বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি দর্শন

সারসংক্ষেপ

এই প্রবন্ধটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তর্জাতিক ভাষণগুলোর নির্মোহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বিনির্মাণে এর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্ব অবিসংবাদিত—বাংলাদেশের মানুষের স্বশাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি কান্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে শুধু যে অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবিলা করার মধ্য দিয়ে তাঁর নেতৃত্বের মহিমা প্রকাশিত হয়েছিল তা নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর সুযোগ্য দিকনির্দেশনা বাংলাদেশকে এক অনন্যসাধারণ উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় এই বিষয় নিয়ে গবেষণালব্ধ লেখনীর সংখ্যা অপ্রতুল। এই প্রবন্ধটি তাই মার্গারেট জি হারম্যানের বিষয়বস্তু (কন্টেন্ট) বিশ্লেষণ কাঠামোটি ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত জাতিসংঘ, জোট নিরপেক্ষ এবং ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা—তিনটি আন্তর্জাতিক ভাষণ বিশ্লেষণ করে পররাষ্ট্রনীতি সিদ্ধান্ত প্রণয়নপ্রক্রিয়ায় তাঁর অবদান এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনপ্রক্রিয়ার সূত্রপাত সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। পরিশেষে এই আধেয় বিশ্লেষণের দ্বারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের বিশেষ কিছু গুণের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে, যা বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও বিশ্ববীক্ষা নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকের আসনে অধিষ্ঠিত করে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ

বঙ্গবন্ধু, পররাষ্ট্রনীতি, জাতিসংঘ, বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ভাষণ।

ভূমিকা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেওয়া বিভিন্ন বক্তৃতার জটিল ও গবেষণাভিত্তিক বিশ্লেষণের একটি একাডেমিক প্রয়াস নেওয়া হয়েছে এই প্রবন্ধে। একটি স্বাধীন ভূখণ্ডে বাঙালি জাতিসত্তার স্বশাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু একজন সুদক্ষ কান্ডারি হিসেবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো বিনির্মাণে প্রধান নেতৃত্ব পালন করে গেছেন। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করতে গিয়ে এবং এ দেশের আপামর জনসাধারণের পরিচয় ও অধিকারের বিষয়টি বহির্বিশ্বে তুলে ধরার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিশ্ববীক্ষার তথা পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি স্থাপনের কাজটি স্বমহিমায় খুবই দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য নেতৃত্ব শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্র বিনির্মাণ তথা অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় বিভিন্ন পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক অবস্থান দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে বঙ্গবন্ধু এক অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। কাজটি কি আদৌ খুব সহজ ছিল? বিশেষত স্নায়ুযুদ্ধকালীন বাংলাদেশকে যে মাত্রায় আন্তর্জাতিক বৈরিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে, সেই প্রতিকূল ও এক রাজনৈতিক চরমভাবাপন্ন পরিবেশে বাংলাদেশকে একটি বাস্তবধর্মী পররাষ্ট্রনীতির ভিত গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা কতখানি সহায়তা করেছিল? এই বিষয়টি নিয়ে জ্ঞানপ্রসূত আলোচনার তাগিদে এই প্রবন্ধটিতে মার্গারেট জি হারম্যানের (১৯৭০) বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ বা কন্টেন্ট অ্যানালাইসিসের কাঠামোটি ব্যবহার করা হয়েছে।১ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মূলত তিনটি বহুপক্ষীয়/আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে (জাতিসংঘ, জোট-নিরপেক্ষ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা) বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতাগুলোর বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তাঁর অবদান এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির গঠন প্রক্রিয়ার সূত্রপাত সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়ার যে দিকগুলো নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে, তা হলো: (১) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে কী প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সামলে দেশকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, (২) নতুন তথ্যের ব্যবহার কতখানি বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি-সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত প্রণয়নে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছে; এবং (৩) আন্তর্জাতিক ঘটনাগুলো তাঁর রাষ্ট্রনীতিকে কতখানি প্রভাবিত করেছে। এই বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় মার্গারেট জি হারম্যানের রোল থিওরি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বা বিশ্ববীক্ষা নির্মাণে একজন নেতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর রেখাপাত করা হয়েছে (পররাষ্ট্রনীতি তত্ত্বের ভাষায় একজন কর্মক বা এজেন্টের ভূমিকা)। পরিশেষে এটা বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের যে বিশেষ গুণগুলো তাঁর বক্তৃতার মধ্য দিয়ে আলোকছটা লাভ করে, তা হলো সহজাত দক্ষতা (charishmatic), নির্দেশিকা নেতৃত্ব (directive) এবং সমন্বয়মূলক নেতৃত্বের (accommodative) এক অনন্যসাধারণ মিশ্রণ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথনশৈলী: একটি প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর কথনশৈলী তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এক অনন্যসাধারণ গুণ। এই গুণাবলির প্রভাব দেখা যায় বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের প্রতিটি আন্দোলনে। তাঁর বক্তৃতা বিপুল সমারোহে আপামর জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করেছে। একটি স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সবার মধ্যে প্রথিত করতে সক্ষম হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছেষট্টির ছয় দফার দাবি আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মহানায়কোচিত ভূমিকা—এই সবকিছুই বাঙালির রাজনৈতিক জীবনাদর্শনকে একটি পরিপূর্ণ রূপ দিয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজচিন্তকদের মতে, তাঁর এই অবদান তাঁকে যথার্থই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির জনকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।২

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর কথনশৈলী উপমহাদেশীয় ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাঁর বিশাল অভিজ্ঞতার এক প্রকৃষ্ট প্রতিফলন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি পর্যালোচনা করলে এর তাত্পর্য উপলব্ধি করা যায়। এই ভাষণ সম্পর্কে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এক বর্ষীয়ান নেতা জনাব তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ একটি নিরস্ত্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৪ মিনিটের ওই ভাষণ ছিল অলিখিত। তিনি সারা জীবন যা বিশ্বাস করতেন, সেই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই ওই ভাষণ দিয়েছিলেন।’৩ ৭ মার্চের এই ভাষণের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিকায়। তত্কালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টো একজোট হয়ে অন্যায়ভাবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফল উপেক্ষা করে। তারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করতে উদ্যত হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের সভায় প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে বলেন:

আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন থেমে না থাকে। বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি না থাকলে আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব দিবেন। তাঁদেরও যদি হত্যা করা হয়, যিনি জীবিত থাকবেন, তিনিই নেতৃত্ব দিবেন। যেকোনো মূল্যে আন্দোলন চালাইয়া যেতে হবে—অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।৪

নেতৃত্ব বা ক্ষমতার মোহ নয়, একটি স্বাধীন দেশ ও তার মানুষের অধিকার স্থাপনের সংকল্প বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনকে প্রভাবিত করে। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ঢাকার তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’৫ সেদিনের সেই ১৮ মিনিটের অলিখিত ভাষণে ১৯৪৭-পরবর্তী পাকিস্তান সরকারের নয়া ঔপনিবেশবাদী চরিত্রের এক অনন্যসাধারণ সুরতহাল লক্ষ লক্ষ জনগণের সামনে উপস্থাপন করেন। রাজনীতির মারপ্যাঁচের কঠিন ঘটনাবলি ভাষাগত সাবলীলতায় আর আবেগমিশ্রিত উপস্থাপনে এর প্রতিটি শব্দ একেকটি স্লোগানে রূপান্তরিত হয়। পুরো ভাষণে বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব নিয়ে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেন এবং তত্কালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি হওয়া আর সেগুলো অকার্যকর ও ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো সবার সামনে উপস্থিত করেন। রাজনৈতিক বৈরী পরিবেশ তৈরি হওয়ার পটভূমি সবার সামনে তুলে ধরে তিনি উপস্থিত জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। এগুলো উপস্থাপনের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেন। গণতন্ত্রের প্রতি তার সংকল্পকে পুনর্ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দুটি পর্যায়ে উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি কৌশলগত নির্দেশনা দিয়েছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমি এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ আরও বলা হয়েছে, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকেদের ওপর হত্যা করা হয়। তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ একই সঙ্গে এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু নিয়তকরণীয় ছোট ছোট বিষয় সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বললেন, ‘দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নেবার পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না।’ অর্থাত্, বৃহত্ থেকে ক্ষুদ্র পরিসরের সব বিষয় সম্পর্কে তিনি একটি সম্যক দিকনির্দেশনা প্রদান করলেন তাঁর ভাষণে, যা আপামর বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তি প্রদান করে। এই ভাষণ এত বছর পরও বাংলাদেশের সব নাগরিকের রাজনৈতিক চেতনার ও অনুপ্রেরণার উত্স। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই ভাষণের গুরুত্ব ও তাত্পর্য সগৌরবে বয়ে নিয়ে চলার জন্য জাতীয় প্রচেষ্টার সঙ্গে রয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ২০১৭ সালে ইউনেসকো ৭ মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।৬ এই স্বীকৃতি শুধু একটি কথনশৈলীর নয়, এর মাধ্যমে একজন জাতীয় নেতার নেতৃত্বের কৃতিত্ব এবং এর ব্যাপ্তি বা পরিধি সেই দেশের স্বাধীনতা ও মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে। বিষয়টিকে আবার আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল এ বিষয়ে মন্তব্য করেন, ‘বলা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করে ইউনেসকো জাতির জনককে সম্মানিত করেছে। আমি বলব, ঐতিহাসিক এই ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করে বরং ইউনেসকো সম্মানিত হয়েছে।’৭ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে মহাকাব্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি।’ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর কথনশৈলীর প্রভাব প্রতিষ্ঠিত। এরপর আমরা বিশ্লেষণ করব বহুপক্ষীয় সংগঠনগুলোয় তাঁর কথনশৈলীর উপস্থাপনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলির প্রকাশ এবং তা কীভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি স্থাপনের প্রক্রিয়া উপলব্ধি করতে সহায়তা করে। সেই আলোচনা করার আগে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণের কিছু প্রাসঙ্গিক তত্ত্বীয় আলোচনা করা প্রয়োজন। এই আলোচনা একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার অবদানকে চিরস্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।

নেতৃত্ব, জন-কথনশৈলী ও পররাষ্ট্রনীতির একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

পররাষ্ট্রনীতির তাত্ত্বিক প্রকরণে (conceptual discourse) একজন নেতার জন-কথনশৈলী, তাঁর আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সে দেশের পররাষ্ট্রনীতির ওপর এর প্রভাব পর্যালোচনা করার প্রয়াস তৈরি হয়। এটা ঘটে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের (মূলত পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণ) কর্মক (agency) বনাম কাঠামো (structure) বিতর্কের অবতারণার মাধ্যমে।৮ আন্তর্জাতিক কাঠামো বিশ্লেষণের মাধ্যমে পররাষ্ট্রনীতির উদ্ভাবন, প্রচলন ও প্রতিপালনবিষয়ক গবেষণা পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণের সাব-ডিসিপ্লিনে বেশ স্বীকৃত। এই ধারণাটি সাধারণত পররাষ্ট্রনীতি যে প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় এবং রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাঠামোগত বিষয়গুলো এই প্রক্রিয়াকে যেভাবে প্রভাবিত করে, তার এক সম্যক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে। অপর দিকে এজেন্সি বা কর্মকের ধারণা প্রক্রিয়ার পরিবর্তে নীতির ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে রাষ্ট্র নিজে কোনো এজেন্ট বা কর্মক নয়। রাষ্ট্র মূলত বিভিন্ন এজেন্টের কর্মযজ্ঞের এক সামষ্টিক প্রতিফলন। তাই এজেন্সির ধারণায় প্রভাবিত বিশেষজ্ঞরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন নেতার ভূমিকার ওপর ও ভূমিকাপ্রসূত নীতির ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। একজন জাতীয় নেতার ভূমিকা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অপরিসীম। বিভিন্নভাবে তা উপলব্ধি করা সম্ভব। জনগণের সামনে তাঁর বক্তৃতা সেই নেতার কৃতিত্বকে যেমন জাহির করে, তেমনি এর মাধ্যমে আমরা নেতার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, তাঁর কার্য বাস্তবায়নের দক্ষতার ছাপ ও দূরদর্শিতা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে সক্ষম হই।

সুতরাং, যে প্রশ্নগুলো এজেন্সি ঘরানার আলোচনায় প্রাধান্য পায় তা হলো: (ক) একজন নেতার ভূমিকা কী? (খ) কখন নেতাকে ভূমিকা পালন করতে হয়, এবং (গ) নেতার ভূমিকা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। এই আলোচনায় নিঃসন্দেহে ব্যক্তিগত পর্যায়ের একজনের ভূমিকাকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও কাঠামোর প্রভাবকে একেবারে অবহেলা করা হয় না। অর্থাত্, এজেন্সি ও কাঠামোর আলোচনা পরস্পরবিরোধী নয়। এরা একে অপরের সম্পূরক হিসেবে বিশ্লেষিত হওয়ার মাধ্যমে যেকোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন-প্রক্রিয়া ও তার প্রভাব সম্পর্কে বিশদ ধারণা দিতে সক্ষম হয়।

তদুপরি পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণ (Foreign Policy Analysis, FPA) একাডেমিক বিষয় হিসেবে আরও বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ধ্রুপদি তত্ত্বসমূহ, তথা নিওরিয়েলিজম ও কনস্ট্রাকটিভিজমের ধারণার বিপরীতে একজন ব্যক্তির ভূমিকার গুরুত্বকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আলোচনা করার প্রয়াস চালানোর মাধ্যমে।৯ ভ্যালেরি এম হাডসন তাঁর পররাষ্ট্রনীতির বইতে এটি উল্লেখ করেছেন যে ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষণায় পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো, ধারণা বা কাঠামো শুধু নয়, একজন ব্যক্তি পররাষ্ট্রনীতির একটি কর্মক।’১০ নিওরিয়েলিজমে কেনেথ ওয়াল্টজ ও কনস্ট্রাকটিভিজমে আলেক্সান্ডার ওয়েন্ডটের মতো বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা যেভাবে মূলত কাঠামোকে গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি আলোচনা করেছেন এবং ব্যক্তি পর্যায়ের ভূমিকাকে অবহেলা করেছেন, তা ভ্যালেরি এম হাডসনের মতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে মানবতা-বিবর্জিত একটি একাডেমিক চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। তিনি আরও বলেন, শুধু কাঠামো বিশ্লেষণ করে একটি পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক সিদ্ধান্তের সামাজিক-জাতীয় পরিচয় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় বা এর পরিচয় তৈরি হওয়ার যে প্রক্রিয়া, তা পুরোপুরি বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। তাই মার্গারেট জি হারম্যান (১৯৭০) বা পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণের অন্যান্য গবেষক এজেন্সি বা ব্যক্তি কর্মকের গুরুত্ব প্রতিস্থাপন করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন।

এই প্রবন্ধটি মার্গারেট জি হারম্যানের পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক গবেষণালব্ধ জ্ঞান দ্বারা অনুপ্রাণিত।১১ মার্গারেট তাঁর গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অবদান এবং তাঁদের সামাজিক ও মনোবৈজ্ঞানিক অবস্থার বিশ্লেষণ করেছেন। এটা আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নকারী ব্যক্তির মানসিক অবস্থা অলিখিত ফলকের মতো নয় অথবা একেবারে শূন্য অবস্থা নয়, যা থেকে নতুন সব সিদ্ধান্ত প্রণয়ন হতে থাকবে। বরং পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নকারী একজন রাজনৈতিক নেতার অথবা একজন পররাষ্ট্রবিশেষজ্ঞ আমলার জটিলতর তথ্য বিশ্লেষণের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যা তাঁর এবং তাঁর আশপাশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ব্যবহার, সংস্কৃতি, ইতিহাস, রাজনৈতিক সংস্কার এবং আরও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এসব ধারণা থেকে যে সামাজিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়, তা পররাষ্ট্রনীতির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়ে থাকে। মার্গারেট তাঁর গবেষণাগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন নেতার কথাবার্তা, ভাষণ বা বক্তৃতার আধেয় বিশ্লেষণ করে তাঁদের ব্যক্তিগত চরিত্রের এক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এর মাধ্যমে মূলত পররাষ্ট্রনীতির ওপর তাঁর প্রভাব আলোচনা করেছেন।

এই প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ভাষণের কঠোর ও যথাযথ বিষয়বস্তু বিশ্লেষণের মাধ্যমে যে বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে, তা হলো: (ক) আন্তর্জাতিক বৈরী পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু বাধাগুলোকে কীভাবে মোকাবিলা করেছেন, (খ) নতুন তথ্যের ব্যবহার কতখানি বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত প্রণয়নে ভালো প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছে, এবং (৩) অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি দ্বারা তাঁর রাষ্ট্রনীতি কতখানি প্রভাবিত হয়েছে। এই বিষয়গুলো একজন নেতার যেসব চরিত্রের দিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে, তা নিচের সারণির মাধ্যমে প্রকাশ করা হলো:

সারণি-১

নির্দেশক (Indicators)

বিশ্লেষণীয় বিষয়াবলি

নেতৃত্বের পররাষ্ট্রনীতির গুণাবলি

বাধাগুলোকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বৈরী অবস্থার প্রতি কতখানি পজিটিভ ছিলেন, নাকি তা উপেক্ষা করেছেন?    

১। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ-পরবর্তী সম্পর্ক

২। আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক 

৩। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক

৪। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে ভূমিকা

৫। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক

* সহজাত দক্ষতা (charishmatic)

* নির্দেশিকা নেতৃত্ব (directive) এবং

* সমন্বয়মূলক নেতৃত্ব (accommodative)

নতুন তথ্যের ব্যবহার পররাষ্ট্রনীতি-সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত প্রণয়নে কী ধরনের প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছে?

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি দ্বারা তাঁর রাষ্ট্রনীতি কতখানি প্রভাবিত হয়েছে?

তথ্যসূত্র: লেখকের নিজের বিশ্লেষণ এবং Hermann (১৯৭০) ‘Explaining Foreign Policy Behavior Using the Personal Characteristics of Political Leaders.’ International Studies Quarterly, no. 24, 7~46.

পরিশেষে এই আলোচনার ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের যে গুণগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তা হলো তাঁর সহজাত দক্ষতা (charishmatic), নির্দেশিকা নেতৃত্ব (directive) এবং সমন্বয়মূলক নেতৃত্ব (accommodative)। এই আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রসারে এবং পররাষ্ট্রনীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বদর্শন সম্পর্কে ধারণা লাভ সম্ভব এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের মুখ্য স্থপতির জায়গায় তাঁর অবস্থানকে একটি অপ্রতিম একাডেমিক ভিত্তি প্রদান করা যেতে পারে। প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে জাতিসংঘে ও অন্যান্য বহুপক্ষীয় সংগঠনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং ১৯৭১-পরবর্তী বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করার বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর সামনে একটি বড় দায়িত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়। স্নায়ুযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বাংলাদেশের স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টি অনেক জটিল একটি প্রক্রিয়ায় পর্যবসিত করেছিল। এ বিষয়ে সাবেক কূটনীতিক মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম দিকে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নির্ধারিত লক্ষ্যগুলো অর্জনে যে সাফল্য দেখায়, তা বঙ্গবন্ধু সম্যক উপলব্ধি করতেন। তাঁর প্রধান লক্ষ্যগুলো ছিল: ১. বাংলাদেশের পক্ষে বেশিসংখ্যক দেশের স্বীকৃতি আদায় এবং ২. দুনিয়ার বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্যপদ লাভ। আর (৩) ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি), জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন (ন্যাম), কমনওয়েলথ, জাতিসংঘসহ সব আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্যপদ লাভ করা।১২

ইমতিয়াজ আহমেদ ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সময়টিকে ‘স্বীকৃতির কূটনীতি’ অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।১৩ এ বিষয়টি অনস্বীকার্য যে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ একটি মুখ্য দায়িত্ব হিসেবে স্থাপিত হয়। বিশেষত যে দেশগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল, তাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়া বাংলাদেশের তত্কালীন সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। একই সঙ্গে বন্ধুপ্রতিম ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও মানবিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আদায় করা বাংলাদেশের জন্য একটি বাস্তবধর্মী ও প্রায়োগিক পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক সিদ্ধান্ত। বঙ্গবন্ধু এ সময় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে কোনো আপস যাতে না করতে হয়, প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে এ রকম একটি শক্তিশালী বন্ধুত্বের ভিত রচনা করেন।১৪ তাই শুধু স্বীকৃতির কূটনীতিই মুখ্য নয়, এ সময় দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বিভিন্ন আলোচনায় বাংলাদেশ তার রাজনৈতিক মূল্যবোধ শক্ত অবস্থানে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুকে বাংলা ভাষায় রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষণ দিতে শুনতে পাই। এই ভাষণের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণের আগে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টি সংক্ষেপে আলোচনার দাবি রাখে।

১৯৭১-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক রাজনীতি ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া আরও তিনটি ফ্রন্টে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ছিল। এর মধ্যে চীন, পাকিস্তান ও পাকিস্তানকেন্দ্রিক আরব বিশ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ঘিরে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক কূটকৌশল নির্মিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন স্বাধীনতার অব্যবহিত পরপরই দৃশ্যমান হয়। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে স্বীকৃতি প্রদান করার মাধ্যমে আমেরিকা মানবিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি এবং দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের ইঙ্গিত প্রদান করে। তাই স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির বাংলাদেশবিরোধী যে ভূমিকা, তা কিছুটা প্রশমিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যায়। কিন্তু এ বিষয়টি আসলে আলোচনার দাবি রাখে যে আমেরিকা কতখানি বন্ধুত্বপূর্ণ সহমর্মিতা প্রকাশ অব্যাহত রেখেছিল।

অপর দিকে ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে দুবার চীন জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করার মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তীকরণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির জন্য প্রথম দরখাস্ত করেছিল ১৯৭২ সালের ৮ আগস্ট। নিরাপত্তা পরিষদে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুগোস্লাভিয়ার উত্থাপিত প্রস্তাবে ২৫ আগস্ট ভেটো দেয় চীন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক কূটকৌশল এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এবং চীন পাকিস্তানের সঙ্গে তার ঐতিহাসিক সম্পর্কের সঙ্গে কোনো আপস করেনি। চীনের ভূমিকা নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুকে বিচলিত করে থাকতে পারে কিন্তু এর বহিঃপ্রকাশ চীনের সঙ্গে শত্রুতার সম্পর্ক স্থাপন করে চলার লক্ষণ দেখা যায়নি। চীনের কার্যক্রমের ফলে বরং এই উপলব্ধি হয় যে বাংলাদেশ যত দিন পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক না করতে পারছে, তত দিন পর্যন্ত চীন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অগ্রযাত্রায় একটি বড় বাধা হিসেবে আবির্ভূত হতে থাকবে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন এই বিষয় মাথায় রেখে তাঁদের পদক্ষেপসমূহ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তার মধ্যে একদিকে ছিল বিভিন্ন উপায়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করে নেওয়ার মাধ্যমে আরব বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক ত্বরান্বিত করা।১৫

১৯৭৪ সালটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এই বছরে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) লাহোর সভা আয়োজন বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আরব বিশ্বের মধ্যে সম্পর্কের এক নতুন মাত্রা যুক্ত করে। সংস্থাটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বছরের শুরু থেকেই বাংলাদেশে এসে এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বাংলাদেশের সম্মতি আদায়ের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকেন। কুয়েতের তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ওআইসির মহাসচিবের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের দল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘লাহোরের মাটিতে কেন হতে হবে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার সভা? আর কোনো নিরপেক্ষ ভেন্যুতে হওয়ার সম্ভাবনা কি ছিল না?’ তিনি দৃঢ়কণ্ঠে জানিয়ে দেন, ‘পাকিস্তানের মাটিতে যাওয়া এ অবস্থায় সম্ভব নয়।’১৬ ওআইসির নেতারা যখন বিভিন্ন তথ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন, তিনি ধৈর্যসহকারে তাঁদের বক্তব্য শুনছিলেন এবং তিনি আলোচনার পথ অবরুদ্ধ করেননি। মূল আলোচনা যখন ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে এসে অচলাবস্থায় ধাবিত হতে থাকে, বঙ্গবন্ধুকে তখন এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করার প্রয়াস নিতে দেখা যায়। এ বিষয়টি যে একান্ত দ্বিপক্ষীয় নয়, এ আলোচনা ভারত ও পাকিস্তানের উপস্থিতিতে হওয়া প্রয়োজন, তাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেন। তদুপরি বঙ্গবন্ধু আলোচনায় পাকিস্তানের স্বীকৃতির বিষয়টির ওপর বেশ জোর দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ওআইসির সদস্যদের মনে করিয়ে দেন, ‘আমরা শান্তি ও সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাই। আমরা সকল বিষয়ের সমাধান করতে চাই, কিন্তু যত দিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়া হবে, তত দিন পর্যন্ত কোনো আলোচনা চলবে না।’১৭ এই দলটির বাংলাদেশ ত্যাগের ২৪ ঘণ্টার মাথায় পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং তার প্রতি-উত্তরে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দেয় ও লাহোর সভায় অংশগ্রহণ করার সম্মতি জ্ঞাপন করে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট কূটনীতিক ফকরুদ্দীন আহমেদ তাঁর ক্রিটিক্যাল টাইমস: মেমোয়ারস অব আ সাউথ এশিয়ান ডিপ্লোম্যাট বইয়ে বলেন, এই আলোচনা ও সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মুহূর্ত, যা বাংলাদেশের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করে। কারণ এই আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তা ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করেন।১৮ এই নীতির ফলে আমরা দেখতে পাই তুরস্ক, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। একমাত্র সৌদি আরব ছাড়া আরব বিশ্বের মোটামুটি সব দেশের সমর্থন আদায় করা সম্ভব হয়।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের এই আপাত-উন্নয়ন চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আগের অবস্থানের একটি পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির আবেদন নিয়ে চীনের সঙ্গে ১৯৭৪ সালে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কূটনীতিক পর্যায়ে বিশদ আলোচনা হয়। যদিও পাকিস্তানের একটি প্ররোচনা ছিল, পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর নির্ধারিত বাংলাদেশ সফরের আগে বাংলাদেশ যেন জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির আবেদন না করে। চীন বিষয়টি বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় উত্থাপন করেছিল, কিন্তু বাংলাদেশি কূটনীতিকদের যুক্তিসংগত অবস্থানের কারণে বিষয়টি আর কোনো অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি।১৯ তদুপরি আরেক বিশিষ্ট সাবেক কূটনীতিক এস এ করিম (২০১৪) তাঁর শেখ মুজিব: ট্রাইয়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডি বইয়ে আলোচনা করেছেন: বাংলাদেশ যেভাবে প্রত্যুত্পন্নমতিত্বের পরিচয় দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ৯৩ হাজার বন্দী বিনিময় ও যুদ্ধবন্দীদের বিনিময়ের বিষয়টি সমাধান করতে পেরেছিল, এরপর আসলে চীনের বিরোধিতা করার কোনো যুক্তিসংগত কারণ অবশিষ্ট ছিল না।২০ তাই আমরা দেখতে পাই, চীন ১৯৭৪ সালে নিরাপত্তা পরিষদের সভায় বাংলাদেশের সদস্যপদ বিষয়ে কোনো আপত্তি উত্থাপন করেনি। এভাবে ১৯৭৪ সালের ১০ জুন নিরাপত্তা পরিষদের এক নির্ধারিত সভায় সব সদস্যদেশ অবিসংবাদিতভাবে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রদানের সুপারিশ সাধারণ পরিষদে পাঠায়। এভাবে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের বাত্সরিক অধিবেশনে ভাষণ দিতে সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে যাত্রা করেন।

জাতিসংঘে ভাষণের সারবত্তা বিশ্লেষণ

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণটি সেই আসরে কোনো রাষ্ট্রনায়কের বাংলায় দেওয়া প্রথম কোনো ভাষণ। বঙ্গবন্ধু শুরু করেন:

আজ এই মহান পরিষদে আপনাদের সামনে দুটো কথা বলার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। মানব জাতির এই মহান পার্লামেন্টে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রতিনিধিত্ব লাভ করায় আপনাদের মধ্যে যে সন্তোষের ভাব লক্ষ করেছি, আমিও তার অংশীদার। বাঙালি জাতির জন্য এটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কারণ তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম আজ বিরাট সাফল্যে চিহ্নিত।২১

১০ মিনিটের কিছু কম সময়ের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু দৃপ্ত ভঙ্গিমায় দৃঢ় আস্থার পরিচয় দিয়ে তাঁর বক্তব্য প্রদান করে গেছেন। চিরসবুজ বাগ্মিতার পরিচায়ক যে বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি জাতি চেনে, এ যেন তারই এক পুনরাবৃত্তি ঘটল। একটি বারের জন্য মনে হয়নি নিউইয়র্কের এই মঞ্চটি তাঁর জন্য নতুন বা এই অভিজ্ঞতা তাঁর জন্য প্রথম। জাতিসংঘের সনদের রেফারেন্স থেকে শুরু করে তাঁর বক্তৃতা জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়ার জনগণের জাতীয় স্বাধীনতা ও চরম মুক্তির জন্য চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জুগিয়েছে এবং একটি ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রতি আন্তর্জাতিক নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ বাংলাদেশের তত্কালীন পরিস্থিতির সঙ্গে বৈশ্বিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার যে সামঞ্জস্য রয়েছে, সে সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে। তিনি বলেন:

সাম্প্রতিককালে গোটা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে আমাদের আরও ত্বরিত্ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এ বছরের গোড়ার দিকে অনুষ্ঠিত এই পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে বিশ্বের বর্তমান গুরুতর অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। আমি এমন একটি দেশের পক্ষ থেকে কথা বলছি, যে দেশটি বর্তমানে অর্থনৈতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে।...যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ওপরই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। তারপর থেকে আমরা একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছি। সর্বশেষ এবারের নজিরবিহীন বন্যা। সাম্প্রতিক বন্যা বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আমরা জাতিসংঘ, সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ ও সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে কৃতজ্ঞ।২২

একই সঙ্গে তিনি তাঁর বক্তৃতায় সমাধানের পথের ওপর আলোকপাত করেন এবং দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি বলেন:

এই চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটা ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যুক্তির শক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা। এই ব্যবস্থায় থাকবে নিজের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর প্রতিটি দেশের সার্বভৌম অধিকারের নিশ্চয়তা। এই ব্যবস্থা গড়ে তুলবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, বাস্তব কাঠামো, যার ভিত্তি হবে স্থিতিশীল ন্যায়সংগত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্বের সকল দেশের সাধারণ স্বার্থের স্বীকৃতি...আন্তর্জাতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশই যে অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূর করতে সক্ষম, সে সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ সচেতন। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, বর্তমান অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস করা সম্ভব হলে অর্থনৈতিক সংকট দূর করার পরিবেশই শুধু গড়ে উঠবে না, এই প্রতিযোগিতায় যে বিপুল সম্পদ অপচয় হচ্ছে, তা মানবজাতির সাধারণ কল্যাণে নিয়োগ করা সম্ভব হবে।২৩

তিনি একটি সামষ্টিক দায়িত্বশীলতার উপলব্ধির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁর নাতিদীর্ঘ বক্তব্যটি শেষ করেন। তিনি উল্লেখ করেন:

সর্বশেষে আমি মানবের অসাধ্য সাধন ও দুরূহ বাধা অতিক্রমের অদম্য শক্তির প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থার কথা আবার ঘোষণা করতে চাই। আমাদের মতো দেশসমূহ, যাদের অভ্যুদয় সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে, এই আদর্শে বিশ্বাসই তাদের বাঁচিয়ে রাখবে। আমাদের কষ্ট স্বীকার করতে হতে পারে, কিন্তু আমাদের ধ্বংস নাই। এই জীবনযুদ্ধের মোকাবেলায় জনগণের প্রতিরোধক্ষমতা ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞাই শেষ কথা। আত্মনির্ভরশীলতাই আমাদের লক্ষ্য। জনগণের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগই আমাদের নির্ধারিত কর্মধারা।২৪

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের মূল শক্তিটি ছিল তাঁর কথনশৈলী, যেখানে কৃত্রিমতার আবেশ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তিনি শুরু করেছেন ‘আমিও তার অংশীদার’ দিয়ে, অর্থাত্ এখানে ‘আমি’র ব্যবহার রয়েছে। এর দ্বারা একজন নেতার কাছ থেকে নিজ দায়িত্বের দায়ভার গ্রহণ করে তা প্রকাশ করার প্রত্যয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। নিজের ওপর বিশ্বাস ও আত্মসম্মানের থেকে ‘আমি’র ব্যবহার এ ধরনের ভাষণে করা হয়ে থাকে। কিন্তু তার অব্যবহিত পরেই আমরা শুনতে পাই, বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘জাতিসংঘ সনদে যে মহান আদর্শের কথা বলা হয়েছে, তা আমাদের জনগণের আদর্শ এবং এই আদর্শের জন্য তারা চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে। এমন এক বিশ্বব্যবস্থা গঠনে বাঙালি জাতি উত্সর্গীকৃত, যে ব্যবস্থায় মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচার লাভের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হবে এবং আমি জানি আমাদের এই প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মধ্যে আমাদের লাখো শহীদের বিদেহী আত্মার স্মৃতি নিহিত রয়েছে।’ এই জায়গায় ‘আমাদের’-এর ব্যবহার সামষ্টিক ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং বঙ্গবন্ধু যে একজন জনমানুষের নেতা, তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই সেই প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে, যেখানে মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচার লাভের জন্য সামষ্টিক প্রতিজ্ঞার প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন।

স্বশাসনের অধিকার যে বৈশ্বিক এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যৌক্তিকতা যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয়, তা প্রতীয়মান হয়। বঙ্গবন্ধুর পুরো ভাষণে বিষয়টি বারবার ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, বাঙালির ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম আজ বিরাট সাফল্যে চিহ্নিত। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে মুক্ত ও সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকারের জন্য বাঙালি জাতি বহু শতাব্দী ধরে সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। তারা চেয়েছে বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্যের মধ্যে বসবাস করতে।’ তিনি বাংলাদেশের জয়কে আলজেরিয়া, ভিয়েতনাম ও গিনি বিসাউয়ের জয়যাত্রার সঙ্গে আলোচনা করে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের স্বাধিকারের প্রসঙ্গটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এই জয় দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে ইতিহাস জনগণের পক্ষে এবং ন্যায়ের চূড়ান্ত বিজয় অবধারিত।

বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে তাঁর ভাষণে দেশ পরিচালনায় তাঁর প্রতি যে চ্যালেঞ্জগুলো এসেছে এবং তা মোকাবিলায় তাঁর পদক্ষেপগুলো তিনি সবাইকে অবহিত করেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার নিমিত্তে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্ব উপস্থিত সভাসদের কাছে তুলে ধরেন। তিনি বলেন:

১৯৫ জন যুদ্ধ-অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শন করে এই উপমহাদেশে শান্তি ও সহযোগিতার নতুন ইতিহাস রচনার কাজে আমরা আমাদের আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়েছি। এই ১৯৫ জন যুদ্ধ-অপরাধীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত থাকার অসংখ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ ছিল, তবু সকল অপরাধ ভুলে গিয়ে আমরা ক্ষমার এমন উদাহরণ সৃষ্টি করতে চেয়েছি, যা এই উপমহাদেশে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সহযোগিতার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। উপমহাদেশের শান্তি নিশ্চিত করার কাজে আমরা কোনো পূর্বশর্ত দিই নাই কিংবা দরকষাকষি করি নাই। বরং জনগণের জন্য আমরা এক সুকুমার ভবিষ্যত্ প্রেরণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ ও প্রভাবান্বিত হয়েছি। অন্যান্য বড় বিরোধ নিষ্পত্তির কাজেও আমরা ন্যায়বিচার ও পারস্পরিক সমঝোতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছি।

এই অবস্থানের পেছনের রাজনীতি এই প্রবন্ধে কিছুটা আলোচিত হয়েছে, যেখানে আমরা বঙ্গবন্ধুকে ওআইসির দলের সঙ্গে আলোচনারত অবস্থায় পাকিস্তানের কিছু দাবি নিয়ে একটি প্রগতিশীল অবস্থান থেকে তাঁর কূটনীতি পরিচালনা করার প্রচেষ্টা দেখতে পাই।২৫ এই পর্যায়ে এসে বলা যায়, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের যে চ্যালেঞ্জ ছিল, বঙ্গবন্ধু তাকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তা নিবারণে বৈরিতার বদলে সংস্কারমুক্ত হয়ে খোলা মনে সমস্যাগুলো নিবারণের পথে অগ্রসর হয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তথ্যের বহু ব্যবহার দেখা গেছে। তিনি দেশের তত্কালীন অর্থনৈতিক দুরবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ এক বর্ণনা উপস্থাপন করেন। এখানে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রভাব ও তার ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির দরুন আমাদের মতো একটি দেশের জন্য দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে। জনসাধারণের জীবনধারণের মান নিছক বেঁচে থাকার পর্যায় থেকেও নিচে নেমে গেছে। মাথাপিছু যাদের বার্ষিক আয় ১০০ ডলারেরও কম, তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বেঁচে থাকার জন্য যে ন্যূনতম খাদ্য প্রয়োজন, তার থেকে কম খাদ্য খেয়ে যারা বেঁচে ছিল, তারা সম্পূর্ণ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।’২৬ অর্থাত্, বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থার আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান যে বিচ্ছিন্ন নয়, তা-ই সবার সামনে তুলে ধরেন।

জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের কথা বারবার উত্থাপিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে শান্তি, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার এলাকারূপে ঘোষণার অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস, জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বিশ্বের যে উদীয়মান জাতিসমূহ একত্রিত হয়েছিলেন, তাঁরা শান্তির পক্ষে শক্তিশালী সমর্থন জুগিয়েছেন। তাঁরা বিশ্বের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অভিন্ন প্রতিজ্ঞার কথাই আবার ঘোষণা করেছেন। এই ঘোষণার লক্ষ্য জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা এবং শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।’২৭ শান্তি ও স্বশাসন রক্ষা করার যে অঙ্গীকার বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের কাছে সব সময় করে গেছেন, তার প্রতিফলন আমরা এই ভাষণে দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি যে প্রতিজ্ঞা রয়েছে তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে। তা ছাড়া এ ধরনের অবস্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতিসমূহের মধ্যে যে জটিল মাত্রার সংলগ্নতা ও সংযোগ রয়েছে, তা-ই পুনরায় প্রতীয়মান হয়।

ওআইসি সম্মেলন (১৯৭৪) এবং জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে (১৯৭৩) বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলোর সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসির সম্মেলনে বক্তৃতা দেন। তিনি ওআইসির মহাসচিবকে সম্মেলনটির সংগঠক হিসেবে ধন্যবাদ দেওয়া ছাড়াও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। এ বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে তিনি উদ্ধৃত করেন, ‘এভাবে [এ সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ করার মাধ্যমে] দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। দেশগুলোর সার্বভৌমত্বকে বজায় রেখে আলোচনার পথ প্রশস্ত করার যে দ্বার উন্মুক্ত হলো, তা দক্ষিণ এশিয়া তথা সারা বিশ্বে শান্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’২৮ এ ক্ষেত্রে পুনরায় প্রতীয়মান হয় যে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধু প্রত্যাখ্যানের মনোভাব না রেখে সেগুলোকে যথাযথ স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে তা সমাধান করতে সচেষ্ট ছিলেন। অর্থাত্, এক পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর মধ্যে প্রথিত ছিল।

আরব বিশ্ব ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধনকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যদিও তিনি অবগত, সৌদি আরবের মতো ক্ষমতাশালী দেশ তখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। তদুপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তান সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সৌদি আরব তার বাংলাদেশনীতি নির্ধারণ করে থাকে। এই চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও তিনি যে আশার বাণী দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, তা হলো:

It is important for us to emphasize that this conference can be useful not only to consolidate our unity in support of the cause of Arab Brethren but we can at the same time declare our solidarity with the forces of peace and progress throughout the world with the non-aligned nations; with the oppressed people of the world struggling against colonialism, imperialism and racism and all those people who are struggling against domination and exploitation of all forms. The historic injustices which have been inflicted on our brethren must be redressed.২৯

তিনি ফিলিস্তিনের মানুষের অধিকার ও সুবিচারের বিষয়টি আবার সবার সামনে তুলে ধরেন। আরবের জমির ওপর ফিলিস্তিনের যে অধিকার, তা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর ওআইসির সম্মেলনে অংশগ্রহণ এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এক নতুন যুগের সূচনা করে। ভারতের মতো এক পরাক্রমশালী দেশ ও ইন্দিরা গান্ধীর মতো এ রকম লৌহমানবী যখন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু, সেখানে পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোনো শত্রুতার অবসান ঘটিয়ে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে একধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এক বাস্তবধর্মী পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ ছিল। এক দিকে বাংলাদেশের সংবিধানে ‘ধর্মনিরেপক্ষতা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর, অপর দিকে পাকিস্তানের প্ররোচনায় বাংলাদেশ তখনো আরব বিশ্বের অনেকের কাছে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত। এই ওআইসির সাবেক সম্মেলনগুলোতে পাকিস্তান বাংলাদেশ সম্পর্কে বহু মিথ্যাচার রটিয়েছে।৩০ সেই মুহূর্তে তাই একজন বাস্তববাদী ও প্রগতিশীল নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর জন্য বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে আরব বিশ্বের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করাই ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত হয় জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন। সেখানে বঙ্গবন্ধু তাঁর জোট নিরপেক্ষ অবস্থানের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রসারের ক্ষেত্রে দেশসমূহের স্বশাসনের অধিকার থাকা যে জরুরি, তা বঙ্গবন্ধুর ভাষণে পরস্ফুিটিত হয়। তিনি বলেন, ‘Let this conference unequivocally pledge its positive support to those who are struggling for national liberation and for their realisation of their legitimate rights in Africa, Asia and Latin America.’৩১ তিনি বিশ্বব্যাপী অস্ত্রের প্রসার বন্ধে রাষ্ট্রগুলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। তদুপরি স্নায়ুযুদ্ধকালে সহিংসতা কমানোর লক্ষ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে ‘শান্তি, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার এলাকা’ হিসেবে তৈরি করা এবং ভারতীয় মহাসাগর এলাকায় সব ধরনের সংঘর্ষের অবসান ঘটানোর দাবির সপক্ষে বাংলাদেশের সহাবস্থান বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় উপস্থাপন করেন।

বঙ্গবন্ধুর বিশ্বদর্শন ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সমাপনী-পূর্ব আলোচনা

এই প্রবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে মূলত তিনটি আন্তর্জাতিক ভাষণের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রভাব সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। মার্গারেট জি হারম্যানের (১৯৭০) রোল থিওরি ব্যবহারের মাধ্যমে এই ভাষণগুলোর বিশ্লেষণ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান বিশ্লেষণ করলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও তাঁর প্রভাব সম্পর্কে যে ধারণা লাভ হয়, তা হলো, বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের সহজাত দক্ষতা (charishmatic), অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাঁর বহু দিনের অভিজ্ঞতাপ্রসূত নির্দেশিকা নেতৃত্ব (directive) এবং সমন্বয়মূলক নেতৃত্ব (accommodative) প্রদান করার মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ইস্যুকে নিয়ে তা সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করতেন।

নেতৃত্ব তাঁর মধ্যে সহজাত। যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের অভিজ্ঞতা বহুদিন থেকে তাঁর মধ্যে প্রথিত। তাঁর এই নেতৃত্বের সহজাত দক্ষতার মূলে রয়েছে তাঁর পরিবার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, তাঁর পিতা তাঁকে উপদেশ দিতেন, ‘তোমার কাজের প্রতি যদি আন্তরিকতা থাকে, কাজের উদ্দেশ্যে যদি সততা থাকে, তবে তুমি কখনোই জীবনে পরাজিত হবে না।’৩২ বঙ্গবন্ধু তাঁর পরবর্তী জীবনে এই মূল্যবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং তাঁর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি প্রণয়নে আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর সময়ে তাঁর একসময়কার অনুজ রাজনৈতিক শিক্ষানবিশ এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামীবিরোধী শিবিরে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাঁর বাংলাদেশ: এরা অব শেখ মুজিবুর রহমান গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সমালোচনা সত্ত্বেও বলতে বাধ্য হন, ‘আমাদের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা হচ্ছে মুজিব। মৃত্যুতে তাঁর সমাপ্তি ঘটেনি। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনে একজন আলোচিত ও মহান ব্যক্তি হিসেবে বিরাজ করবেন।’৩৩

তাঁর প্রতিটি ভাষণে এক সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনামূলক রূপ রয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে তিনি ভবিষ্যতে জাতিসংঘের ত্রাণ ব্যবস্থাপনা আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ও তার সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রতি আবেদন জানান। একইভাবে আমরা জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন এবং ওআইসির সভায় বঙ্গবন্ধুকে দিকনির্দেশনা প্রদান করতে দেখি, যা তাঁকে জাতীয় নেতৃত্বের ঊর্ধ্বে উঠে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এক অনন্য পরিচয় প্রদান করে। বিশেষ করে এই দুই সম্মেলনে ফিলিস্তিনের জনগণের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ এবং তাদের অধিকার নিয়ে বঙ্গবন্ধু যে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে নিপীড়িত মানুষের মানবাধিকারের বিষয়টি অতিগুরুত্বের সঙ্গে স্বতঃসিদ্ধ বিষয় হিসেবে স্থাপিত হয়েছে।

সমন্বয়মূলক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অতুলনীয়। তিনি তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনের সাহচর্যে কিছু অভিজ্ঞ কূটনীতিবিদের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ দল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন এস এ করিম, ফকরুদ্দীন আহমেদ, মহিউদ্দীন আহমেদ, কে এম শিহাবউদ্দীন এবং এ এইচ মাহমুদ আলী প্রমুখ। এই দল বঙ্গবন্ধুকে তাদের সার্বিক সহায়তা প্রদান করার মাধ্যমে তাঁর নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়তা করত। বঙ্গবন্ধু সমন্বয় করতেন এমনভাবে, যাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাধাগুলো দূর হয়ে যায় এবং একধরনের ঐকমত্যের ওপর ভিত্তি করে এবং সবার সমৃদ্ধিসাধনের মাধ্যমে সামষ্টিক উন্নয়ন সাধন করা যায়। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা যে বিচ্ছিন্ন বিষয় ছিল না, এখানে চীন ও আরব বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি একই সুতায় গাঁথা ছিল, তা উপলব্ধি করার মাধ্যমে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করার পরিপক্বতা বাংলাদেশের হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সফল সমন্বয় সাধন করার গুণাবলি অর্জন করার মাধ্যমে।

পরিশেষে

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে অবস্থিত আমেরিকান কূটনীতিক আর্চার কে ব্লাড তাঁর দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ: মেমোয়ারস অব অ্যান আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট বইয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ‘আপাতদৃষ্টিতে অসাধ্য স্বপ্নকে উজ্বল জ্বলজ্বলে বাস্তবতায় রূপান্তরের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন।৩৪ কিন্তু একটি তথাকথিত ‘অলস স্বপ্নের’ উজ্জ্বল বাস্তবতায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা একাডেমিক গবেষণায় আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হওয়া প্রয়োজন। এই প্রবন্ধে সেই প্রচেষ্টা করা হয়েছে, যা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের যে দক্ষতা, তার প্রতিফলন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কীভাবে বিকশিত হয়েছে, সে বিষয়ে একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারও সঙ্গে বৈরিতা নয় (Friendship to all and malice towards none)—বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এই মূলভিত্তি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃত। বাস্তবসম্মত ও প্রায়োগিক এই নীতি এখনো বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল দর্শন হিসেবে বিবেচিত। এসব বাক্যের মাধ্যমে হয়তো অনেকের এই ধারণা হতে পারে যে শুধু শান্তিপ্রিয় একধরনের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রচার করা হচ্ছে। সেটা অনেকাংশে সত্য, তবে এ-ও সবার উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বশান্তির বিষয়টি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জটিল ও অধরা। এ অবস্থায় বৈরিতাকে প্রশ্রয় দেয়—এ ধরনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কোনোভাবেই প্রযোজ্য নয়। তাই বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ যেভাবে ভারত ও চীনের সঙ্গে বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে সমান্তরাল গতিতে কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যে আমরা সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে বাস্তবিক পররাষ্ট্রনীতির উদাহরণ দেখতে পাই। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্যেও আমরা এই নীতির প্রতিফলন দেখতে পাই। সুতরাং ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ বাংলাদেশের বিশ্বদর্শনের এক চিরন্তন সত্য। বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের সহজাত দক্ষতা (charishmatic), অভিজ্ঞতাপ্রসূত নির্দেশিকা (directive) ও সমন্বয়মূলক (accommodative) পারদর্শিতা প্রদর্শনের মাধ্যমে এই সত্যকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সুদৃঢ় কাঠামো বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করে গেছেন।

তথ্যসূত্র

১.          Margaret G. Hermann, “Explaining Foreign Policy Behavior Using the Personal Characteristics of Political Leaders.” International Studies Quarterly, no. 24, (1970), pp.07~46.

২.          Ali Riaz. God Willing : The Politics of Islamism in Bangladesh, Rowman & Littlefield, 2004, p.179.

৩.         ডয়চে ভেলে, ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ৩১.১০.২০১৭, দেখুন: http://www.dw.com/bn/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC-%E0%A6%AA% E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%90%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%AC%E0%A6% 99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%81%E0%A6%B0-%E0% A7%AD-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0% E0%A 7%8D%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0% A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B7%E0%A6%A3/a-41185982

৪.          মোহম্মদ শাহজাহান, ‘৭ মার্চের ভাষণ: পটভূমি ও তাত্পর্য’, ৭ মার্চ ২০১৫,

            https://www.facebook.com/awamileague.1949/posts/ 345399685649896:0

৫.          বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ (অডিও ও লিখিত),

            http://www.somewhereinblog.net/blog/notredamean/28921021

৬.         http://www.bbc.com/bengali/news-41813131

৭.          ভোরের ডাক, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মহাকাব্য—ড. জাফর ইকবাল’ ১৯ নভেম্বর ২০১৭, http://bhorer-dak.com/details.php?id=84522.

৮.          Walter Carlsnaes, “The Agency-Structure Problem in Foreign Policy Analysis.” International Studies Quarterly 36 (1992): 245-270.

৯.          Valerie M. Hudson, Foreign Policy Analysis: Classic and Contemporary Theory, Rowman & Littlefield Publishing Group Inc, 2007, p.10.

১০.        Hudson, Foreign Policy Analysis.

১১.        Margaret G. Hermann (1970) “Explaining Foreign Policy Behavior Using the Personal Characteristics of Political Leaders.” International Studies Quarterly, no. 24, 7~46.

            ... (1978) “Effects of Personal Characteristics of Leaders on Foreign Policy.” In Why Nations Act, edited by M. A. East, S. A. Salmore, and Charles. F. Hermann. Beverly Hills, CA: Sage.

            ... -(1979) “Who Becomes a Political Leader? Some Societal and Regime Influences on Selection of a Head of Government.” In Psychological Models in International Politics, edited by Lawrence Falkowski. Boulder, CO: Westview.

            ... (1984) “A Study of 53 Heads of Government.” In Foreign Policy Decision Making : Perception, Cognition, and Artificial Intelligence, edited by Donald A. Sylvan and Steve Chan, 53~80. New York : Praeger.

১২.        মহিউদ্দিন আহমদ, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনেক সাফল্য কিছু ব্যর্থতা এবং তিনটি কলংক’, যুগান্তর, ১৮ আগস্ট ২০১৪,

http://www.jugantor.com/old/window/2014/08/18/136168

১৩.        Imtiaz Ahmed, Bangladesh Foreign Policy : Constraints, Compulsions and Choices, BIISS Journal, vol. 32, no. 3, July 2011 : 207-218.

১৪.        Craig Baxter, Bangladesh: From a Nation to a State, Boulder, Colorado, Westerview Press, 2006.

১৫.        Justus Kroef, ‘Bangladesh: The Burdens of Independence’, Asian Affairs, Vol. 1, No. 6 (1974), pp. 377-389.

১৬.        Fakhruddin Ahmed, Critical Times: Memoires of a South Asian Diplomat, Dhaka: UPL, 1994, pp.100-04.

১৭.        Fakhruddin Ahmed, Critical Times, 1994, p.103.

১৮.        Fakhruddin Ahmed, Critical Times, 1994, p.104.

১৯.        Fakhruddin Ahmed, Critical Times, 1994, p.114-122.

২০.        S. A. Karim, Sheikh Mujib: Triumph and Tragedy, Dhaka: UPL, 2014, p. 340.

২১.        বাংলা ভাষায় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, http://imli.gov.bd/test6/.

২২.        আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, http://imli.gov.bd/test6/.

২৩.        আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট, http://imli.gov.bd/test6/

২৪.        আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, http://imli.gov.bd/test6/

২৫.        আরও বিস্তারিত পড়ার জন্য, Fakhruddin Ahmed, Critical Times: Memoirs of a South Asian Diplomat, Dhaka: UPL, 1994, pp.100-110.

২৬.        আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, http://imli.gov.bd/test6/.

২৭.        আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, http://imli.gov.bd/test6/.

২৮.        Rabindranath Tribedi, International Relations of Bangladesh and Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman 1974-75, Vol. II, Dhaka: Parama, 1999, p.91-93.

২৯.        Tribedi, International Relations of Bangladesh, II, p.92.

৩০.        Kamal Hossain, Bangladesh: Quest for Freedom and Justice, Dhaka: UPL, 2016, p. 236.

৩১.        Rabindranath Tribedi, International Relations of Bangladesh and Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman 1974-75, Vol. I, Dhaka: Parama, 1999, p.398-9.

৩২.        Sheikh Mujibur Rahman, The Unfinished Memoirs, Dhaka: UPL, 2012, p.

৩৩.       Moudud Ahmed, Bangladesh: Era of Sheikh Mujibur Rahman, Dhaka: UPL, 1983, p.13.

৩৪.        Archer K. Blood, The Cruel Birth of Bangladesh: Memoirs of an American Diplomat, Dhaka: UPL, 2002.

এই প্রবন্ধের একটি অংশ ২০১৭ সালের ১৮ মার্চ গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত “বঙ্গবন্ধু ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক” সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়েছিল।