বাংলাদেশে বৈশ্বিক ষাটের দশক: সেনা–এলিট প্রহরা ও নিম্নবর্গের প্রতিরোধ

ষাটের দশকজুড়েই ঝাত্র–তরুণেরা ছিল বিক্ষোভ–বিদ্রোহের সামনের সারিতে। ছবি: রশীদ তালুকদার

সারকথা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহাবয়ানে গণআন্দোলন আর জনযুদ্ধ ছিল পরস্পরের পরিপূরক। ষাটের দশকের গণআন্দোলনেরই পরিণতি ছিল মুক্তিযুদ্ধ। এই আন্দোলনের দুই কারিকাশক্তি ছিল ছাত্রছাত্রী ও শ্রমিক। তাদের শত্রু ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের এলিট সেনা-আমলা-জমিদার-বুর্জোয়ার জোট। এদের বিরুদ্ধে ছিল ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্তের জোট। উচ্চবর্গীয় পাকিস্তানি শাসকদের বিপরীতে জাতীয়তাবাদী জোটটি ছিল নিম্নবর্গীয়। কিন্তু এটি শুধু দেশীয় ব্যাপার ছিল না। বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বাংলাদেশের গণআন্দোলন ছিল ষাট দশকে বিশ্বজুড়ে চলা তারুণ্যের বিদ্রোহেরই একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তারুণ্যের ক্রোধ ও আবেগের কাব্য রূপ পেয়েছে বিদ্রোহী মিছিলে, অভ্যুত্থানে, ব্যারিকেডে ও আত্মদানে। ইনসাফ বা সামাজিক ন্যায়বিচার ছিল এসব আন্দোলনের মরণপন দাবি। বৈশ্বিক প্রেক্ষিতের সাথে আঞ্চলিক মাত্রার এই যোগাযোগের কথা কমই আলোচিত হয়। শুভ বসু সেদিকেই বিশ্লেষণী নজর দিয়েছেন এই রচনায়।

গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের

জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট

উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।

(আসাদের শার্ট: শামসুর রাহমান)

তরুণ বামপন্থী কর্মী আসাদের শহীদি মৃত্যুতে কবি শামসুর রাহমান এই অবিস্মরণীয় কবিতা লিখেছিলেন। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে আসাদের মৃত্যুতে যে গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা হয়, তা ঢাকাকে ষাটের বৈশ্বিক বিক্ষোভের অন্যতম ক্ষেত্র করে তোলে। প্যারিস, মেক্সিকো সিটি, বেইজিং, প্রাগ, হ্যানয়, রাওয়ালপিন্ডি অথবা পাশের কলকাতার মতো ঢাকাও মিছিল, ক্রোধ ও বিপ্লবের শহরে পরিণত হয়। পাশ্চাত্যপন্থী ও তথাকথিত আধুনিকায়নবাদী সামরিক একনায়কের বিরুদ্ধে জনতার ক্ষোভের যে বিস্ফোরণ ষাট দশকের গড়ন দিয়েছে, তারও রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস।

বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসনের মূল বিষয় ছিল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শোষণ। বাঙালিরা পাকিস্তানের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র ও শিল্পকারখানার প্রতিনিধিত্বে বাঙালিরা ছিল সংখ্যালঘু। ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট বেঁধে পাকিস্তান সেনা ছত্রচ্ছায়ায় পুঁজিবাদী আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া চালায়। পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠীর বিপুল অনুদান এবং মার্কিন প্রশাসন ও হার্ভার্ডভিত্তিক মার্কিন পরামর্শকদের উৎসাহে ভর করে সামরিক শাসকেরা ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সালের মেয়াদে প্রবৃদ্ধিভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীতি গ্রহণ করে। তা হলেও প্রবৃদ্ধিমুখী এ উন্নয়নকৌশলের সঙ্গে সামাজিক ন্যায্যতার প্রশ্নকে জড়িত করার বিষয়টি গুরুত্ব পেল না। দেখা গেল, ১৯৬১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের ১৭টি শিল্প পরিবারের হাতে রয়েছে শিল্পের স্থায়ী সম্পদের ৩০ শতাংশ এবং বৃহৎ উৎপাদনমুখী খাতের মোট বিক্রীত পণ্যের ২০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের আদমজী, দাউদ, করিম, বাওয়ানি, ইস্পাহানি ও আমিনের মতো ছয়টি প্রতিষ্ঠানের হাতে রয়েছে উৎপাদন খাতের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশ এবং বড় কারখানার উৎপাদিত পণ্যের ৩২ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ। কেবল কলকাতা থেকে আসা ইরানি বংশোদ্ভূত শিল্পগোষ্ঠী ইস্পাহানি ছাড়া বাকি সবাই ছিল করাচিভিত্তিক গুজরাটি অথবা পাঞ্জাবি পরিবার। ১৯৪৯-৫০ থেকে ১৯৬৪-৬৫ সাল—এই ১৫ বছরে পাকিস্তানের শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে বার্ষিক ১৫ শতাংশ হারে। তা হলেও পাকিস্তানিদের প্রকৃত মাথাপিছু আয়ের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১ শতাংশের কম। একই সময়ে দেখা গেছে, ১৯৪৯-৫০ সালে যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ১০ শতাংশ বেশি, সেখানে ১৯৬৪-৬৫ সালে এই ব্যবধান বাড়ে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ স্থানান্তর এবং উন্নয়ন তহবিলের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করার ঘটনা অর্থনীতিকে স্থবিরতার দিকে নিয়ে গেল। ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ২৩ বছরের মেয়াদে পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় বাড়ে মাত্র ২ ডলার।

রাজনৈতিকভাবে, আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র নামের এক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে এসব বৈপরীত্য আড়াল করার চেষ্টা করলেন। ১৯৫৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৪০ হাজার এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৪০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। মৌলিক গণতন্ত্রের আট হাজার ইউনিট সৃষ্টি করা হলো, যাদের কাজ ছিল ১০ জন ভোটারের নির্বাচকমণ্ডলী নির্বাচিত করা, যাঁদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। পূর্ব পাকিস্তানে কারা ছিলেন এই মৌলিক গণতন্ত্রী? গ্রামীণ সমাজ এবং সেই সমাজের ক্ষমতাসোপানে মৌলিক গণতন্ত্রীদের অবস্থানের চিত্র তুলে ধরেছেন রাশিদুজ্জামান। ৩ হাজার ৬৭৫ জন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ৬১ দশমিক ১২ শতাংশ চেয়ারম্যানের বার্ষিক আয় ছিল তখন ৪ হাজার রুপির ওপরে। ২৮ দশমিক ৭৯ শতাংশের আয় ছিল ২ হাজার থেকে ৪ হাজার এবং ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশের আয় ছিল দুই হাজার রুপির কম। এই কালপর্বে গ্রামাঞ্চলের ৮৫ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষের বার্ষিক আয় ছিল ২ হাজার রুপির কম। পূর্ব পাকিস্তানে গ্রামীণ জোতজমির আয়তনের নিরিখে, ৪২ দশমিক ৪০ শতাংশ মৌলিক গণতন্ত্রীর জমির পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৫০ একরের বেশি। ৪০ দশমিক ৪১ শতাংশের জমির পরিমাণ ছিল ৫ থেকে সাড়ে ৭ একর। পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামীণ জোতের গড় আয়তনের সঙ্গে তুলনায় দেখা যায়, মৌলিক গণতন্ত্রীদের ৬২ দশমিক ৮১ শতাংশ ছিল বড় খামারের মালিক। ফলে এই উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে মৌলিক গণতন্ত্রীদের বড় একটি অংশ এসেছিল উদ্বৃত্তধারী কৃষক তথা ধনী কৃষকদের মধ্য থেকে। সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের উচ্চকোটির নেতৃত্বে ধনী কৃষক ও একচেটিয়া শিল্পপতিদের এই জোট পূর্ব পাকিস্তানে অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শোষণের বন্দোবস্ত কায়েম করে।

এর সঙ্গে আরেকটি বুজরকি ধারণা যুক্ত হলো যে বাংলা ভাষা নাকি মুসলিম পরিচয় স্পষ্ট করার উপযুক্ত বাহন নয়। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও উর্দু ভাষার সমান সরকারি মদদ বাংলা ভাষা পায়নি। বাংলা ভাষা বদলে দিতে এবং সমৃদ্ধ ঐতিহ্য থেকে তাকে বিযুক্ত করতে পাকিস্তান রাষ্ট্র বিভিন্ন কায়দা করেছে, এমনকি বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার ও বর্ণমালা পর্যন্ত পরিবর্তনের প্রস্তাব এনেছে।

ষাটের দশকজুড়ে সংগঠিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং সাহিত্য সম্মেলনে পাল্টা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার প্রকাশ দেখা যায়। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি নিবেদিতরা কমিউনিস্টমনা বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে শাসকমহলের বিরুদ্ধে একধরনের সাংস্কৃতিক লড়াই শুরু করেন। গ্রামসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, এই বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রের বৈধতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে একধরনের ‘অবস্থান রক্ষার লড়াইয়ে’ (War of position) অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

বিকল্প বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে এই সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ ক্রমশ নতুন এক ভাষাভিত্তিক জাতির কল্পিত জনসমাজের শক্তি সৃষ্টি করে। গ্রামসি যেমন স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন বিপ্লবী প্রকল্পের মর্মে নিহিত থাকে সংস্কৃতির প্রশ্ন; মানুষের জগৎদৃষ্টি তৈরিতে সংস্কৃতির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ করে, “সংস্কৃতিই গড়ে দেয় সেই জগৎকে বদলানোর উপায় আন্দাজের সামর্থ্য এবং সেই বদলকে সম্ভবপর অথবা কাঙ্ক্ষিত হিসাবে দেখা হবে কিনা তা-ও ঠিক করে দেয় সংস্কৃতি। অথবা সংস্কৃতি মানুষকে পৃথিবীটা দেখতে শেখায় এবং তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ‘পৃথিবীটা বদলে দেওয়ার যে কল্পনাশক্তি মানুষের থাকে তার রসদ জোগায় সংস্কৃতি, অর্থাৎ তাকে গড়েপিটে দেয়। শুধু তাই নয়, এই পরিবর্তন কাঙ্ক্ষিত বা আরাধ্য কি না, তা দেখার চোখও গড়ে দেয় সংস্কৃতি’।”

পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র ঐতিহ্যের সাংস্কৃতিক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে ১৯৬০-এর দশকের সূচনা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনে ঢাকায় তিনটি নাগরিক কমিটি গঠিত হয়। বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ এসব কমিটির কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন। সরকারি চাপ থাকা সত্ত্বেও বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াননি। তবে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের উত্তেজনার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উত্তরাধিকার আবার সংকটের মুখে পড়ে। যুদ্ধের সময় ‘ভারতীয়’ বলে অভিহিত করে পাকিস্তান রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশন বন্ধ করা হয়। এরপর ১৯৬৭ সালে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী খাজা শাহাবউদ্দিনের নির্দেশে রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করা হয় এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে যে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারা পাকিস্তানের ভাবাদর্শবিরোধী। বুদ্ধিজীবীরা মন্ত্রীর এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে নামেন। ২৫ জুন, ১৯৬৭ তারিখে ১৯ জন লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রকর এবং শিক্ষকের বিবৃতি প্রকাশিত হয়। জনমতের চাপে খাজা শাহাবউদ্দিন ঘোষণা দিলেন, রবীন্দ্রনাথের গান পাকিস্তানের চেতনার বিরোধী, এমনটা তিনি মনে করেন না, তবে তাঁর বিবৃতিটিকে আরও স্পষ্ট করতে বলেন যে তিনি কেবল (রবীন্দ্রনাথের) যেসব গান পাকিস্তানি ভাবাদর্শের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক, সেসব নিষিদ্ধ করার চিন্তা করবেন। পূর্ব পাকিস্তানের রবীন্দ্রপ্রেমীরা একে বিজয় বলে বিবেচনা করলেন।

জাতিগত শোষণের প্রতিবাদ হয়ে উঠেছিল নিয়মিত বিষয়।

১৯৬০-এর দশকে ঢাকা শহর ধর্মভিত্তিক সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারী নতুন ধারার সাংস্কৃতিক তৎপরতার উর্বর ভূমি হয়ে দাঁড়ায়। কমিউনিস্ট সাংস্কৃতিক কর্মীরা এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সৃজনী সাহিত্যগোষ্ঠী, ক্রান্তি, উন্মেষ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংসদ এবং উদীচী সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ময়দান প্রসারিত করায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে জনপ্রিয় করে ছায়ানট।

ষাটের দশকজুড়ে কবিতা, উপন্যাস এবং ছোটগল্পের ভাব, বিষয়বস্তু এবং লেখার শৈলীতে রূপান্তর প্রত্যক্ষ করে পূর্ব পাকিস্তান। তবে সবচেয়ে নজরকাড়া পরিবর্তন আসে কবিতায়। নতুন ধারার কবিরা নতুন ধাঁচের চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও কাব্যভাষা ব্যবহার করেন। এঁদের সর্বাগ্রে ছিলেন শামসুর রাহমান, ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, বাংলা কবিতাকে তিনি নতুন মোড়ে দেন। তাঁর জাদুকরি কবিতার ভেতর দিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রমের আটপৌরে নগরজীবন যেমন মহিমাময় হয়ে ওঠে, তেমনি দারিদ্র্যের দুঃখভার, এমনকি ট্রাফিক বাতির মতো মামুলি জিনিসও নাগরিক ও মার্জিত হয়ে ওঠে। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকের সবচেয়ে ব্যঞ্জনাময় রাজনৈতিক কবিতাও তিনিই লিখেছেন। তাঁর ‘আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ শীর্ষক কবিতাটি ছিল ১৯৬০-এর দশকে বিচারপতি হামুদুর রহমান কমিশনের প্রস্তাবের জ্বালাময় প্রত্যাখ্যান। একমাত্র আরবি বা লাতিন হরফে লেখা হলেই কেবল বাংলা ভাষা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে ‘সংহত’ হতে পারে বলে মনে করেছিল ওই কমিশন।

সমালোচকেরা ষাট দশকের পূর্ব পাকিস্তানের কবিতায় ১৯ শতকের ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারের প্রভাব লক্ষ করেছেন। অনেক কবির কবিতাই ছিল দুঃখের ইশতেহার, অনেকেই বোদলেয়ারের মতো বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বর ও শয়তানের মধ্যে সর্বদাই এক লড়াই চলমান আর এর মধ্যে মানুষের অস্তিত্ব অনির্ধারিত। সংবাদ পত্রিকায় ‘ইতিহাসের আরেক নায়ক’ কবিতা প্রকাশ করেন সে সময়ে ছাত্র কবি আসাদ চৌধুরী। কবিতাটি আফ্রিকার নিহত মুক্তিসংগ্রামী প্যাট্রিস লমুম্বাকে নিয়ে রচিত। তৎকালীন এক ছাত্র আজাদ সুলতান আফ্রিকার বুকে সূর্যোদয় শীর্ষক এক কাব্য সংকলন বের করেন। সাহিত্য সমালোচক অরিত্র মজুমদারের ভাষায়, এক বিদ্রোহী কল্পনা তখন বিপ্লবী চেতনাকে জাগ্রত করেছিল।

বাংলা উপন্যাসেও তখন বিষয়বস্তু ও কাঠামোর দিক থেকে অনেক পরিবর্তন আসে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪) ও জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসে গ্রামীণ জীবন, দারিদ্র্য, শ্রেণিশোষণ ও শিক্ষিত তরুণদের হতাশার কথা উঠে আসে। কমিউনিস্ট লেখক-ঔপন্যাসিক সত্যেন সেনের পদচিহ্ন (১৯৬৮) উপন্যাসে গ্রামবাংলার এক হিন্দু–অধ্যুষিত গ্রামের নিরাপত্তাহীনতা এবং সমৃদ্ধি থেকে দারিদ্র্যে পর্যবসিত হওয়ার ঘটনা উঠে আসে। এরপর শহীদুল্লা কায়সারের সারেং বৌ উপন্যাস এক গ্রামীণ নারীর সংগ্রামের কাহিনি উপজীব্য করে রচিত। একদিকে গ্রামের ধনী কৃষকদের ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাস, এই দুইয়ের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই। এসব বিশিষ্ট উপন্যাস সামাজিক রূপান্তর ও শ্রেণিসংগ্রাম, পিতৃতান্ত্রিক দাপট এবং দেশভাগের করুণ পরিণতির কথাও বর্ণনা করে।

চলচ্চিত্রজগতেও এ সময়ে পরিবর্তন আসে। পল্লিজীবনের গল্পের সঙ্গে লোককথার আদল মেশানো চলচ্চিত্র ষাটের দশকে বক্স অফিসে তাৎক্ষণিক আলোড়ন তোলে। আবদুল জব্বার খানের চলচ্চিত্র জোয়ার এলো প্রাকৃতিক ও অতিপ্রাকৃতিকে জড়াজড়ি করে থাকা গ্রামীণ ইসলামের ওপর দৃষ্টিপাত করে। জব্বার খানের এই ছবির বাণিজ্যিক সফলতার পর পরিচালক সালাহউদ্দিন তাঁর আগের শহুরে পটভূমির চলচ্চিত্র থেকে সরে এসে রূপকথার গল্পের দিকে মোড় নেন এবং তৈরি করেন রূপবান চলচ্চিত্র। ভ্রাম্যমাণ যাত্রাপালার ঢঙে নির্মিতি সরল কাহিনির এই ছবি রাতারাতি বক্স অফিসকে কাঁপিয়ে দেয়। চলচ্চিত্রে লোকসাহিত্যের পুনর্জাগরণকে আলজেরীয় উপনিবেশবাদবিরোধী তাত্ত্বিক ফ্রাঞ্জ ফানো ঔপনিবেশিক জাতির নিজ সংস্কৃতির শিকড় আবিষ্কারের প্রতিফলন বলে অভিহিত করেছেন। সে সময়ের বহুমুখী প্রতিভাধারী চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকেও প্রভাবিত করে এসব লোকগাথা। ১৯৬৬ সালে তিনি নির্মাণ করলেন লোকসাহিত্যভিত্তিক আরেকটি চলচ্চিত্র বেহুলা। যদিও গল্পটি ‘হিন্দু’ দেবী মনসাকে নিয়ে হলেও সেলুলয়েডের পর্দায় একে লোকসাহিত্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয় এবং এটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

এই বিবিধ রকম সংযুক্ত ও তর্করত সাংস্কৃতিক বাহাসগুলোর মধ্যে সেসব প্রক্রিয়া চলমান ছিল, যার মধ্য দিয়ে প্রতিরোধের অর্থ উৎপন্ন, প্রোথিত ও মহিমান্বিত হয়। ষাট দশকের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ, তার পদ্ধতি এবং উদ্দেশ্য বুঝতে গিয়ে গবেষকের নিজস্ব সচেতনতা (Reflexitivity) প্রয়োগ করতে গিয়ে বাস্তবে জনপ্রিয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিমূর্ত করে ফেললে রাজনীতি–বিচ্ছিন্ন বয়ান তৈরি হবে। অথচ ওই সব রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বিক্ষুব্ধ ছাত্র, শ্রমিক, নিম্নবর্গীয় সামাজিক শ্রেণিগুলো এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীরা আগ্রাসী পুঁজিবাদ ও অভ্যন্তরীণ উপনিবেশায়ন প্রতিরোধ গড়েছিল। সাংস্কৃতিক ধারাগুলো ছিল গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজের জন্য বৃহত্তর গণভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ, যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অনেকে শহীদ হন।

তাই গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বৈশ্বিক ষাটের দশক পূর্ব পাকিস্তানে আত্মপ্রকাশ করে। এই দশকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের জাতীয় শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও পাকিস্তান সরকারের শিক্ষাসচিব এস এম শরিফের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তানে নিজ খরচে পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাব পেশ করা হয়। তখনো আগ্রাসী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা একাই দাঁড়িয়েছিল। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের পর আসে ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালের পাটকলের শ্রমিকদের ধর্মঘট আন্দোলন। সাবেক বিপ্লবী ছাত্রনেতাদের মধ্যে কাজী জাফর আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো ও রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ঢাকার নিকটে টঙ্গী শিল্পাঞ্চলে বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এরপর ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে একই সঙ্গে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ডাক ও টেলিগ্রাফকর্মীরা আন্দোলন শুরু করেন। চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরের শ্রমিকদের আন্দোলন শুরু হয় মার্চ মাসে। রেলওয়ের কর্মীরা দীর্ঘ সময় ধরে প্রচার-প্রচারণা চালানোর পর ১৯৬৫ সালের ২৭ মে ধর্মঘট ডাকেন। এমনকি হাসপাতালের নার্সরাও ওই মাসেই ধর্মঘট আহ্বান করেন। শ্রমিকশ্রেণির এসব আন্দোলন ছাত্র আন্দোলনকে অর্থবহ করে তোলে। তবে আগ্রাসী শাসনের বিরুদ্ধে এসব আন্দোলন একরৈখিকভাবে বিজয়ের দিকে এগিয়ে গেছে, এমন ভাবা ঠিক নয়। তবে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এসব প্রতিরোধ আন্দোলনে সাময়িক বিরতি টানে।

যুদ্ধের পর ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি শহরে বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি পেশ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে তিনি মধ্যবিত্তের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার-সমর্থিত ছাত্রসংগঠন এনএসএফ অর্থনীতি বিভাগের মার্ক্সবাদী অধ্যাপক আবু আহমেদকে প্রহার করে। এ ঘটনা ছাত্রসমাজকে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের দিকে উসকে দেয়। নিম্নবর্গীয় শ্রেণির মানুষও অর্থনৈতিক দুরবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ শুরু করেন। অটোরিকশার চালকেরা মার্চের ১ তারিখ থেকে ধর্মঘটে যান। এই পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার সমর্থনে ধারাবাহিক কর্মসূচি হাতে নেন। দাবি করেন, পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিব বারবার গ্রেপ্তার হয়ে কারান্তরীণ থাকলেও তিনি ছয় দফার সমর্থনে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। এরপর ৭ জুন তেজগাঁও ও নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকেরা নিপীড়নমূলক ১৪৪ ধারার বিরুদ্ধে ফেটে পড়লে পুলিশ গুলি চালায়। অন্তত ১০ জন শ্রমিক প্রাণ হারান।

১৯৬৭ সালে শ্রমিকদের ধর্মঘটের হুমকি ঢাকা শহর অচল করে দেয়। পাটকলশ্রমিক, স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও পরিবহনশ্রমিকেরা ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিলেন। মাওলানা ভাসানী ২৭ জানুয়ারি পাটচাষিদের সম্মেলনের আয়োজন করেন। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে রেলশ্রমিকেরা টানা ধর্মঘট ঘোষণা করেন। মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে বামপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। ১৯৬৭ সালজুড়ে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিকশ্রেণির বিভিন্ন অংশ শিল্প–ধর্মঘট ঘোষণা করে সামরিক পুঁজিবাদকে চ্যালেঞ্জ করে। বছরের শেষ দিকে ন্যাপ এক বিভক্তির সামনে পড়ে, একই সঙ্গে একদল ভিন্নমতাবলম্বীও আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। সামরিক-আমলাতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদ গতি হারাতে শুরু করে। এ অবস্থায় ১৯৬৮ সালের ৭ জানুয়ারি সরকার আট ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনে। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি সরকার শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য ৩৪ জন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের আওতায় আটক করে। এরপর ১৯ অক্টোবর এক কাউন্সিল সভায় আওয়ামী লীগ মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়। পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট–ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া এবং জনসংখ্যার অনুপাতে নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি তোলে তারা। এসব সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ পরস্পরের কাছাকাছি আসে। এর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্ররা ১৯৬৮ সালের ২৬ নভেম্বর আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে রাওয়ালপিন্ডিতে বিদ্রোহে নেমে পড়ে।

প্রতীকীভাবে আসাদুজ্জামানের শাহাদাতবরণ বৈশ্বিক ষাটের দশকের আন্দোলনের শীর্ষবিন্দু। গণতন্ত্র, সামাজিক রূপান্তর ও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত প্রতিবাদের দশক ছিল এটি। বাংলাদেশের শ্রমিক, ছাত্র, লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এক বিভ্রান্ত সামরিক-গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উন্নয়নের নামে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশের অবসান ঘটিয়েছে।

১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে মাওলানা ভাসানী সর্বাত্মক হরতাল ঘোষণা করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। ৬ ডিসেম্বর জনসভা সফল হলে তিনি গভর্নর হাউস অবরোধ শুরু করেন। এরপর ৮ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে আরেকটি হরতাল পালিত হয়। ১৯৬৮ সালের ১০ ডিসেম্বর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরাচারবিরোধী দিবস পালন করে। ১৪ ডিসেম্বর ঘেরাও আন্দোলনের ডাক দিয়ে ভাসানী আরও অগ্রসর হন। এর উদ্দেশ্য ছিল, রাজনৈতিক কর্মীদের নিয়ে সরকারি কার্যালয় ঘেরাও করে প্রশাসনকে অচল করে দেওয়া। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রসংগঠনগুলো ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে। ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ও ন্যাপসহ (মোজাফফর) আটটি রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি (ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি বা ড্যাক) গঠন করে। এরা সম্মিলিতভাবে ফেডারেল সরকারব্যবস্থা, সর্বজনীনভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন এবং সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি দাবি করে। ১৪ জানুয়ারি ড্যাক নিজ দাবিনামা–সংবলিত সনদ ঘোষণা করে। একই দিনে ভাসানী হাতিরদিয়ায় কৃষক সমাবেশে ভাষণ দেন। ১৭ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে মিছিল বের করে ড্যাক। তবে ছাত্ররা আরও জঙ্গি মিছিল বের করলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। ফলে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সামনের বটতলায় বড় সভা করেন। এরপর ছাত্ররা আবার মিছিল বের করলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। এরপর ছাত্ররা ১৮ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে ধর্মঘট পালন করার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্রদের প্রস্তুতি ভালো ছিল। তাঁরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন এবং রোলার ও কংক্রিটের স্ল্যাব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক বন্ধ করে দেয়। পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করলে শিক্ষার্থীরা ইট-পাথর ছুড়ে মারেন। সংঘর্ষের সময় পিছু হঠতে থাকা পুলিশ বাহিনী গুলি চালালে সেখানেই ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী (মেনন গ্রুপ) আসাদুজ্জামানের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বদলে দেয়। ২৪ জানুয়ারি নিম্নবর্গীয় সামাজিক শ্রেণিগুলো, ছাত্রছাত্রী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালন করেন, বিশাল সভা ও মিছিল আয়োজন করেন। ২৪ জানুয়ারিতে আবার পুলিশের গুলিতে মারা যান নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর। গণতন্ত্রের আন্দোলন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও ভাষাগতভাবে মুক্ত জাতির আকাঙ্ক্ষা অনেক শহীদের সৃষ্টি করে। এই সময়, ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক বাহিনী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারাধীন আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করে। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মোহাম্মদ শামসুজ্জোহাকে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনায় মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহা আরও বেড়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে মাওলানা ভাসানী কর বর্জনের আন্দোলন শুরু করার হুমকি দেন। বড় ধরনের রাজনৈতিক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করে এবং পরদিন শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়। গণ-আন্দোলনের ব্যাপকতায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা, একসময় তাঁদেরও ধৈর্যচ্যুতি হয় এবং ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

প্রতীকীভাবে আসাদুজ্জামানের শাহাদাতবরণ বৈশ্বিক ষাটের দশকের আন্দোলনের শীর্ষবিন্দু। গণতন্ত্র, সামাজিক রূপান্তর ও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত প্রতিবাদের দশক ছিল এটি। বাংলাদেশের শ্রমিক, ছাত্র, লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এক বিভ্রান্ত সামরিক-গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উন্নয়নের নামে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশের অবসান ঘটিয়েছে।

  • শুভ বসু: কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ক্ল্যাসিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। সম্প্রতি তিনি তাঁর আসন্ন গ্রন্থ ইমার্জেন্স অব ইনডিপেনডেন্ট বাংলাদেশ গ্রন্থ সমাপ্ত করার কাজে নিয়োজিত।

    ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন প্রতীক বর্ধন

তথ্যসূত্র

১. [Amzad, Rashid ‘Industrial Concentration and economic power’ in Gardezi, H. & Rashid, J. (ed.) Pakistan: The Roots of Dictatorship. London: Zed Press. 1983 : 232.]

২. [Thomas, John Woodward. ‘Development Institutions, Projects, and Aid: A Case Study of the Water Development Programme in East Pakistan.’ Pakistan Economic and Social Review 12, no.1 (1974): 77-103: 78. Accessed June 22, 2021.]

৩. [Crehan, K. 2002. Gramsci, Culture and Anthropology. 1st ed. University of California Press. p.71]