বাংলাদেশের যুদ্ধ-বিবেক

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ: মেমোয়ারস অব অ্যান অ্যামেরিকান ডিপ্লোম্যাট— আর্চার কে ব্লাড ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড ঢাকা ২০০২, ৩৭৩ পৃষ্ঠা ৪৫০ টাকা

নাইট রাইডার সংবাদপত্রের সমর সংবাদদাতা জোসেফ এল গ্যালওয়ে লিখেছিলেন, ‘আর্চার কে ব্লাড যখন গত মাসে মারা গেলেন, তখন তাঁর শোকের জন্য তাঁর পরিবার, কতিপয় পুরোনো বন্ধু, আর ছিল একটি সমগ্র জাতি। কিন্তু সেই জাতি তাঁর নিজের নয়, সেটা ছিল বাংলাদেশ।’ আর্চার ব্লাডকে তাঁর মার্কিন বন্ধুরা বলেন, আমেরিকান হিরো। আসলে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিবেকের নায়ক। তিনি প্রথমে বাংলাদেশের যুদ্ধবীর। তিনি পরে আমেরিকার বীর। কোলোর ফোর্ট কলিন্সে বাঙালিদের একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সমাধিক্ষেত্রে হাজির হয়েছিল। আর্চার ব্লাডের স্ত্রী মার্গারেট ব্লাড সে সময় বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত মেইলে ভেসে গিয়েছিলেন। ২০০৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কোলোর ফোর্ড কলিন্সের একটি হাসপাতালে আর্টারি স্লোরোসিসে আক্রান্ত হয়ে ব্লাড মারা গেছেন। ১৯৯৩ সাল থেকে তিনি ফোর্ট কলিন্সে বসবাস করছিলেন। মি. ব্লাড মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে ৩৫ বছর কাটান। তাঁর কর্মস্থল ছিল গ্রিস, আলজেরিয়া, জার্মানি, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ভারতে।
আর্চার কে ব্লাডের দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ: মেমোয়ারস অব অ্যান অ্যামেরিকান ডিপ্লোম্যাট একটি অসামান্য স্মৃতিগাথা। তাঁর নিজের কথায়, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমার অম্লমধুর রোমান্সের শুরু ১৯৬০ সালে।’ তখনকার ঢাকাকেও তিনি কখনো বিস্মৃত হননি। এমনকি তাঁর তিন ছেলেমেয়ে (তখন তিন সন্তান) কী করে ঢাকার বুয়াদের কাছে বেড়ে উঠেছিলেন এবং একটি পোষা কুকুরের মৃত্যুতে তাঁর মেয়ে শিরিনের মমতা উথলে ওঠার উপাখ্যান তিনি বিস্তারিত চিত্রিত করেন।

আমেরিকার কূটনীতির ইতিহাসে তাঁর পাঠানো একটি টেলিগ্রাম এতটাই আলোচিত ও তর্কের ঝড় তুলেছে যে তার তুলনা বিরল। এর নামকরণ করা হয়েছে ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’। তাঁর দুই পর্বের ঢাকার জীবনে দুই বন্ধু এ এম এ মুহিত ও গুল্লু তাঁর সারা জীবনকে, তাঁর পরিবারকে স্পর্শ করে রেখেছেন। ২০০২ সালের অক্টোবরে মুহিত লিখেছেন, ‘আর্চারের সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ ঘটেছিল ১৯৬০ সালে। বয়সে আমার চেয়ে ১১ বছরের জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সান্নিধ্য ছিল খুবই অন্তরঙ্গ। তখন ঢাকায় বিদেশি জনসংখ্যা সাকল্যে ১০০ অতিক্রম করেছে। কাকতালীয়ভাবে ১৯৬১ সালে আমার বিয়েতে যে গুটিকয় বিদেশি পরিবার আমন্ত্রিত ছিল, ব্লাডের পরিবার তাদের অন্যতম।’

বাংলাদেশে কূটনৈতিক জীবনের জন্য ব্লাড দুবার পুরস্কৃত হয়েছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সম্মানসূচক মেধা পুরস্কার পেয়েছিলেন সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। এরপর তিনি তাঁর টেলিগ্রামের জন্য পান মর্যাদাসম্পন্ন হার্টার পুরস্কার। সেটা তিনি পেয়েছিলেন ‘উদ্যোগ, অখণ্ডতা, বুদ্ধিবৃত্তিক সাহস ও সৃজনশীল ভিন্নমত’ প্রকাশের অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য। ষাটের দশকের গোড়ায় মার্কিন পেশাদার কূটনীতিকদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু তখনো এর বাস্তব অনুশীলন ছিল বিরল।

১৯৮২ সালে ব্লাড আগাম অবসরে যান। এরপর তিনি আট বছর কাটান এলিগেনি কলেজে। মুহিতের কথায়:

আর্চার ঢাকার সঙ্গে এক গভীর অনুরাগের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং ঢাকার মধ্য দিয়ে তিনি অনুরক্ত হন দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি। ঢাকা ছাড়া তাঁর স্মৃতিময় সময় কাটে কাবুল ও দিল্লিতে। প্রথম আলোয় তাঁর বইটির প্রথম চ্যাপ্টার প্রকাশিত হয় ২০০১ সালের ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে। তাঁর এই সৃজনশীল কর্মে নিয়োজিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম আলো বিরাট ভূমিকা রেখেছে।

মতিউর রহমানকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন মুহিত এভাবেই।

৩৭৩ পৃষ্ঠার এ বইয়ে আর্চার কে ব্লাড অবশ্য মতিউর রহমানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্কার গ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন। ব্লাড লিখেছেন:

ঢাকা থেকে আমার বিদায়ের দিনটিতে মুহিত বনানীতে তাঁর বাড়িতে যেতে গাড়ি পাঠিয়েছিলেন। সেটা বর্তমান মার্কিন দূতাবাস থেকে বেশি দূরে নয়। আমি তাঁর এবং তাঁর নান্দনিক সহধর্মিণী সাবিহার সঙ্গে প্রাতরাশে অংশ নিয়েছিলাম। পরে আমরা মুহিতের সাংবাদিক বন্ধু মতিউর রহমানের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম। তিনি তাঁর বাংলা ভাষার সংবাদপত্র ভোরের কাগজ-এর জন্য আমার সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন।

ব্লাডের ২০০২ সালে প্রকাশিত বইয়ের অন্যতম আকর্ষণ হলো, মুজিব-ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর নির্মোহ রাজনৈতিক মূল্যায়ন। কী প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে আন্দোলন গড়ে উঠল, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ আছে এতে। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ ব্লাড লিখেছিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত টেলিগ্রাম:

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রত্যক্ষ করে আমরা ভয়ানকভাবে আতঙ্কিত, বাকশক্তিহীন। প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণাদি থেকে দেখা যাচ্ছে, সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে আওয়ামী লীগ-সমর্থকদের একটি তালিকা রয়েছে, যাদের তারা পরিকল্পিতভাবে নির্মূল করবে। এ জন্য তারা বাড়ির বাইরে ডেকে এনে গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করছে। তাদের নিধনযজ্ঞের টার্গেটে আরও রয়েছেন ছাত্রনেতা ও বিশ্ববিদ্যালয় অনুষদের সদস্য, বিপুলসংখ্যক এমএনএ (মেম্বর অব ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি) ও এমপিএ (মেম্বর অব প্রোভিনশিয়াল অ্যাসেমব্লি)। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সমর্থনে অবাঙালি মুসলমানরা পরিকল্পিতভাবে দরিদ্র বাঙালি ও হিন্দুদের বাসাবাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। আমেরিকানদের বাসায় বহু বাঙালি আশ্রয় প্রার্থনা করেছে এবং বেশির ভাগই আশ্রয়ের সুযোগ পেয়েছে। আজ জারি করা সান্ধ্য আইনে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এর লক্ষ্য হলো, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তল্লাশি ও ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠবে। ঢাকায় তারা এখনো পর্যন্ত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। আগে কিংবা পরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পরিচালিত নৃশংসতার পূর্ণ বৃত্তান্ত আলোর মুখ দেখবে। তাই বোধগম্য কারণেই পাকিস্তান সরকার অব্যাহতভাবে সব ঠিক আছে মর্মে যে ভুয়া ধারণা যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে দিচ্ছে, সে সম্পর্কে আমি প্রশ্ন তুলছি। ঘরোয়াভাবে হলেও পাকিস্তান সরকারকে আমাদের জানিয়ে দেওয়া উচিত যে নিজ দেশবাসীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংসতায় আমরা বেদনাহত। আমি তথ্যের সূত্র হিসেবে অবশ্যই চিহ্নিত হতে পারি এবং ধারণা করি, পাকিস্তান সরকার আমাকে চলে যেতে বলতে পারে। আমি বিশ্বাস করি না, ঘটনাবলির পরিণামে ঢাকার মার্কিন কমিউনিটির নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। তবে আমাদের যোগাযোগের সামর্থ্য হ্রাস পাবে।

১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ ব্লাড লিখেছেন:

পুরান ঢাকার আমেরিকান পাদ্রিরা জানালেন, কোনো উসকানি ছাড়াই সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়েছে। বাঙালিরা শুধু রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছিল। সেনাবাহিনী সব গুলিবর্ষণের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। কৌশলটা ছিল প্রথমে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া এবং তারপর পলায়নরত মানুষকে গুলি করে হত্যা করা। বিশ্বাস করা হয়ে থাকে, হিন্দুরাই ছিল এই অভিযানের মূল টার্গেট। অবশ্য হিন্দুবিহীন এলাকার বাড়িঘরেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে; আর্মি যদিও বেছে বেছে আওয়ামী লীগারদের হত্যার ভাব দেখাচ্ছে। আসলে হত্যা চলছে নির্বিচারে। আর্মির ধ্বংসযজ্ঞ বেশির ভাগই ঘটে ২৫-২৬ মার্চের রাতে। ২৭ ও ২৮ মার্চে তুলনামূলক কম। ১১ সদস্যের একটি পরিবারের সবাইকে ২৫ মার্চের রাতে হত্যা করা হয়। ভুয়া অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে। অনেকে বলছেন, সম্ভাবনাময় সব বুদ্ধিজীবীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, সরকার কিংবা সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট নয়, এমন একটি পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করেছে আর্মি। আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে নিশ্চিত খবর পাচ্ছি যে সেনাবাহিনী বাড়িতে বাড়িতে লুটতরাজ শুরু করেছে। যারা বাধা দিচ্ছে, তাদের তারা প্রহার করছে। বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা ভীত কিন্তু বিস্ময়করভাবে তাঁরা সৌম্য মনোভাব বজায় রেখেছেন। সেনাবাহিনী সাবেক বাঙালি চাকরিজীবীদের বাড়িতে বিশেষভাবে হানা দিচ্ছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকার কোথাও কোনো পুলিশ চোখে পড়ছে না।

ব্লাড আরও মন্তব্য করেন, ‘সেনাবাহিনী সাধারণভাবে জনসাধারণকে আতঙ্কগ্রস্ত করতে চাইছে এবং প্রতিরোধ এলেই তারা তা স্তব্ধ করে দিচ্ছে। সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচিত সমাজের সম্ভাবনাময় সবাইকেই নিশ্চিহ্ন করা তাদের লক্ষ্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।’

৩০ মার্চ ১৯৭১, ব্লাড এই টেলিগ্রামটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেন। এতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের এফএওতে কর্মরত আমেরিকানরা ২৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। তাঁদের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ইকবাল হলের সশস্ত্র ছাত্রদের উপস্থিতি সেনাবাহিনীকে ক্রোধে অন্ধ করে দেয়। তাঁদের হয় কক্ষে অথবা তাঁরা যখন দলে দলে বেরিয়ে আসছিলেন, তখন পাইকারিভাবে হত্যা করা হয়। তাঁরা প্রায় ২৫টি লাশের একটি স্তূপ দেখতে পান। অন্যদের মরদেহ সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়েছে। সবচেয়ে নৃশংসতা চলে রোকেয়া হলে। এই হলে অগ্নিসংযোগের পর ছাত্রীরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁদের ওপর চলে মেশিনগানের গুলি। ছাত্রীরা ছিল নিরস্ত্র। ৪০ জন নিহত হন। এ হামলার লক্ষ্য ছিল ছাত্রীদের নেতৃত্ব নির্মূল করে দেওয়া। কারণ, সেনাবাহিনীর কাছে খবর ছিল, ছাত্রী কর্মীরা এই হলেই থাকেন। আনুমানিক এক হাজার জন, যাঁদের বেশির ভাগকেই হত্যা করা হয়। উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ফাইল ও নথি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক কতজন মারা গেছেন, তার সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। সরকারিভাবে স্কুল ছিল বন্ধ এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধিকাংশ না হলেও অনেক ছাত্রই চলে গিয়েছিলেন। সেই হিসেবে নিহত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম হওয়ার কথা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাত্রদের কার্যক্রমের মূল ঘাঁটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। সুতরাং অনুমান করা চলে, ২৫ ও ২৬ মার্চের রাতে গোলযোগ শুরুর পর তরুণেরা সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। ক্যাম্পাসে অন্তত দুটো গণকবরের সন্ধান মিলেছে। একটি ইকবাল হলের, অন্যটি রোকেয়া হলের কাছে। ২৯ মার্চের রাতে গুলিবর্ষণের ফলে কিছু মৃতদেহ স্পষ্ট চোখে পড়ে। তা ভয়ানক গন্ধ ছড়ায়। অনেকে বলেছেন, সেনাবাহিনী কাউকে বন্দী করেনি, সবাইকে হত্যা করেছে। আর্মি রেডিও থেকে বলা হয়েছে, কিছু ছাত্র পালাতে সক্ষম হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হাজার ছাত্র নিহত হওয়ার তথ্য আমাদের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে। তবে এখন যে সময় ঢাকায় চলছে, তাতে এর সত্যতা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের উন্নয়নে ১০০ কোটি ডলারের সহায়তা চেয়েছিলেন। এই আলোচনার সাক্ষী ছিলেন আর্চার ব্লাড। পাকিস্তানে নিযুক্ত তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোসেফ ফারল্যান্ডের সঙ্গে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর বৈঠক হয়েছিল একাত্তরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল নয়টায়। ফারল্যান্ডের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এমনভাবে আলাপ-আলোচনা করছিলেন, যাতে স্পষ্টতই মনে হয়েছে, তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় কল্পনা করেছেন এবং সেই বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কীভাবে পা ফেলে চলবে, তা নিয়ে তিনি ফারল্যান্ডের সঙ্গে মতবিনিময় করেছিলেন। ফারল্যান্ড বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়ে থাকে। শেখ মুজিব তখন বললেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি আমাকে এক বিলিয়ন ডলার দেয়, আমি সে ক্ষেত্রে এমন এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলব, যা হবে গণতন্ত্রের জন্য এক দুর্গ।’

সবচেয়ে লক্ষণীয় হচ্ছে, ব্লাড তাঁর টেলিগ্রামে মুজিব-ফারল্যান্ডের এক ঘণ্টার বেশি স্থায়ী বৈঠকের উপসংহার টানতে গিয়ে ‘প্রশ্নটি যদিও মুজিব করেননি, কিন্তু তাঁর একটি উত্তর অবশ্যই প্রস্তুত করা উচিত’ মর্মে একটি গভীর ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেন। বিষয়টি হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ব্লাড লিখেছেন, ‘আমরা যা ভাবছি, তার চেয়ে দ্রুততম সময়ে এর উত্তর প্রস্তুত করার প্রয়োজন পড়বে। আমি অবশ্য অনুমান করেছিলাম যে মুজিব যখন এ বিষয়টি নিয়ে আদ্যোপান্ত এত কথাই বললেন, তখন তিনি হয়তো স্বীকৃতির (স্বাধীন বাংলাদেশের) বিষয়টিও তুলতে পারেন। যা হোক, তিনি তা করলেন না। বিদায় নেওয়ার আগে মুজিব ফারল্যান্ডকে বললেন, “আমি শুধু নিজের তরফ থেকেই আপনাকে আশ্বস্ত করছি না, একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলাম।”’ ব্লাডকে অধ্যয়ন করলে পাঠক মানসে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে একটি সত্য, যে সত্য মিসেস ব্লাড আমাদের স্বাধীনতার ৪০তম বার্ষিকীতে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।

৮৬ বছর বয়স্ক মিসেস ব্লাড ২০১১ সালের ২৪ মার্চ লিখেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীতাসংগ্রামের বিজয়ের লগ্নে ব্লাড দেখেছিলেন, বাংলাদেশে সূর্যোদয় ঘটছে। এই সূর্যোদয়ের দিনক্ষণ ও পরম্পরা নিয়ে বাংলাদেশ রাজনীতিতে অনেক বিতর্ক, অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব। কিন্তু ব্লাড ছিলেন অকপট, দূরদর্শী। মিসেস ব্লাড যে মন্তব্য করেছেন, তার সত্যতা আমরা দালিলিকভাবে পাই। এখানেই ব্লাডের বাংলাদেশ-ভাবনার চমত্কারিত্ব। আমরা দেখি, তিনি সেই ষাটের দশক থেকে বাংলা নামের একটি ভূখণ্ডের স্বাধীন সত্তার সুলুকসন্ধানে নিষ্ঠাবান ছিলেন এবং ন্যায্যভাবেই তিনি বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন।

ব্লাড সত্তরের নির্বাচনে এক জনসভায় তা ফুটিয়ে তোলেন এভাবে। তারিখ ২৮ অক্টোবর ১৯৭০। আধ ঘণ্টার ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা (মুজিব) বাঙালিদের দুঃখ-কষ্টের একটি তালিকা পুনর্ব্যক্ত করেন এবং আওয়ামী লীগের ছয় দফা গ্রহণের মধ্য দিয়ে তা প্রতিকারের আহ্বান জানান।

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লির ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি লাভ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ১৩৮টি আসন। জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৮১টি আসন লাভ করে। আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনের তিন দিন পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ঢাকায় নিম্নোক্ত নির্দেশনা পাঠান: ‘ভুট্টোর সাফল্যের কারণে আমাদের অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অসন্তোষের কোনো ইঙ্গিত কিংবা মুজিবের কারণে কোনো সরকারি সন্তুষ্টি প্রকাশ পরিহার করতে হবে।’

ভুট্টো জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসতে চাননি এই যুক্তিতে যে মুজিবের ছয় দফা সমগ্র পাকিস্তানের জন্য কার্যকর নয়। ১৯৭১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সংবাদ সম্মেলনের ওপর ঢাকার মার্কিন মিশনের প্রতিবেদন ছিল এ রকম: ‘মুজিব ছয় দফায় বর্ণিত বৈদেশিক সাহায্য ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর প্রাদেশিক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে তাঁর অবস্থান তুলে ধরলেন, ইসলামাবাদে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সরকার যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে। বাংলা দেশের ওপর ঔপনিবেশিক বঞ্চনার জন্য এই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে মুখ্য উপাদান। বাংলা দেশকে (তখন বানান এভাবে লেখা হতো) অবশ্যই ছয় দফায় বর্ণিত স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে এবং তাঁর প্রতিনিধিরা এর ভিত্তিতেই নির্বাচিত হয়েছেন, মুজিব তা পুনর্ব্যক্ত করেন।’ এ সম্পর্কে ব্লাড মন্তব্য করেছিলেন:

সংবাদ সম্মেলনের বিবরণে বহু বছরের ব্যবধানে আমাকে একটি বিষয় খুবই বিস্মিত করেছে, সেটা হলো মুজিব পূর্ব পাকিস্তান শব্দটির পরিবর্তে বারবার বাংলা দেশ শব্দটি ব্যবহার করছিলেন। আমি স্মরণ করতে পারি না যে এর আগে তিনি প্রকাশ্যে বাংলা দেশ কথাটি ব্যবহার করেছিলেন কি না। মুজিব এটা করে থাকতে পারেন এই বিবেচনায় যে, তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন: পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অব্যাহত ইউনিয়নের আরেকটি বিকল্প আছে।

১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে ব্লাডের আরেকটি মন্তব্য ছিল, ‘আমরা নিশ্চিত যে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে স্বাধীনতা।’

২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ফারল্যান্ডের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে ব্লাড তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘তিনি (মুজিব) নাটকীয়ভাবে উল্লেখ করলেন যে তিনি কারাগারে যেতে কিংবা তাঁকে টুকরো টুকরো করে ফেলার ভয়েও ভীত নন। তিনি কোনোক্রমেই তাঁর জনগণের পরম অভিপ্রায় হিসেবে ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের ম্যান্ডেট থেকে বিচ্যুত হবেন না।’

ইয়াহিয়া ১৯৭১ সালের ১ মার্চের ভাষণে ৩ মার্চে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। ব্লাড এ বিষয়ে লেখেন:

পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণকে যা গভীরভাবে হতাশ, আহত ও সংক্ষুব্ধ করে তুলেছে, তার অতিপ্রাক্কলন করা কঠিন হবে। তারা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘটনাকে নির্বাচনী বিজয়ের ফল প্রত্যাখ্যানে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না। তাদের অসন্তুষ্টির ব্যাপ্তি বিবেচনায় নিয়ে আমরা স্পষ্টত অনুভব করতে পারি যে ইয়াহিয়ার পদক্ষেপের ফলে স্বাধীনতার মুহূর্তকে অধিকতর ঘনিষ্ঠ করেছে।

একাত্তরের মার্চে বাংলার জনগণ ও বঙ্গবন্ধু সত্যিকার অর্থেই একটি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ জনপ্রশাসন কায়েম করেছিলেন; কোনো লিখিত বা কড়া নির্দেশের দরকার পড়েনি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণের দ্বারা জনগণ কর্তৃক জনগণের সরকার কায়েম হয়েছিল। অসহযোগ ও হরতাল শুরু হলো। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের অফিস-আদালত, ব্যাংক, পরিবহন—সবকিছুই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে শুরু করল। ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ ইয়াহিয়া কঠোর ভাষার বিবৃতিতে ঘোষণা করলেন, যেকোনো মূল্যে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা হবে। তিনি আরও ঘোষণা দেন যে জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন বসবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ।

১৯৭১ সালের ৬ মার্চ ইয়াহিয়ার ভাষণের পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে নিম্নোক্ত ‘গোপন’ নির্দেশনা আসে:

আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষে বিকল্পগুলোর উচ্চপর্যায়ের পর্যালোচনার ভিত্তিতে বিকল্পগুলো উন্মুক্ত রেখেছি, এই ধারণার বশবর্তী হয়ে (ক) একাত্তরের ৭ মার্চ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার একতরফা ঘোষণা ইউডিআই (ইউনিলেটারাল ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স) দিয়েছেন। (খ) ইয়াহিয়া তাঁর ৬ মার্চের বিবৃতিতে স্পষ্টতই পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় সশস্ত্র শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিয়েছেন।

মার্চের গোড়ায় ঢাকার কনসাল জেনারেলের মূল্যায়ন ছিল, ‘ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ ও শেখ পূর্ব পাকিস্তানের ডি ফ্যাক্টো অথরিটি হয়ে উঠলেন।’ এদিকে অখণ্ড পাকিস্তানের ধারণা অব্যাহতভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকল।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস নিম্নোক্ত মূল্যায়ন করল, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত (ইমানসিপেশন) করতে মুজিবের লক্ষ্য অপরিবর্তিত থাকল। এর অর্থ হতে পারে, ছয় দফার অধীনে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। এর অর্থ হতে পারে এই যে মুজিব বিশ্বাস করছেন, যে স্বাধীনতা তিনি চিন্তা করেছিলেন, তা শুধুই সরাসরি স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়েই লাভ করা সম্ভব।’

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে বাংলাদেশের নতুন পতাকা ঢাকা এবং দেশের অন্যত্র ওড়ানো হলো। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার পূর্বনির্ধারিত রাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল। ব্লাড তাঁর নামকরণ করেছিলেন ‘নাইট অব ইনফেমি’ বা ‘কলঙ্কিত রাত’।

আর্চার ব্লাড নিক্সন ও কিসিঞ্জারকে নিশ্চয় ভালো জানতেন। কিন্তু তিনি জানতেন না, চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের গোপন কূটনীতি। সাধারণভাবে তাঁর বিবেচনায় ছিল উপমহাদেশে সোভিয়েত প্রভাব ঠেকাতে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়ার নীতি তাঁরা অনুসরণ করেছিলেন। ব্লাড ও তাঁর কুড়ি সমর্থক মার্কিন নিঃশব্দতার নিন্দা করেন। তাঁরা বলেছিলেন, ‘এই সংকটে যেমন আমাদের নৈতিক স্বার্থ ব্যাপকভাবে সংজ্ঞায়িত নয়, তেমনি আমাদের জাতীয় স্বার্থ সংকীর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত।’ ব্লাড তাতে কেবল সই-ই দেননি, তিনি তার সঙ্গে একটি নোট জুড়ে দেন। ভবিষ্যদ্রষ্টার মতো লেখেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, পূর্ব পাকিস্তানে এখন যে সংগ্রাম চলমান রয়েছে, তার সম্ভাব্য যৌক্তিক পরিণতি হলো বাঙালিদের বিজয় এবং এর পরিণতিতে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।’ তিনি যথেষ্ট জোরালোভাবে যুক্তি তুলে ধরেন যে সম্ভাব্য পরাজয় বরণকারীর অনুকূলে যেন একতরফা সমর্থনের অনমনীয় নীতি অনুসরণ না করা হয়।

নিক্সন ইয়াহিয়া খানকে বাঙালিদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসার জন্য উত্সাহদানের চেষ্টা করেছিলেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ কলকাতার মার্কিন মিশনের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু এখন তার বিস্তারিত জানা যাচ্ছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট তাঁর নিজের প্রশাসনসহ সবার উদ্দেশে লেখা নিক্সনের হস্তাক্ষর আমরা দেখতে পাই। যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘এই সময়ে ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি কোরো না।’ সুতরাং একাত্তরের পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে মার্কিন প্রশাসনের কোনো কিছুই করার সুযোগ ছিল না।

মার্কিন সমর সংবাদদাতা গ্যালওয়ের লেখা থেকে আমরা এক অকুতোভয়, সত্যনিষ্ঠ ব্লাডের দেখা পাই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিবরণ যখন বিশ্ব জানছিল, তখন সেটা মোকাবিলায় ইয়াহিয়া প্রশাসন উদ্যোগ নিয়েছিল। তারা কতিপয় বিদেশি সাংবাদিককে কঠোর নিরাপত্তায় যুদ্ধ-উপদ্রুত পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে এসেছিল। তারা বলেছিল, ওই সব হত্যাযজ্ঞ প্রকৃতপক্ষে অবাঙালি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বাঙালি হিন্দুরা পরিচালনা করেছিল। তবে ওই সাংবাদিক দলের সফর শেষে অন্য পক্ষের কথা শুনতে না দিয়েই তাদের পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গ্যালওয়ে ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁর কথায়, ‘আমি ছিলাম সেই সাংবাদিক দলে। সফরের শেষে আমাদের একটি প্রাচীন ক্রপ-ডাস্টার প্লেনে (যেটা আক্ষরিক অর্থেই ডিডিটি ছিল) উঠানো হলো, আর আমি তখন নির্বিকারভাবে ঘোষণা করলাম, আমি ভয়ংকরভাবে অসুস্থ, মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। এভাবে আমি পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানাই। আমি যখন হোটেল ত্যাগ করেছিলাম, নিরাপত্তা ছিল যথেষ্ট। সুতরাং, রাস্তায় প্রকাশ্যে কারও সাক্ষাত্কার নেওয়া ছিল বিপজ্জনক।’

গ্যালওয়ে লুকিয়ে মার্কিন কনসুলেটে যান। সেখানে তিনি আর্চার ব্লাডের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। ব্লাড তাঁকে বলেছিলেন, তিনি সরকারিভাবে ওয়াশিংটন কর্তৃক ‘নীরবতা’ পালনে আদিষ্ট হয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেভাবে অব্যাহতভাবে বাঙালিদের নিধন করে চলছে, সে ব্যাপারে তাঁর সন্দেহ সম্পূর্ণরূপে সঠিক। ব্লাড বলেন, তিনি কথা বলতে পারেননি, কিন্তু তাঁর কনসুলেটে বিপুলসংখ্যক বাঙালি স্টাফ রয়েছেন। তিনি একটি অফিসের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, আপনার যতক্ষণ প্রয়োজন হয়, আপনি সেখানে অবস্থান গ্রহণ করুন। সেখানে আমাদের স্টাফদের মধ্যে যাঁরা তাঁদের কাহিনি বর্ণনা করতে চান, তাঁরা সেখানে আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। গ্যালওয়ে লেখেন, ‘সেই দিনটির অধিকাংশ সময়জুড়ে আমি তাঁদের কথা শুনেছিলাম। পুরুষ ও নারী তাঁদের বৃত্তান্ত বলেছিলেন। তাঁরা কাঁদছিলেন। যখন তাঁরা বলছিলেন, কীভাবে তাঁদের মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন এমনকি শিশুদের হত্যা করা হয়েছে ঢাকায়, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে। চা-বাগানেও কীভাবে তাঁরা হত্যার শিকার হয়েছিলেন, তাঁরা এর বিবরণ দেন।’

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ব্লাডের অবস্থানের কারণে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বিভক্ত হতে পেরেছিল। কারণ, তারা ব্লাডকে অবিশ্বাস করেনি। তার প্রভাব পড়েছিল মার্কিন কংগ্রেস ও সিনেটে। মার্কিন জনমত গঠনে নিঃশব্দে যে ব্যক্তি অসামান্য ভূমিকা রাখেন, তিনি ব্লাড। বিশ্ববাসী ব্লাডের টেলিগ্রামের ভাষ্য জেনেছে বিদেশি সাংবাদিকদের কারণেই। আর এর পেছনেও ছিলেন ব্লাড। সাংবাদিকদের অনেকে তাঁদের রিপোর্ট পাঠাতে মিশনের যন্ত্র ব্যবহারেরও সুযোগ পেয়েছিলেন তাঁরই কারণে। গ্যালওয়ে লিখেছেন, ‘ঢাকা থেকে আমাকে বহনকারী বিমানটি ত্যাগ করল, তখনই আমি আমার লিড স্টোরির সূচনা কী হবে, তা মনে মনে ঠিক করি। আজও তা আমার স্মরণে আছে, ভীতি, আগুন ও তরবারিই হলো একমাত্র বিষয়বস্তু, যা এই মুহূর্তে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে একত্র করে রেখেছে।’ গ্যালওয়ে বলেন, ‘আমি আর্চার ব্লাডকে আর কখনো দেখিনি। কিন্তু তাঁর চেয়ে বেশি সাহসী ও অকপট কূটনীতিক আমি আর কখনো দেখিনি। সেই ঘটনার বেশি দিন পরে নয়, তাঁকে ওয়াশিংটনে তলব করা হয়েছিল। তাঁকে রাখা হয়েছিল ডগ-হাউসে, যতক্ষণ নিক্সন ছিলেন হোয়াইট হাউসে।’

২০০৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটন পোস্টের স্টাফ রাইটার জো হোলে লিখেছেন, ‘আর্চার কেন্ট ব্লাড ও তাঁর অনুসারীরা অভিযোগ করেছিলেন, “আমাদের সরকার গণতন্ত্র স্তব্ধ করার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা তাদের নাগরিকদের সুরক্ষায় বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান-শাসিত সরকারকে তারা প্রশ্রয় দিয়েছিল। আমাদের সরকার এমন কিছুর প্রমাণ রেখেছে, যা অনেকের বিবেচনায় নৈতিক দেউলিয়াপনা হিসেবে বিবেচিত হবে। পরিহাস হলো, সেটা এমন একটা সময়ে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের কাছে গণতন্ত্র রক্ষায় বার্তা প্রেরণ করেছে।”’

২০০১ সালে প্রকাশিত দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার বইয়ে ক্রিস্টোফার হিসেনস ব্লাডের কেব্ল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সবচেয়ে প্রকাশ্য এবং সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষায় লেখা এমন একটি স্মারক, যা কিনা পররাষ্ট্র দপ্তরের অধীনস্থ ব্যক্তিরা লিখেছেন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্তাদের কাছে। এর কোনো নজির নেই।’

রাষ্ট্রপতি রিচার্ড এম নিক্সন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার চীনের কাছে পৌঁছানোর পেছনের দরজা হিসেবে তখন পাকিস্তানকে ব্যবহার করছিলেন। তাঁরা অবিলম্বে মি. ব্লাডকে তলব করলেন ওয়াশিংটনে। যদিও বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর আরও ১৮ মাস চাকরি করার কথা ছিল। কিন্তু আর কখনোই তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়নি। বরং পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবসম্পদ দপ্তরে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। সরকারি সূত্রগুলো ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছে, পরের বছর পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ডের বিবরণসংবলিত সেই সময়ের প্রতিবেদনগুলো অবিশ্বাস করা হয়েছিল। পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা ওই সময়ের বার্তাগুলোকে ‘শঙ্কাপ্রচারক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এতে তাঁর পেশাদারি জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৮২ সালে আর্চার ব্লাড ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছিলেন, ‘আমি আমার ভিন্নমতের জন্য মূল্য দিয়েছি। কিন্তু আমার সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। কারণ, ভুল ও শুদ্ধের মধ্যে ব্যবধানরেখা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট।’

মি. ব্লাড জন্মগ্রহণ করেছিলেন শিকাগোয়। ভার্জিনিয়ার লিঞ্চবার্গের হাইস্কুল থেকে তিনি গ্র্যাজুয়েশন করেন। ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন। ১৯৬৩ সালে তিনি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে তিনি একজন নৌ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন ১৯৪৭ সালে। তাঁর পেশাগত কূটনৈতিক জীবনের শেষ ধাপে তিনি ছিলেন আফগানিস্তানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত এবং দুই দফায় নয়াদিল্লির মার্কিন দূতাবাসে তিনি চার্জ দি অ্যাফেয়ার্সের দায়িত্ব পালন করেন। অবসর নেন ১৯৮২ সালে। অবসরকে ব্লাড বলেছেন ‘স্ব-আরোপিত নির্বাসন’। এ সময় তিনি ছিলেন কারলিসলেতে অবস্থিত ইউএস আর্মি ওয়ার কলেজের কমান্ড্যান্টের কূটনৈতিক উপদেষ্টা। আলগেনি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে প্রফেসর ইমেরিটাসও ছিলেন।

মৃত্যুকালে তিনি ফোর্ট কলিন্সে তাঁর স্ত্রী (৫৬ বছর ধরে) মার্গারেট মিলওয়ার্ড ব্লাড, চার সন্তান—ফোর্ট কলিন্সে শিরিন আপডেগ্রাফ, ডেনভারে বারবারা র্যাঙ্কিন, আলেকজান্দ্রিয়ায় পিটার ব্লাড, ওহাইওতে আর্চার ব্লাড শাকের হেইটস, তিন বোন এবং আট নাতি-নাতনি রেখে গেছেন।

নাটকের তিন চরিত্র

স্বাধীনতাপূর্ব রাজনীতির তিন চরিত্র চিত্রণে আমরা ব্লাডের অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাই। ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি বলেন, ‘আমাদের নাটকের এঁরাই তিন মুখ্য চরিত্র।’

জেনারেল ইয়াহিয়া খান

ব্লাড লেখেন, তখন তাঁর বয়স ৫৩। তাঁর পূর্বসূরি আইয়ুবের চেয়ে কোনো দিক থেকেই তিনি চিত্তাকর্ষক ছিলেন না। দেখতে ছোটখাটো স্থূল দেহ, মেদবহুল কালো ভ্রু। তিনি তাঁর চুল নিয়ে গর্বিত ছিলেন।

১৯৫৮ সালে জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা প্রথম সামরিক শাসন জারি করেছিলেন। কিন্তু তিনি যে ধরনের নাটক করেছিলেন, সেই নাটকের সঙ্গে পরবর্তীকালের স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক নাট্যমঞ্চের মিল-অমিল খুঁজে দেখতেও পাঠককে হয়তো টানবে। ব্লাড লেখেন, জেনারেল মির্জা ক্ষমতা নিয়েই তাঁর প্রতিপক্ষ সহকর্মীদের পর্যুদস্ত করতে উদ্যোগী হন। যে চারজনকে গ্রেপ্তার করেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন ইয়াহিয়া খান। ইস্কান্দারকে পদানত করতে তাঁর সামরিক সহকর্মীরা তাঁকে অবশ্য ফাঁসি দেননি, নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন লন্ডনে। ইয়াহিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানদের হাতে ধরা পড়েন। কিন্তু পালিয়ে ফ্রান্সে যেতে পেরেছিলেন। ব্লাড লক্ষ করেছেন, যুদ্ধকালে তিনি ক্যাপ্টেনের পদমর্যাদার ওপর উঠতে পারেননি। এটা ছিল তাঁর কাছে বিস্ময়কর। ইয়াহিয়া পছন্দ করতেন এটা বলতে যে পারস্যের নাদির শাহ ছিলেন তাঁদেরই পূর্বপুরুষ। ১৭৪০ সালে নাদির শাহ দিল্লি করায়ত্ত করেছিলেন। ময়ূর সিংহাসন ও কোহিনূর লুট করেছিলেন। ইয়াহিয়া নামটি এসেছে আরবি ঘরানার ‘জন’ থেকে। দেশভাগের সময় পাকিস্তানের ছিল একজন মেজর জেনারেল, দুজন ব্রিগেডিয়ার ও ছয়জন কর্নেল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম দুই কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন ব্রিটিশ। ১৯৫১ সালে আইয়ুব প্রথম পাকিস্তানি কমান্ডার ইন চিফ হন। ৩০ বছর বয়সে ইয়াহিয়া ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। এর কয়েক বছর পর তিনি একটি পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন। ১৯৫১ সালে আইয়ুব খান যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম কমান্ডার ইন চিফ হন, তখন ইয়াহিয়া ছিলেন ডেপুটি চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ। আইয়ুব তাঁকে আর্মি প্ল্যানিং বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান করেন। এই বোর্ড পরবর্তী কয়েক বছরে সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ পুনর্গঠিত করে। আইয়ুবের কমান্ডার ইন চিফ হওয়া এবং ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর শীর্ষ ইনার সার্কেলে প্রবেশের কয়েক বছরে সংসদীয় পদ্ধতি পাকিস্তানে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনী—এই দুটো জাতীয় প্রতিষ্ঠান পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা তাদের ওপর ক্রমেই নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা, যিনি ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে নিয়োগ করা পলিটিক্যাল সার্ভিসের একজন সদস্য, তিনি সামরিক ফরমান দিয়ে সংবিধান বাতিল করেন। জাতীয় ও প্রাদেশিক অ্যাসেমব্লির বিলোপ ঘটান। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। মির্জা যখন সেনাবাহিনীর সমর্থন চান, আইয়ুব তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেন এবং তাঁকেই সামরিক আইন প্রশাসক হতে প্রস্তাব করেন। আইয়ুবের মতে, মির্জা অনতিবিলম্বে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিন জ্যেষ্ঠ জেনারেলকে গ্রেপ্তারে উদ্যোগী হন। যাঁদের একজন ছিলেন ইয়াহিয়া। আর্মি হাইকমান্ড একত্র হয়, মির্জাকে নির্বাসনে পাঠায় লন্ডনে এবং আইয়ুব রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। ১১ বছর পর ইয়াহিয়া তদানীন্তন কমান্ডার ইন চিফ আইয়ুবকে গদিচ্যুত করেন এবং নিজেকেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। প্রথম বছরে ইয়াহিয়া ভালোই করেছিলেন। তিনি উল্লেখযোগ্য কোনো ভুল করেননি। পাকিস্তানের উভয় অংশের রাজনীতিকদের প্রতি সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বিরক্ত ছিলেন। কিন্তু এ সময়টায় ইয়াহিয়া সেটা বুঝতে পারেন। তিনি তা লুকাতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাজনীতিকেরা ইয়াহিয়াকে কিছু সময়ের জন্য বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি বেসামরিক সরকারের উত্তরণে আন্তরিক রয়েছেন।

জুলফিকার আলী ভুট্টো

ব্লাড লিখেছেন, জুলফিকার আলী ভুট্টো আক্ষরিক অর্থেই রুপোর চামচ মুখে দিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৯২৮ সালে তাঁর জন্ম। ধনাঢ্য স্যার শাহনেওয়াজ খান ভুট্টো ব্রিটিশ রাজের কাছ থেকে খেতাব পেয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভুট্টো পড়তে গিয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি সেখানে অর্থনীতি, জনপ্রশাসন, ইতিহাস ও ফরাসি ভাষা রপ্ত করেন। তিনি যদিও খুব মনোযোগী ছাত্র ছিলেন না, কিন্তু তিনি বিতার্কিক দলে ভালো করেছিলেন। পরে অক্সফোর্ড থেকে আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। দেশে ফিরে খুব সহজেই তিনি আসন করে নেন রাজনীতিতে। তিনি ছিলেন উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয়। তাঁর অভিলাষ ছিল অপ্রতিরোধ্য। আর পশ্চিম পাকিস্তানি এসটাবলিশমেন্টে তিনি ছিলেন একজন চার্টার মেম্বর বা বনেদি সদস্য। তাই তিনি যে প্রায় শীর্ষ থেকে শুরু করেছিলেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। ৩০ বছর বয়সে বাণিজ্যমন্ত্রী হন। পরবর্তী পাঁচ বছরে যথাক্রমে কাশ্মীরবিষয়ক, তথ্য, জ্বালানি, শিল্প ও জাতীয় সম্পদবিষয়ক মন্ত্রী হন। ৩৭ বছরে আইয়ুবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন ভুট্টো। কাশ্মীর প্রশ্নে বেপরোয়া নীতি গ্রহণে আইয়ুবকে উত্সাহিত করেছিলেন তিনি। এর পরিণতিতে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় পাকিস্তান। আর আইয়ুবের ঘটে পতন। আইয়ুবের প্রতি ভুট্টোর আনুগত্য ছিল স্বল্পস্থায়ী। আইয়ুব ঝামেলায় জড়ানোর পর ১৯৬৬ সালের গোড়ায় ভুট্টোকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলেন। কিছুকাল বিরতি দিয়ে ভুট্টো একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম দেন; যার ঘোষিত লক্ষ্য হলো আইয়ুব সরকারের পতন। ভুট্টো ১৯৭১ সালে যে চালটা দিয়েছিলেন, সেই একই চাল তিনি তখনো খেলেছিলেন। তাঁর ধূর্ততা ও অসততার সামর্থ্য ছিল যথেষ্ট। যে জাহাজকে গন্তব্যে যেতে তিনি নির্দেশনা দেন, আবার সেখান থেকেই ঝাঁপ দিয়ে পড়েন। এতে জাহাজের ক্যাপ্টেন বিপন্ন হন। আর তখন ভুট্টোই সেই জাহাজের নতুন ক্যাপ্টেন হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি পিপিপি গঠন করেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক অভিলাষ রূপায়ণের জন্য। এ দলটির স্লোগান ছিল, ‘ইসলাম আমাদের বিশ্বাস, গণতন্ত্র আমাদের পলিটি (রাষ্ট্রস্থিতি), সমাজতন্ত্র আমাদের অর্থনীতি’। প্রতিষ্ঠাতার মতোই পিপিপি ছিল স্ববিরোধিতায় ভরা। একসঙ্গে বামপন্থী ও জনপ্রিয় দর্শনে হাওয়া দেওয়ার পাশাপাশি পিপিপি সমাজের সম্পদশালী ভূস্বামীদের সমর্থন পেয়েছিল। ভুট্টো ছিলেন তাঁদেরই প্রতিনিধি। ভুট্টো ছিলেন একজন চমত্কার বাগ্মী। সে কারণে ভূমি সংস্কারের প্রতি দরিদ্র চাষিদের ব্যাপক সমর্থন জয় করতে পেরেছিলেন। শিল্পপতিদের ক্ষমতার লাগাম টানতে তিনি শিল্প জাতীয়করণ করেছিলেন। আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা খর্ব করতে প্রশাসনিক সংস্কার এনেছিলেন। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে, আইয়ুব তখন ছাত্রবিদ্রোহে উসকানি দেওয়ার দায়ে ভুট্টোকে কয়েক মাস বন্দী রাখেন। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভুট্টো ছাড়া পান। ওই সময় আইয়ুব তাঁর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন অবদমনের ব্যর্থ চেষ্টায় অনেককেই কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। ভুট্টো এমনভাবে চলাফেরা করতেন, যাতে তাঁকে বিশ্বের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি মনে হয়। বিশেষ করে, তিনি যখন পূর্ব পাকিস্তানে আসতেন, তখন তিনি স্যুট পরতেন। দেখাতে চাইতেন, তিনি পাশ্চাত্যে শিক্ষিত। এক অর্থে ভুট্টো অনেক সময় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কনিষ্ঠ সংস্করণ হিসেবে নিজকে জাহির করতেন। যদিও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ তাঁর চেয়ে অনেক বেশি রক্ষণশীল ও মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। উভয় নেতা উর্দু বলতেন। তবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন ইংরেজি বলতেই। উভয় নেতার ছিল অভিন্ন মনন। একজন চেয়েছেন উপমহাদেশে মুসলিম রাষ্ট্রের সৃষ্টি। ভুট্টো চেয়েছেন নিজেকে শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে যেতে।

শেখ মুজিবুর রহমান

ব্লাড একটি প্রশ্ন রেখে নিজেই তাঁর জবাব দিয়েছেন। তাঁর প্রশ্ন ছিল, ইয়াহিয়া যদি ভুট্টো ও মুজিবের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে বাধ্য হতেন, তাহলে তিনি কাকে নিতেন? ব্লাড বলেছেন, সত্তরের নির্বাচনের পরপরই এক সংক্ষিপ্ত টেলিগ্রামে এই প্রশ্ন আমি নিজেই নিজেকে করেছিলাম। প্রশ্নটি ছিল, সম্ভবত সামনের মাসগুলোয় এই লোকটির (শেখ মুজিবুর রহমান) কী সব বৈশিষ্ট্য, উক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যার দ্বারা তিনি কর্তৃত্বপূর্ণ প্রভাব খাটাতে পারবেন? এর উত্তর যা দিয়েছিলাম, তা নিম্নরূপ:

১. মুজিব আজীবন রাজনীতিক। পূর্ণকালীন রাজনীতিক। আইনে ডিগ্রি ছাড়াই তিনি তাঁর শিক্ষাজীবনের পাট চুকানোর পর লাভজনক কোনো কর্মসংস্থানে জড়াননি। তাঁর দৃশ্যমান আয়ের উত্স ছিল গ্রেট ইস্টার্ন লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির উপদেষ্টা হিসেবে। প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা বলতে ১৯৫৬ সালে বাণিজ্যবিষয়ক প্রাদেশিক মন্ত্রী হওয়া। ১৯৪৮ সাল থেকে মুজিব প্রায় ১০ বছর জেল খাটেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের চোখে তিনি বীর হয়ে ওঠেন। দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে মুজিব এখন সাফল্যের স্বাদ গ্রহণে আগ্রহী হতে পারেন।

২. মুজিব এমন একজন মানুষ, যাঁর বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা কঠিন। ঘরোয়া বৈঠকগুলোয় তিনি আকর্ষণীয়, শান্ত ও আস্থাশীল। ভুট্টোর মতো তিনি বিশ্ব বিনম্র না হলেও তাঁর ছিল ব্যাপক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এবং শহুরে। তিনি ইউরোপ, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জানতেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকায় কর্মরত মার্কিন কনসাল জেনারেলকে ধন্যবাদ, তিনি মুজিবকে মার্কিন সরকারের এক লিডার কর্মসূচির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন। জনসভার মঞ্চে মুজিব ছিলেন এক রূপকথার বাগ্মী, যিনি প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে লাখো জনতাকে ধরে রাখতে পারতেন। নেতা হিসেবে তিনি কঠোর, কর্তৃত্বপরায়ণ এবং প্রায়ই একগুঁয়ে। তাঁর স্বভাবে ঈর্ষার মতো একটা ব্যাপার ছিল। তিনি কথা বলতেন ‘আমার জনগণ, আমার ভূমি, আমার বোন, আমার নদী’ এভাবে। এটা স্পষ্ট যে তিনি বাঙালিদের ইচ্ছার ব্যক্তিগত রূপান্তর পছন্দ করতেন।

৩. যখনই বাঙালিদের দুঃখ-কষ্টের কথা উঠত, তখন মুজিব উত্তেজিত ও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন। তাঁকে সুচিন্তিত চিন্তাশীল লোক বলা যাবে না। প্রাথমিকভাবে তিনি ছিলেন কাজে নেমে পড়ার লোক; গণমানুষের নেতা। তাঁর সম্পর্কে একটা কথা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতা কম, নীতিবিবর্জিত সুবিধাবাদ এবং ক্ষমতার প্রতি মোহ। ক্ষমতার প্রতি তাঁর যে বিরাট তৃষ্ণা ছিল, সেটা প্রশ্নাতীত। যেকোনো রাজনীতিকের বিরুদ্ধে সুবিধাবাদ একটি সাধারণ অভিযোগ। মুজিব হলেন এমন একজন রাজনীতিক, যিনি অধিকাংশ রাজনীতিকের চেয়ে কম বা বেশি দোষী নন। তিনি একজন বুদ্ধিজীবী না হতে পারেন, কিন্তু ঘরোয়া বৈঠকে উল্লেখযোগ্য মানসিক সামর্থ্য দেখাতে পারতেন। তাঁর রসবোধও ছিল।

৪. বৈদেশিক নীতি বিষয়ে মুজিবের আগ্রহ ছিল কম। আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি প্রকৃত নিরপেক্ষতা, সিয়াটো ও সিন্টো থেকে প্রত্যাহার এবং ভারতের সঙ্গে উন্নত সম্পর্ক চাইতেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টি সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে আগ্রহের বিষয় ছিল। কারণ, তিনি দেখতেন, প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের প্রসার ঘটাতে পারলে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার আংশিক সুরাহা হবে। অনেক বাঙালির মতো মুজিব কাশ্মীর প্রশ্নে কঠোর ছিলেন না। অবশ্য অনেক বাঙালির মতোই তিনি বিশ্বাস করতেন যে পাক-ভারতের সাধারণ সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে ফারাক্কা ইস্যুর মীমাংসা হতে পারে। কনসুলেট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চেয়েছেন। মুজিব দুবার চীন সফর করেছেন। তিনি স্বীকার করেন, চীনা অভিজ্ঞতা আকর্ষণীয়। কিন্তু একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে সেই সমাজের সংরক্ষণ ও নিপীড়নমূলক চেহারা তাঁর পছন্দের নয়। অধিকাংশ বাঙালির তুলনায় তিনি ছিলেন দীর্ঘাকৃতির ও প্রশস্ত। আমি তাঁকে কখনোই পশ্চিমা পোশাকে দেখিনি। একজন স্বদেশি রাজনীতিকের মতোই ছিল তাঁর বেশভূষা।’

আর্চার কেন্ট ব্লাডের বইটি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার একটি অতীব মূল্যবান প্রামাণ্য দলিল। সে কারণেই তা অবশ্যপাঠ্য।