় এই আশায় দিন গুনতে থাকে যে অন্য কেউ এসে ট্যাবটা ওপরের দিকে তুলে নেবে। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপারটা হলো তথাকথিত নিনজা লোনস্ অর্থাত্ উপার্জন, চাকরি ও সম্পত্তিহীন লোকদের ঋণ প্রদান। একটা ফিন্যান্সিয়াল অলিগার্কি বা আর্থিক গোষ্ঠীতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রকে দখল করে নিয়েছে। দেশটির একজন সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ সায়মন জনসন যেমন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা সেন্ট্রাল আমেরিকার ‘ব্যানানা রিপাবলিকে’র চেয়ে ভালো নয়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি করপোরেশন ইউনাইটেড ফ্রন্ট কোম্পানি দীর্ঘদিন যাবত্ সরকার (সাধারণত একজন মেরুদণ্ডহীন স্বৈরশাসক) নির্ধারণ করে আসছে (জনসন ২০০৯)।

যুক্তরাষ্ট্রের ফিন্যান্সিয়াল অলিগার্কির ক্ষমতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন বেইলিং আউট করা ব্যাংক, হোম মর্টগেজ ইনস্টিটিউশন এবং এআইজি (AIG)—এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, যাদের প্রধান নির্বাহীদের অবৈধ পথে অর্জিত সম্পদ গলায় হাত দিয়ে বের করে আনার ব্যবস্থা করা হয়নি; কিংবা শাস্তিযোগ্য অসতর্কতা এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্জলা প্রতারণার জন্যও যাদের কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি—তাদের জন্য সরকার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে (রেকফ, ২০১৪)। যুক্তরাষ্ট্রের বিচারক জেড রেকফ যেমন দেখিয়েছেন, হেজ ফান্ডের বিরুদ্ধে যে অল্প কিছু দেওয়ানি মামলা রুজু করা হয়েছে, সেখানে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে খুব দুর্বলভাবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট তাদের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা দায়ের করেনি। ডিপার্টমেন্ট ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রতারণামূলক বিনিয়োগের (Ponzi scheme) জন্য বার্নার্ড ম্যাডফের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে, যেখানে ফিন্যান্স ইন্ডাস্ট্রির কিছু বড় নামসহ অনেক লগ্নিকারীকে টানা হয়েছে এবং ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের জন্য রজত গুপ্ত ও রাজরত্নমকে বিচারপ্রক্রিয়ার মুখোমুখি করা হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী কোম্পানিগুলোর কোনো একজন সিইওকেও বিচারপ্রক্রিয়ায় আনা হয়নি।৩

ঔপনিবেশিক ভারতে সম্পর্কসূচক ব্যাংকিং ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়

ঔপনিবেশিক ভারতে সম্পর্কসূচক ব্যাংকিংয়ের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এখানে জ্ঞাতিসম্পর্কসূচক নেটওয়ার্কের ফলে আস্থার জটিল জালগুলো তৈরি হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত তিনটি প্রেসিডেন্সি ব্যাংক তাদের সংশ্লিষ্ট এলাকায় শাখা খোলার বহু আগেই কিছু ভারতীয় ব্যাংকারের শাখা বা এজেন্সি ভারতজুড়ে—পেশোয়ার থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। ভারতীয় ব্যাংকারদের এসব নেটওয়ার্কের প্রভাব সুস্পষ্ট হয় ১৮৯০-এর দশকে, যখন অফিশিয়াল টাঁকশালে বিনা পয়সায় রৌপ্য মুদ্রা সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার ফলে ঋণের ক্ষেত্রে চরম সংকট দেখা দেয় (তথাকথিত ‘limping standard’[এমন মুদ্রাব্যবস্থা যেখানে স্বর্ণ ও রৌপ্য দুটোই বিহিত মুদ্রা, কিন্তু শুধু একটিকে ফ্রি কয়নেজ দেওয়া হয়]-এর কাল)। ব্যাংক অব বোম্বের সেক্রেটারি জি এইচ স্নেইজ টাইমস অব ইন্ডিয়ায় লেখা (স্লেইঘ, ১৯৯৮) একটা চিঠিতে দাবি করেন, যে সব শ্রফ বোম্বের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পুরোটাই অর্থায়ন করতেন, তাঁরা সাধারণভাবে তাঁদের দর ৮ শতাংশের বেশি উঠতে দিতেন না। এমনকি যখন তিনটি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্সি ব্যাংকের দর এর চেয়ে অনেক বেশিতে উঠে যেত, তখন তাঁরা একজন আরেকজনের বিল আরও নিচু দরে ছেড়ে দিতেন (আরও দেখুন, জেইন ১৯২৯, পৃ. ৯৫-৬ ও পৃ. ১০৩; দ্বিতীয় উেস ১৮৬৭ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত আন্তব্যাংক দর (sahukari rates) দেওয়া আছে। সেখানে দেখা যাবে, ক্রমপতনপ্রবণতার ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য রকম স্থিরতা, যা প্রায়শ প্রেসিডেন্সি ব্যাংকগুলো কর্তৃক নির্ধারিত দরের চেয়েও নিচে নেমে যেত।)।

তবে অবশ্যই এই নেটওয়ার্ক-সম্পর্কগুলো শ্রফদের পক্ষপাতপুষ্ট গ্রাহকদের উপকৃত করেছে এবং তারা অন্যদের প্রতিও ছিল বৈষম্যমূলক। বুড়াবাজারের মাড়োয়ারি শ্রফরা ব্যাংক অব বেঙ্গল থেকে যে দরে ঋণ নিতেন, তার চেয়েও কম দরে তাঁদের নিজের সম্প্রদায়ের লোকদের ঋণ দিতেন। অন্যদিকে, বাঙালি ব্যবসায়ী কিংবা নাকুদা অর্থাত্ পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করতেন এমন অবাঙালি মুসলমান ব্যবসায়ীদের ঋণের বিপরীতে তাঁরা অনেক বেশি চড়া সুদ ধার্য করতেন (বাগচি, ১৯৯৭বি, পৃ. ৪৮-৯)।

ব্যাংক অব বেঙ্গল বৈষম্যের নীতিতে এক ধাপ এগিয়ে শুধু মাড়োয়ারি শ্রফদের সঙ্গেই লেনদেন করত, যাদের তারা বাঙালি ও নাকুদা ব্যবসায়ীদের চেয়ে বেশি ঋণপ্রাপ্য (credit-worthy) মনে করত (বাগচি, ১৯৯৭বি, পৃ. ৪৮-৯)। সমাজের নীচু শ্রেণির ক্ষেত্রে সুদের হার ও ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য চরম মাত্রায় ধারণ করত। যেমন বিশালসংখ্যক উপজাতি বসবাস করে—এমন জেলাগুলোতে কালি পরজ বা কালো গায়ের রংবিশিষ্ট লোকদের উজলি পরজ বা ফরসা গায়ের রংবিশিষ্ট গোত্রের চেয়ে বেশি হারে সুদ দিতে হতো (উপরোক্ত, পৃ. ৪৩)।

দক্ষিণ এশিয়ায় আধুনিক লিমিটেড-লায়াবিলিটি জয়েন্ট-স্টক ব্যাংকিং প্রবর্তন করেন ঔপনিবেশিক শাসকেরা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ব্যাংক অব বেঙ্গল (১৮০৯), ব্যাংক অব বোম্বে (১৮৪০) ও ব্যাংক অব মাদ্রাজকে (১৮৪৩) সংসদীয় সনদ প্রদান করার মাধ্যমেই এর শুরু হয়। এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এবং ইউরোপীয় ঋণগ্রহীতাদের তুলনায় ভারতীয় ঋণগ্রহীতাদের প্রতি আচরণে বৈষম্য বিরাজমান ছিল। ১৮১০ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত বোম্বে ব্যাংক ব্যতীত কোনো ব্যাংকে ভারতীয় পরিচালক ছিল না। আবার এই বোম্বে ব্যাংক ব্যতীত অন্য কোনো ব্যাংকে কোনো ভারতীয় নগদ ঋণসুবিধা পাননি। ঋণ পাওয়ার জন্য তাঁদের সব সময় সরকারি বন্ড বা অন্যান্য অনুমোদিত সিকিউরিটি ডিপোজিট করতে হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত কোনো ভারতীয়কে কোনো ব্রাঞ্চের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি (বাগচি ১৯৮৭, অধ্যায় ৩, ৫, ৭, ৯, ১২, ১৫; বাগচি ১৯৯৭বি, অধ্যায় ৬, ১২ ও ১৫)।

উন্নয়নবান্ধব ব্যাংকিং (developmental banking), সম্পর্কসূচক ব্যাংকিংয়ের আরেকটি রূপ

উন্নয়নশীল রাষ্ট্র বা অঞ্চলগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পায়িত রাষ্ট্রগুলো অর্থাত্ তাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী ও পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি পিপলস রিপাবলিক অব চায়না (পিআরসি), রিপাবলিক অব কোরিয়া (ROK) বা দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুর৪ প্রভৃতি দেশ ফিন্যান্স কোম্পানি ও স্টক মার্কেটের অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রমের ফলে সৃষ্ট অন্তঃবিস্ফোরণ থেকে বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। এসব রাষ্ট্র অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে জাপানের কৌশল অনুসরণ করেছে। এক. দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে, এমনকি যখন তারা যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির সাহায্যের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল ছিল, তখনো তারা একটি স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করেছে। চীন অবশ্য ১৯৮০-এর দশকের সংক্ষিপ্ত কাল ছাড়া পশ্চিমা শক্তিগুলোর কাছ থেকে কোনো অর্থসহায়তা গ্রহণ করেনি। নীতি প্রণয়নের স্বাধীনতা অর্জন ও তা বজায় রাখার একটি প্রধান উপায় হলো রপ্তানি খাতকে উত্সাহিত করা। এমনকি যখন নতুন শিল্পকে অভ্যন্তরীণ বাজারে সুরক্ষা দেওয়া হয়, তখনো এই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে এসব নতুন শিল্পের কোনো কোনোটি রপ্তানি বাজারে বিশ্বের শীর্যস্থানীয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সরকার প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। তৃতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নে অর্থায়নের প্রধান উত্স ছিল ব্যাংক। এ কারণে পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নের বঙ্কিম পথকে কখনো কখনো ব্যাংকনির্ভর উন্নয়ন হিসেবে দেখানো হয়। সাম্প্রতিক কালে ভিয়েতনাম অর্থনৈতিক ও মানবীয় উন্নয়নের জন্য একই কৌশল অবলম্বন করে সাফল্য অর্জন করছে।

দক্ষিণ এশীয় সাফল্যের গল্প থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর অনেক কিছু শেখার আছে। ব্যাংকিং খাতে সীমাবদ্ধ থেকে আমি বলতে চাইব যে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর তথাকথিত বিশ্বজনীন ব্যাংকিং মডেল বাতিল করে দেওয়া উচিত, যা গ্রহণ করতে তাদের প্ররোচিত করা হয়েছে কিংবা অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি ফিন্যান্স কোম্পানির চাপের মুখে তা গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছে; বরং সরকারি সমর্থনপুষ্ট ও সতর্কভাবে নিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন ব্যাংকিং খাত থাকা উচিত, যা যেকোনো সীমা লঙ্ঘনের জন্য কঠোর শাস্তি আরোপের মাধ্যমে কোনো ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবে। স্টক মার্কেট পরিচালনার দায়িত্ব ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। টেকসই অর্থনৈতিক ও মানবিক উন্নয়নের পথে অগ্রগামী প্রতিটি রাষ্ট্রের উচিত Glass-Steagall Act-এর মতো একটি আইন পাস করা।৫ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে পর্যাপ্ত ব্যাংকিং সুবিধাসহ সচেতনভাবে উত্সাহিত করা এই কৌশলের অংশ হওয়া উচিত।

পাওস্ট (২০১৪) যেমন গুরুত্বসহকারে দেখিয়েছেন, পূর্ব এশিয়ার বাইরের উন্নয়শীল রাষ্ট্রগুলোয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত অনেক কম বিকশিত, কম সক্রিয় এবং লাল ফিতা, ত্রুটিপূর্ণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালা, অর্থায়নের অভাব ও অন্যান্য কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। উপরিউক্ত একটি মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলা যায়, অনিয়ন্ত্রিত অর্থায়নের অরাজকতার ফলে ২০০৭ সালের পরের বছরগুলোতে সারা পৃথিবীতে শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক ও ফিন্যান্স কোম্পানিগুলোর দেউলিয়া হতে দেখা গেছে। যেমন যুক্তরাজ্যে নর্দান রক, রয়্যাল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ড ও লয়ডস ব্যাংক—সবাই দেউলিয়া হয়েছে এবং জনগণের বিশাল পরিমাণ অর্থ গচ্চা দিয়ে ব্রিটিশ ট্রেজারি কর্তৃক উদ্ধার পেয়েছে।

নৈতিক ব্যাংকিংয়ের জন্য একদিকে যেমন ব্যাংকারের অবাধ ক্ষমতা (discretion) প্রয়োগের সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন; অন্যদিকে সম্পদ আহরণ, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসার—যেমন স্টক মার্কেট ক্যাসিনোতে লগ্নি করা— এ ক্ষেত্রে ব্যাংকারের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধও থাকা প্রয়োজন। এই বিধিনিষেধ প্রয়োগ করতে হবে যথার্থভাবে গঠিত সরকারি কর্তৃপক্ষ, বিশেষত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় দ্বারা, যারা একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের নজরদারিতে থেকে কাজ করবে। নৈতিক ব্যাংকিংয়ের জন্য প্রয়োজন Glass-Steagall বা ১৯৪৭ সালের পূর্বে দক্ষিণ এশিয়ায় পরিচালিত ব্যবস্থার অনুসরণ করে বিকেন্দ্রীকৃত সম্পর্কসূচক ব্যাংকিং এবং ব্যাংক ও স্টক মার্কেটের মধ্যে সুস্পষ্ট পৃথ্ককরণ।

উপসংহার: ব্যাংকিং নৈতিকতাকে একটি নৈতিকতা ও ন্যায়বিচার পদ্ধতিতে কাঠামোবদ্ধ করতে হবে

আমাদের সময়ের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ-দার্শনিক অমর্ত্য সেন নৈতিকতা ও অর্থনীতি নিয়ে বিস্তৃত লেখালেখি করেছেন। নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারের দৃষ্টিতে কোনো কর্মোদ্যোগের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কর্তব্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (deontological reasoning) ও পরিণামবাদী যৌক্তিকতার (consequentialist justifications) মধ্যে একটি গুরুতর পার্থক্য নিরূপণ করেছেন (দেখুন, সেন ২০০৯, অধ্যায় ৭-১০)। প্রথমটির সবচেয়ে সহজ উদাহারণ হচ্ছে ইমানুয়েল কান্টের (‘categorical imperative’) ‘নিঃশর্ত বা চরম অত্যাবশ্যকতা’ (তোমাকে এটা করতে হবে। কারণ, এটা তোমার কর্তব্য) কিংবা ভারতীয় মহাকাব্য ‘মহাভারতে’ কৃষ্ণের সেই যুক্তি, অর্জুনের অবশ্যই কৌরভদের সঙ্গে যুদ্ধ করা উচিত। কারণ একজন ‘ক্ষত্রিয় রাজপুত্র হিসেবে কৌরভদের কাছ থেকে রাজ্য উদ্ধার করা তার কর্তব্য, যদিও সে-যুদ্ধে তার প্রিয়জনের প্রাণসংহার হতে পারে। পরিণামবাদীরা সঠিক কর্মের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে অবিসংবাদিত কর্তব্য সম্পাদনের পরিণাম নিরূপণ করেন। সেন সম্পূর্ণভাবে পরিণামবাদী অবস্থানের পক্ষে তার মূল্যায়ন করেছেন।

আমিও বিশ্বাস করি, মানবীয় কর্মকাণ্ডের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরে পরিণামবাদে আস্থা রাখাই উত্তম পন্থা। তবে আমি সেই অবস্থান কিছুটা পুনর্বিন্যাস করতে চাই। প্রথমত, আমি প্রশ্ন তুলতে চাই কর্তব্যবাদীদের কর্তব্যের উত্স কী। এ রকম ঐশী প্রত্যাদেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত একটি কাব্যভাষায় তুলে এনেছেন লর্ড টেনিসন তাঁর ‘Charge of the Light Brigade’ কবিতায়:

সাংঘাতিক ভুল করেছে কেউ একজন

কিন্তু জবাব দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই

হেতু নির্ণয় করারও নেই উপায়

শুধুই কর্তব্য পালন, নয় মৃত্যু।

বিদেশের মাটিতে একটি সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে এক অপরিণামদর্শী কমান্ডারের ভুলে লাইট ব্রিগেডের সেই ছয় শ সেনাকে মৃত্যু উপত্যকায় ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। কেন সেখানে মৃত্যুবরণ করা তাদের কর্তব্য ছিল? চার্লস ব্যারন দ্য মন্টেস্কুর (২০১২) পেন্স নং ৭৪১-এ চিত্রিত একটি প্রত্যাদেশ আমি উত্থাপন করব, যা ব্যাংকিং ও অন্য অনেক কাজের নৈতিকতা মূল্যায়নের একটি যথাযথপ্রায় দিকনির্দেশনা হতে পারে:

‘যদি আমি এমন কিছু জানি যা আমার জন্য উপকারী এবং আমার পরিবারের জন্য ক্ষতিকর, তাহলে আমি আমার মন থেকে তা মুছে ফেলব। যদি আমি এমন কিছু জানি যা আমার পরিবারের জন্য উপকারী কিন্তু দেশের জন্য নয়, আমি তা ভুলে যেতে চাইব। যদি আমি এমন কিছু জানি যা আমার দেশের জন্য উপকারী এবং ইউরোপের জন্য ক্ষতিকর কিংবা ইউরোপের জন্য উপকারী কিন্তু মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর, আমি এটাকে অপরাধ বলে গণ্য করব।’

যদি আমরা এই উপদেশে কান দিই, তবে দেখব যে যখন আমরা বাছবিচারহীনভাবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও ফিন্যান্সসংক্রান্ত নীতিমালা প্রয়োগ করছি, যা শুধু বৈষম্য বৃদ্ধি করছে এবং একটি জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশকে নাকচ করে দিচ্ছে; তখন বিভিন্ন প্রতিরূপে ‘দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলগত প্রোগ্রাম’ (পিআরএসপি) পরিচালনা করাই যথেষ্ট নয়। নব্য ধ্রুপদি অর্থনীতি অধিকাংশ রাষ্ট্রের নীতি-পরামর্শকদের আদর্শ মানসিক যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতি একজন প্র্যাকটিশনারকে কাঠামোগত কার্যকারণ সম্পর্কে অন্ধ করে দেয়। আমি যদি নতুন শব্দগুচ্ছ প্রবর্তন করে বলি তাহলে বলতে হয়, এটা তাকে কাঠামোগত নৈতিকতার ব্যাপারেও অন্ধ করে দেয়। দ্বিতীয় ব্যাপারটার সমাধানের জন্য একজন নীতিনির্ধারককে এটা স্বীকার করে নিতে হবে যে, তিনি যে সমাজ নিয়ে কাজ করছেন, তার কিছু কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য আছে, যা ব্যাষ্টিক পর্যায়ের কোনো সংখ্যক পিআরএসপি পদক্ষেপ দিয়ে প্রতিকার করা যাবে না। পৃথিবী এখন অচেতন নাজি জল্লাদ আইখম্যানে ভরে গেছে। যারা মনে করে, তারা শুধু তাদের কর্তব্যকর্ম করছে। এই উপলব্ধি তাদের নেই যে এর মাধ্যমে তারা গণদারিদ্র্য সৃষ্টি করছে এবং কোনো না কোনো ধরনের সন্ত্রাসী যুদ্ধের বীজ বপন করছে। নুরুল মতিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নৈতিক ব্যাংকিং পরিচালনার জন্য প্রয়োজন আইখম্যানীয় আচরণের মানদণ্ডকে উড়িয়ে দেওয়া। প্রতিটি রাষ্ট্রেরই মৌলিক ও প্রক্রিয়াগত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার (এমন ব্যবস্থা নয়, যেটা টাকা দিয়ে কেনা যায়) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত একটি নিয়ন্ত্রণকারী কাঠামো থাকা প্রয়োজন, যাতে কোনো নীতিমান ব্যাংকারকে শহিদ হতে বাধ্য না হতে হয়।

অনুবাদ: রাশেদ রাহম

তথ্যসূত্র:

১.         জমিসংক্রান্ত অসংখ্য অধিকারের পণ্যায়ন (commoditizing) এবং সম্পত্তি হিসেবে জমির ওপর একচেটিয়া অধিকার আরোপ করার মধ্যে পার্থক্যের জন্য দেখুন বাগচি ২০১০, ‘ভূমিকা’ এবং বাগচি ২০১০ [১৯৯২]। আবাদের জন্য ছাড়া জমি প্রধানত ইউরোপিয়ানদের দেওয়া হতো, ব্রিটিশরা কখনোই সাধারণ কৃষক-আবাদকৃত করের আওতাধীন জমির সাধারণ অধিকার কাউকে দিত না।

২.         ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আদালতগুলোর স্বেচ্ছাচারমূলক রায়ের জীবন্ত বর্ণনার জন্য দেখুন, চারুচন্দ্র দত্তের আত্মজীবনী। তিনি ১৮৯৯ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এবং বোম্বে প্রেসিডেন্সির একজন জেলা জজ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন: দত্ত (১৯৬৬)।

৩.        বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা যা আসলে ২০০৭ সালে শুরু হয়েছে, তার কারণ সম্পর্কে আলোচনা এবং বেইল আডট কার্যক্রমের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর জনতহবিল থেকে কী পরিমাণ খরচ গুনতে হয়েছে, তা এই নিবন্ধের আওতার বাইরে। যুক্তরাজ্যের প্রেক্ষাপটে এসব বিষয় বিশ্লেষণের জন্য দেখুন (এফএসএ ২০০৯ এবং হার্বস্ট ২০১৩)।

৪.         ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে হলেও অফিশিয়াল অর্থনৈতিক কৌশলের দিক থেকে সিঙ্গাপুর দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুচ্ছের মধ্যেই পড়ে।

৫.         দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিল্পোন্নত দেশগুলো অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় অধিক সম্পদ ব্যয় করেছে এবং ফলে সর্বজনীন বা প্রায় সর্বজনীন সাক্ষরতা, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক গ্র্যাজুয়েট, আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির উচ্চ হার, নিম্ন জন্মহার অর্জন করেছে।

গ্রন্থপঞ্জি

            Ahsan, Manzoor. 2002. ‘Reforming rural credit : Experience under the Fazlul Haq ministry in Bengal’. Pp.170-185 in Bagchi 2002.

          Baas, Timo and Mechthild Schrooten. 2005. Relationship Banking and SMEs A Theoritical Analysis, Dissertation paper Series A No. 470, Tokiyo: Institute of Economic Research, Hitotsubashi University.

          Bagchi, Amiya k. 1987. The Evolution of the State Bank of India: The Roots 106-176, Parts I and II, New Delhi: Oxford University Press.

          Bagchi, Amiya k. 1997a. Economic Theory and Economic Organizations 1: a critique of the Angli-American theory of firm structure, Occational Paper No. 165, Center for Studies in Social Sciences, Calcutta.

          Bagchi, Amiya k.1997b. The Evolution of the State bank of India, Volume2, The Era of the Presidency Banks 1887-1920, New Delhi: Sage.

          Bagchi, Amiya k. 2002[1981] Merchants and Colonialism, Occasional Paper No.38, Center for Studies in Social Sciences, Calcutta: reprinted, pp.17-70, Bagchi, Amiya k.: Capital and Labour re-defined: India and the Third World, New Delhi: Tulika.

          Bagchi, Amiya k. ed. 2002. Money & Credit in Indian History from Early Mediaval Times, New Delhi: Oxford University Press.

          Bagchi, Amiya k. and Subhanil Banerjee. 2005. How strong are the arguments for bank mergers? Economic and Political Weekly, XL 12) 1181-1189.

          Besanko, David and Anjan V. Thakor. 2004. Relationship banking, deposit insurance and portfolio choice, (URL:http://128.118.178.162/ eps/fin/papers/0411/0411046.pdf, accessed on 25.9.14)

          Boot ,Arnoud W. A. 2000. Relationship banking: What do we

          know? Journal of Financial Intermediation, vol.9: 7–25.

          Datta, Charuchandra. 1996. Purono kotha, Dwitya Khanda (in Bangla), Calcutta: Bisva Bharati Grantan Bibhag.

          Deccan Riots Commisson. 1876. Report of the Committee on the Riots in Poona and Ahmedanagar, 1875. Bombay: Government Central Press.

          Demir, Firat. 2006. Macroeconomic uncertainty, private investment and financialization of real sectors in emerging markets: Evidence from Argentina, Mexico and Turkey (URL:http://www.ou.edu/ cas/econ/wppd/macrouncertainty%20fd.pdf.accessedon 11.10.14)

          Epstein, Gerald A, and Arjun Jayadev. 2000. ‘The rise of rentier incomes in OECD countries: financialization, central bank policy and labour solidarity’, pp.46-74 in G. Epstein. Ed. Financialization and the World economy, Cheltenham, UK: Edward Elgar.

          FSA. 2009. The Turner review: a regulatory response to the global financial crisis, London: March.

          Greenspan, Alan (2007). The Age of Turbulence: Adventures in a New World, London: Allen Lane the Penguin Press.

          Herbst, Moria. 2013. The bank bailout cost US taxpayers nothing? Think again, The Guardian, 20 may.

          Herrigel, Gray. 1996. Industrial Constructions: the sources of German industrial power, Cambridge: Cambridge University Press.

          Hippachg- Schneider, Ute, Martina Krause and Christian Woll. 2007. Vocational education and training in Germany: short description, Cedefop Panorama series; 138, Luxembourg: Office for Official Publications of the Eropean Communities.

          Holz, Michael. 2013. Main characteristics and competitive strengths of German Mittelstand companies, paper presented at ISTUD Business School & Mediobanca Workshop ‘II Quarto capitalism: modelli di sviluppo aziendale e strategie’, Bavena (Italy), 24 May.

          Jain, L. C. 1929. Indeginious Banking in India, London: Macmillan.

          Jhonson, Simon. 2009. A quiet coup, The Atlantic Monthly, 1 May.

          Kloff, Drik H.A. 1979, ‘A study of land transfers in Mau tahsil, District Jhansi’, pp.53-85 in K. N.Choudhuri Nd Clive Dewey. Eds. Economy and Society: Essays in Indian economic and social History, New Delhi: Oxford University Press.

          Lamoreaux, Noami R. 1986, Banks, Kinship and economic Development: The New England case, The Journal of Economic History, 46(3): 647-667.

          Lillia, Mark. 2013. Arendt and Eichmann, New York Review of Books, 21 November.

          Lohmar, Brigitte and Thomas Eckhardt. Eds. 2013. The Education System in the federal republic of Germany 2011/12, Bonn: Secretariat of the Standing Conference of the Ministers of Education and Cultural Affairs of the Länder in The Federal Republic of Germany, (URL:http://www.kmk.org/fileadmin/doc/Dokumentation/Bildungswesen_en_pdfs/secondary.pdf,accesseson 11.10.14).

          Montesquieu, Charles, Baronde. 2012. My Thoughts, translated from the French, Online Library of Liberty (URL:http://oll., libertyfund.org/title/2534,accessed on 12.10.14)

          Orhangazi, Özgür. 2008. Financialization and capital accumulation of the non-financial corporate sector: A theoritical and empirical investigation on the US economy: 1973-2003, Cambridge Journal of Economics, vol.32: 863-886, doi:10.1093/cje/ben009.

          Paust, Sebatian. 2014. The german Mittelstand – a model for Asia’s emerging economies? 20 June (URL http//www.asiapathways-adbi.org/2014/06/the-german-mittelstan-model-for-asis-emerging-economies/, accessed on 5.9.14)

          Rakoff, Jed S. 2014. The financial crisis: Why have no high-level executives been prosecuted?’, and ‘Reply’, The New York Review of Books, 9 January and 3 April.

          Ray, Mamata. 2004. Path-dependence in the Lending Behaviour of banks with Special reference to the madras Presidency, Unpublished PhD thesis, University of Calcutta.

          Sanyal, M. K. 2004. Peasant paddy Production, Indebtness and Dispossession: a study of Bengal districts (1901-41), New Delhi: Manak Punblications.

          Sen, Amartya. 2009. The Idea of Justice, London: Allen Lane the Penguin Press.

          Shleifer, Anderi. 2000. Inefficient Markets: An Introduction to Behavioural Finance, Oxford: Oxford University Press.

          Sleigh, J. H. 1898. Letter to The Times of India, 17 November, asd cited in Bagchi 1997b, pp.44-45.

          UN ESCSAP. 2014. Asia and the Pacific: A Story of Transformation and resurgence: Economic and Social Survey of Asia and the Pacific 1947-2014, New York: United Nations (Sales No.E.14.II.f.6).

          Wang, Audrey. 2010. Small business make big contribution, Taiwan Today, II May (URL: http//www.taiwantoday.tw/fp.asp?Item= 127151&CtNode=427, accessed on 11.10.14).