ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্নকরণের ইতিবৃত্ত

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

দ্য এথিনক ক্লিনজিং অব প্যালেস্টাইন—ইলান পেপে, ওয়ানওয়ার্ল্ড পাবলিকেশনস, লন্ডন, ২০০৬; পৃষ্ঠা-২৫৬

এক
আজ থেকে শত বছর আগে মাত্র ৬৭ শব্দের একটি ছোট পত্র মধ্যপ্রাচ্য তথা গোটা বিশ্বের জন্য এক অশেষ বিপর্যয়ের গোড়াপত্তন করেছিল। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব লর্ড আর্থার বালফোর ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ছোট পত্রটি লিখেছিলেন, যা কালক্রমে বালফোর ঘোষণাপত্র নামে পরিচিতি পায়। তাতে তিনি বলেন: ‘মহামান্য (ব্রিটিশ) সরকার প্যালেস্টাইনে ইহুদি জনগণের জন্য জাতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার পক্ষে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন; আর এই লক্ষ্য অর্জনে সর্বোত্তম প্রয়াস প্রয়োগ করা হবে এবং এটাও পরিষ্কার যে এমন কিছু করা হবে না, যা প্যালেস্টাইনে বিদ্যমান অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার কিংবা অন্য কোনো দেশে ইহুদিদের বিরাজমান অধিকার ও রাজনৈতিক অবস্থান ক্ষুণ্ন করতে পারে।’ এই পত্র দেওয়া হয়েছিল জাইয়নবাদী নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে। এর ২০ বছর আগে ১৮৯৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে বিশ্ব জাইয়নবাদী সংস্থা (ওয়ার্ল্ড জাইয়নিস্ট অর্গানাইজেশন)।

বালফোর ঘোষণার জের ধরে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বলপূর্বক প্রতিষ্ঠা করা হয় জাইয়নবাদী বা উগ্র ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। আর এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠালগ্নে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের পিতৃপুরুষের আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদ ও বিতাড়ন করা হয় হত্যা, হামলা, ধর্ষণ ও লুটতরাজ চালিয়ে। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বা আরব হয়ে পড়ে উদ্বাস্তু ও শরণার্থী। অল্প কিছু যারা রয়ে যায় এবং পরবর্তী সময়ে যারা ফিরে আসার সুযোগ পায়, তারা হয়ে পড়ে নিজ ভূমে পরবাসী ও অবরুদ্ধ। পুরো প্রক্রিয়াটিকে ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইলান পেপে অভিহিত করেছেন, ‘ফিলিস্তিনে জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ’ হিসেবে। এই শিরোনামে (দ্য এথিনক ক্লিনজিং অব প্যালেস্টাইন) তাঁর রচিত বইটি মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

ইলান পেপেকে বলা হয় ইসরায়েলের নয়া ইতিহাসবিদ (নিও হিস্টোরিয়ান) বা সংশোধনবাদী (রিভিশনিস্ট) ধারার ইতিহাসবেত্তা। এই ধারার সূত্রপাত ঘটান মূলত ইসরায়েলের বেনগুরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেনি মরিস ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আভি শ্লিম। সেটা আশির দশকের একেবারে শেষভাগে। তাঁদের সঙ্গে আরও কয়েকজন পরবর্তী সময়ে যোগ দেন। এই সংশোধনবাদী ইতিহাসবিদেরা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের অভ্যুদয় বা ইসরায়েলের স্বাধীনতাকে আরবদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করতে আগ্রহী। তাঁরা মনে করেন যে আরব তথা ফিলিস্তিনিরা হলো শিকার আর ইহুদি তথা ইসরায়েলিরা হলো আগ্রাসনকারী। আর তাই ইহুদিদের ওপর পরবর্তী সময়ে যে আঘাত-আক্রমণ নেমে এসেছে, তা মূলত ইহুদিদেরই আক্রমণ-হামলার প্রত্যুত্তর। মোটাদাগে তাঁরা (জাইয়নবাদী ও ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতিশীল পশ্চিমা বিশ্ব দ্বারা) ‘ইসরায়েলের স্বাধীনতা নিয়ে প্রচলিত ও স্বীকৃত’ মূল বিষয়গুলোর বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং তথ্য-প্রমাণ সহযোগে দেখিয়েছেন যে প্রকৃত সত্যগুলো ভিন্ন।

সংশোধনবাদী ইসরায়েলি ইতিহাসবিদেরা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূলত পাঁচটি ‘প্রচলিত ও স্বীকৃত’ ভাষ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সেগুলোর বস্তুনিষ্ঠতায় যথেষ্ট ঘাটতি খুঁজে পেয়েছেন ও প্রকৃত সত্য চাপা দেওয়ার যাবতীয় প্রয়াসের প্রমাণ পেয়েছেন। প্রথমত, ব্রিটেন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে বলে বহুল প্রচলিত দাবির বিপরীতে তাঁরা বলছেন, ব্রিটেন বরং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ছিল। দ্বিতীয়ত, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিরা স্বেচ্ছায় নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল বলা হলেও সংশোধনবাদীরা বলছেন, তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বা যেতে বাধ্য করা হয়েছে। তৃতীয়ত, ক্ষমতার ভারসাম্য আরবদের অনুকূলে থাকার দাবি ঠিক নয় উল্লেখ করে তাঁরা বলছেন, লোকবল ও অস্ত্রশস্ত্রে ইহুদিরা অনেক এগিয়ে ছিল। চতুর্থত, ইসরায়েলকে ধ্বংস করার জন্য আরবদের সমন্বিত পরিকল্পনা ছিল—এই দাবি নাকচ করে সংশোধনবাদীরা বলছেন, আরবরা বরং বিভক্ত ছিল। পঞ্চমত, আরবদের অনমনীয়তা শান্তিপ্রক্রিয়া বারবার বাধাগ্রস্ত করার দাবির বিপরীতে সংশোধনবাদীরা বলছেন, শান্তিপ্রক্রিয়া আটকে দেওয়ার জন্য মূলত ইসরায়েলই দায়ী।

তবে সংশোধনবাদী ইতিহাসবিদদের মধ্যেও তাঁদের প্রতিষ্ঠিত পাল্টা সত্যের কোনো কোনোটির কার্যকারণ নিয়ে মতভেদ আছে। ফিলিস্তিনি আরবরা যে নিজেদের বাসভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল, তার কারণ হিসেবে বেনি মরিস দেখান যে এটা ছিল যুদ্ধের একটি অনিবার্য ফল। অন্যদিকে ইলান পেপে দেখাচ্ছেন, এটা ছিল জাইয়নবাদীদের একটি পরিকল্পিত কাজ। বলা যেতে পারে, এটাই পেপের বইটির সারভাষ্য। ১২টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বইয়ে লেখক ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্নকরণ পরিকল্পনার ইতিহাস ও রূপরেখা তুলে ধরেছেন; জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ সংজ্ঞায়িত করে কেন তা ফিলিস্তিনিদের জন্য প্রযোজ্য, সেটি ব্যাখ্যা করেছেন; জায়নবাদের উত্সমূলে আলোকপাত করেছেন; ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইহুদিদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলো তুলে ধরেছেন; এবং রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরুর পর থেকে ফিলিস্তিনিদের ওপর নিরন্তর নির্যাতনের বিবরণ দিয়েছেন।

ইতিহাসবিদ ও গবেষক হিসেবে ইলান পেপের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, ফিলিস্তিনিরা যে জাইয়নবাদী ইসরায়েলের জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ কর্মসূচির শিকার, তা প্রতিষ্ঠা করা। ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দলিলপত্র দিয়ে এবং আরবদের ভাষ্য ও তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে তিনি তাঁর এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘হোলোকাস্টের পর মানবতার বিরুদ্ধে কোনো বড় অপরাধ লুকানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমাদের আধুনিক যোগাযোগচালিত বিশ্ব, বিশেষত ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাপক সম্প্রসারণ আর কোনো মানবসৃষ্ট বিপর্যয় জনমানুষের চোখের আড়াল হতে বা অস্বীকার করতে সুযোগ দেয় না। তারপরও এ রকম একটি অপরাধ বিশ্বের জনমানুষের স্মৃতি থেকে প্রায় মুছে ফেলা হয়েছে। সেটি হলো ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলিদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের অধিকারচ্যুত করা। ফিলিস্তিন ভূমির আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা শুরু থেকে পদ্ধতিগতভাবে অস্বীকার করা হয়ে আসছে, যা আজও ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আর অপরাধ হিসেবে মেনে নেওয়া তো অনেক দূরে, যা কি না রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে মোকাবিলা করা প্রয়োজন।’ (পৃ- xiii)।

দুই

ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে আরবদের জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্নকরণের বা নিধনের সত্যটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রয়োজন এই ‘জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ’১ বলতে কী বোঝায়, তা সুস্পষ্ট করা। ইলান পেপে জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের সর্বজনস্বীকৃত আন্তর্জাতিক সংজ্ঞাকে ব্যবহার ও বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলছেন, আন্তর্জাতিক আইনেই জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণকে বেশ ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত করা আছে এবং এটাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। হাচিনসন এনসাইক্লোপিডিয়াসহ একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে তিনি বলছেন, কোনো ভূখণ্ডে একটি অভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষের একচ্ছত্র কর্তৃত্বের জন্য সেখান থেকে অন্য কোনো নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে জোরপূর্বক বিতাড়ন করাই হলো জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এই সংজ্ঞাকে গ্রহণ করে বলছে, এর মূলে আছে কোনো একটি অঞ্চলের ইতিহাস মুছে ফেলার অপপ্রয়াস। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বলেছে, কোনো একটি রাষ্ট্র বা সরকার যখন মিশ্রিত জনগোষ্ঠীর আবাসভূমিতে একক জনগোষ্ঠীর শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষদের বিতাড়িত করে এবং এ জন্য বিভিন্ন সহিংস কর্মকাণ্ড চালায়, তখন তা রূপ নেয় জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণে। এসব সহিংস কর্মকাণ্ডের মধ্যে আছে নারী ও পুরুষদের আলাদা করে ফেলা, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যেন না পারে সে জন্য পুরুষদের হত্যা করা, তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করা এবং তাদের আবাসভূমিতে অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের বসত গড়ে তোলা।

পেপে জোর দিয়ে বলেছেন, ১৯৪৮ সালে জাইয়নবাদীরা তাদের ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ’ শুরু করে ‘প্ল্যান দালেত’ (সংক্ষেপে প্ল্যান ডি) বাস্তবায়নের মাধ্যমে, যা আসলে ছিল ফিলিস্তিনে ‘নিশ্চিহ্নকরণ’। এই নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যবহূত হয়েছে ঠান্ডা-মাথায় গণহত্যা, নির্বিচারে হত্যা, বেছে বেছে নিধন এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। এসবই ছিল যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যা কিনা ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং সমষ্টিগত স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।

ইলান পেপে এ-ও মনে করেন, রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের আবির্ভাবের পূর্বাপর সময় ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে যা ঘটেছে, সে সম্পর্কে যে দুটি পরস্পরবিরোধী ঐতিহাসিক ভাষ্য প্রচলিত আছে, সে দুটিতেই জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। ইসরায়েলি তথা জাইয়নবাদী ভাষ্য অনুসারে, স্থানীয় জনগণ স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছিল। আর ফিলিস্তিনিদের ভাষ্য হলো, তাদের ওপর বিপর্যয় বা ‘নাকবা’ নেমে এসেছিল, যদিও এটি নিজেই একটি ধোঁয়াশা অভিধা। কেননা, এটি বিপর্যয়ের ওপরই অধিকতর জোর দেয়, কেন বা কার দ্বারা সৃষ্ট, সে বিষয়ে নয়। বোঝাই যায় (আরবি) ‘নাকবা’ অভিধাটি গ্রহণ করা হয়েছিল ইহুদি নিধন বা হোলোকাস্টের (হিব্রুতে ‘শোয়া’) বিপরীতে, তবে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের বাদ দিয়ে। ফিলিস্তিনে ১৯৪৮ সালের জাতিগত নিধনের বিষয়টি বিশ্ববাসী যে ক্রমাগত অস্বীকার করে আসছে, তাতে এই অভিধাও এক অর্থে অবদান রেখেছে। (পৃ- xvii)। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মূলত হিটলারের জার্মানিতে নািস বাহিনীর নেতৃত্বে যে ইহুদি নিধনযজ্ঞ চলে, সেটাই হোলোকাস্ট হিসেবে কুখ্যাত। এই হোলোকাস্টে ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছে বলে স্বীকৃতি মিলেছে, যদিও প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আবার এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের সেমেটিয়-বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, যা আরেক আলোচনার বিষয়।

ইলান পেপে জানতেন যে এ ধরনের একটি শিরোনাম দিয়ে বই প্রকাশ করা বা এ বিষয়ে কাজ করার ফলে তিনি ইসরায়েলি ও ইসরায়েল সমর্থক পশ্চিমা বিশ্বের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়বেন। একপর্যায়ে বইয়ের প্রকাশকও তাঁকে নামের বিষয়টা আবার ভেবে দেখতে বলেন।২ তিনি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইট ঘেঁটে সেখানে জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের বিষয়ে কী বলা আছে, তা পর্যালোচনা করে আবারও নিশ্চিত হন যে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যা করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে, তা এই জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ ছাড়া অন্য কিছু নয়। সেখানকার বিবরণে শুধু বিতাড়নই নয়, বরং এর আইনগত দিকও তুলে ধরা হয়েছে, যা আসলে মানবতাবিরোধী অপরাধ। আর এই অপরাধের একমাত্র ক্ষতিপূরণ হলো, বিতাড়িত মানুষদের কাছে জানতে চাওয়া যে তারা তাদের আবাসভূমিতে ফিরে আসতে চায় কি না।

এই জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ বা নিধন চালানো এবং ইহুদিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বরূপ বোঝার জন্য জাইয়নবাদ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেওয়াটা জরুরি বলে মনে করেন ইলান পেপে। আর তাই তিনি এ সম্পর্কে প্রথম দিকেই আলোকপাত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে জাইয়নবাদের শিকড় প্রোথিত ছিল সেই ১৮৮০-এর দশকে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে একটি জাতীয় পুনরুত্থান আন্দোলন হিসেবে, আর তা হয়েছিল ওই অঞ্চলের ইহুদিদের ওপর সৃষ্ট চাপের কারণে। চাপটা ছিল ক্রমাগতভাবে হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঝুঁকি। থিওডোর হারজেল নামের একজন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় ইহুদি রাজনীতিক ও সাংবাদিক এই আন্দোলনের প্রবক্তা হিসেবে স্বীকৃত; যদিও তাঁর আগে থেকেই এই আন্দোলন দানা বাঁধে। জাইয়নবাদ আন্দোলন থেকে দাবি তোলা হয় যে ইহুদিদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হলো ইসরায়েলের ভূমি (ল্যান্ড অব ইসরায়েল বা এরতেজ ইসরায়েল), যদিও প্রথম দিকে আবাসভূমির স্থান সম্পর্কে বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। ১৯০৪ সালে হারজেলের মৃত্যুর পর এই আন্দোলন আরও বেগবান হয় এবং মূল লক্ষ্য হয় ফিলিস্তিনকে এই স্বতন্ত্র আবাসভূমিতে রূপান্তর করার। সে জন্য আবিষ্কার করা হয় এক নতুন তত্ত্ব: ‘জনগণহীন একটি ভূমি, যা কিনা ভূমিহীন একটি জনগোষ্ঠীর জন্য।’ শুরু হয় প্রচারণা: বাইবেলের সূত্রে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে আসলে বহিরাগত ব্যক্তিদের দ্বারা অধিকৃত হয়েছে, যা কিনা শুধু ইহুদিদের একক আবাসভূমি। কাজেই এই আবাসভূমি উদ্ধার করতে হবে, প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে সেখানে ইহুদি ব্যতীত অন্য কারও কোনো অধিকার নেই ও থাকবে না। অথচ ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে তখন বর্ধিষ্ণু ফিলিস্তিনি আরবদের বসবাস, যাদের সিংহভাগই মুসলমান। পাশাপাশি কিছু খ্রিষ্টান ও ইহুদির বসবাসও রয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৭ সালে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়। ১৯২০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশরাজ ম্যানডেটরি ফিলিস্তিনের শাসনভার গ্রহণ করে, যা চলে ১৯৪৮ সালের মে মাস পর্যন্ত। এটি ছিল জর্ডান নদীর পশ্চিম দিকের ভূখণ্ড, যেখানে আজকের ইসরায়েল রাষ্ট্র ও তাদের দখলে থাকা পশ্চিম তীর ও গাজা অবস্থিত। ম্যানডেটরি ফিলিস্তিন কার্যত ইহুদিদের প্রতিশ্রুত আবাসভূমি গড়ে দেওয়ার পথ খুলে দেয়, যার বীজ রোপণ করা হয়েছিল কথিত বালফোর ঘোষণায়, যা এই নিবন্ধের প্রারম্ভে উল্লেখ করা হয়েছে। জাইয়নবাদীরাও অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে, যার একটি ছোট্ট প্রমাণ মেলে ১৯২৭ সালে প্রবর্তিত ধাতব মুদ্রায়। এই মুদ্রার গায়ে আরবি ও ইংরেজিতে ফিলিস্তিন নামটি খোদাই করার পাশাপাশি হিব্রুতেও তা খোদাই করা হয়। তবে হিব্রুতে ফিলিস্তিন নামের পাশাপাশি বন্ধনীতে সংক্ষেপে হিব্রু প্রথম হরফ ‘অহ-লেফ’লেখা হয়, যার মানে হলো ‘এরতেজ ইসরায়েল’ বা ল্যান্ড অব ইসরায়েল। পেপে দেখাচ্ছেন যে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের শাসনভার গ্রহণ করার পর থেকেই সেখানকার ৯০ শতাংশ বা তারও বেশি অধিবাসী আরবদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে, বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে আর জাইয়নবাদী তথা ইহুদি সেটেলারদের বিভিন্নভাবে অগ্রাধিকার সুবিধা দিতে থাকে। এর ফলে দলে দলে ইহুদিরা ইউরোপ ও অন্য আরব দেশ থেকে ফিলিস্তিনে পাড়ি জমাতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই ফিলিস্তিনিরা তা মেনে নিতে চায়নি বা মেনে নিতে পারেনি। তারাও ধীরে ধীরে শঙ্কিত হয়ে পড়ে যে এভাবে ইহুদি অভিবাসীর ঢল নামলে নিজ দেশে তাদেরই সমস্যা হবে। অবশ্য ফিলিস্তিনি বা আরবরা যে এ জন্য খুব শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল, তার জোরালো প্রমাণ মেলে না। কিন্তু ব্রিটিশদের নানা ধরনের অন্যায়-অবিচার-অত্যাচারের কারণে ১৯২৯-৩০ সালে আরবরা একবার ছোটখাটো একটা বিদ্রোহ করে। তবে ১৯৩৬-৩৯ সময়কালের দ্বিতীয় ও বড় ধরনের বিদ্রোহটি ব্রিটিশরাজকে শঙ্কিত করে। তাই তারা নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে আর অনেক ফিলিস্তিনি নেতাকে দেশছাড়া করে। আর এই গোলযোগের মধ্যেই পিল কমিশন ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে একটি ছোট ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করে সেখানকার আরবদের পূর্বে ট্রান্স-জর্ডান ও পশ্চিমে মিসর-সংলগ্ন বৃহত্তর অংশে স্থানান্তরের প্রস্তাব দেয়। পিল কমিশনের প্রস্তাবে জেরুজালেম ও বেথেলহামকে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে একটি ছিটমহল হিসেবে রাখার কথাও বলা হয়। আরবরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও জাইয়নবাদী নেতারা এতে সমর্থন দেয়। কেননা এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের একটি ভিত্তি রচিত হয়ে যায়।

এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি যে কথা বলেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘(১৯৩৮ সালের) পরবর্তী বছরগুলোয় স্বদেশি আরবরা পশ্চিমের কাছে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণযোগ্য এ ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে যে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয়দের কৃত অপরাধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের (আরবদের) নিজ ভূমি উত্সর্গ করতে হবে। তাদের কাছে সম্ভবত এটা বিস্ময়কর ছিল যে (জার্মানির) বাভারিয়ার অধিবাসীদের সরিয়ে সেখানে কেন একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করা হচ্ছে না। অথবা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তাদের ন্যায়নীতি ও নৈতিকতার বাণী শুনতে হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বা নিউইয়র্কে কেন এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।’৩

আবার ব্রিটিশরা অভিবাসী ইহুদিদের নিয়ে ১৯২১ সালেই গঠন করে হাগানা নামের আধা সামরিক বাহিনী। ১৯২১ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ম্যানডেটরি ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ বাহিনীর পাশাপাশি হাগানার সদস্যরাও আরবদের ওপর দমনপীড়ন চালায় এবং শেষ দিকে ব্রিটিশ বাহিনীকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। আরও দুটি জাইয়নবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইরগুন ও লেহি (যা স্টার্ন গ্যাং নামে অধিক পরিচিত) ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হাগানার সঙ্গে একীভূত হয়ে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়।

তিন.

ইলান পেপে ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্নকরণের যজ্ঞ পরিকল্পনা ও পরিচালনার প্রধান খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়নকে। পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী বেন গুরিয়ন ১৯০৬ সালে অটোম্যান ফিলিস্তিনে অভিবাসী হয়ে আসেন। অসাধারণ বিচক্ষণতা, সাহস ও কূটকৌশলের অধিকারী গুরিয়ন বরাবরই কট্টর জাইয়নবাদী হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তোলেন। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের অভ্যুদয় ঘোষণা করেন। তিনি ১৯২০-এর দশক থেকে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত জাইয়নবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। ফিলিস্তিনিদের নিজ বাসভূমি থেকে জোরজবরদস্তি করে বিতাড়ন ছাড়া ইহুদিদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা হবে না, এটাই ছিল বেন গুরিয়নের মূলমন্ত্র। তাঁর যাবতীয় কর্মকাণ্ড এই মূলমন্ত্র দ্বারাই পরিচালিত হয়েছে। তিনি যে ডায়েরি বা রোজনামচা লিখতেন, তাতে প্রায় প্রতিটি পরিকল্পনা ও ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ফলে এটি একটি বড় ঐতিহাসিক সূত্র হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে।

ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নের জন্য বেন গুরিয়ন ও তাঁর সহযোগী অন্য জাইয়নবাদী নেতাদের প্রয়োজন ছিল একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা, যেটি রূপ নেয় প্ল্যান দালেতে। ইলান পেপে বেশ বিস্তারিতভাবে ‘প্ল্যান দালেত’ বাস্তবায়নের বিভিন্ন ঘটনা গ্রন্থিত করেছেন। তাঁর এই কাজ সহজ হয়েছে ইসরায়েলি দলিলপত্রের কারণে। এটা বেশ লক্ষণীয় যে জাইয়নবাদী নেতা ও তাঁদের সহযোগীরা ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বাপর প্রায় প্রতিটি কর্মপরিকল্পনা এবং সেসব বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলো যত্নের সঙ্গে লিপিবদ্ধই শুধু করেননি, দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নততর তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এসব ঐতিহাসিক দলিলের স্থায়িত্ব বাড়িয়েছে, আবার সেগুলো ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে সহায়তা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন নির্দিষ্ট মেয়াদের পর বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় দলিল অবমুক্ত করে থাকে, ইসরায়েলও তেমনিভাবে বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক দলিলপত্র প্রকাশ করে। এই নীতিটি রাষ্ট্র পরিচালনায় একটি স্বচ্ছতার নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

পেপে আমাদের জানাচ্ছেন যে ফিলিস্তিনের প্রতিটি গ্রামের মানুষের সংখ্যা, গ্রামপ্রধান বা মুখতারের পরিচিতি, গ্রামে প্রবেশ-নির্গমনপথ ইত্যাদিসহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল নিধন-বিতাড়নযজ্ঞ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে পুরোদমে এই নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। যে কটি গণহত্যা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, তার মধ্যে সবার আগে আসে দেইর ইয়াসিনের গণহত্যা। এ প্রসঙ্গে চমস্কি বলছেন, ‘এপ্রিল মাসে ইরগুন-লেহি দেইর ইয়াসিনে যে গণহত্যা চালায়, তা আরবদের ব্যাপকভাবে পালাতে বাধ্য করে। ঘটনাটি বেশ উত্সাহের সঙ্গেই ইরগুন ও লেহির আনুষ্ঠানিক ভাষ্যে উঠে এসেছে। বিশেষ করে সন্ত্রাসী অধিনায়ক মোশে দায়ানের জবানিতে, যিনি কিনা শতাধিক নারী-শিশুসহ ২৫০ জন অরক্ষিত মানুষকে নির্মমভাবে হত্যার অভিযান পরিচালনার জন্য গর্বিত হয়েছিলেন।’৪

ফিলিস্তিনিদের স্বদেশ থেকে বিতাড়ন ও জোরপূর্বক ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মযজ্ঞে পশ্চিমা বিশ্ব, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আরব রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকার ওপর সংক্ষেপে কিন্তু তাত্পর্যবাহী আলোকপাত করেছেন পেপে। তিনি দেখিয়েছেন যে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপ জাইয়নবাদী তথা ইহুদিদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসম্ভার সরবরাহ করেছে, যা ইসরায়েলের শক্তিসামর্থ্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্রিটেন ও ফ্রান্স থেকেও ইহুদিরা অস্ত্র পেয়েছে অথচ এই দুটি দেশ আরব দেশগুলোয় অস্ত্র বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তিনি ব্রিটিশদের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন যে ম্যানডেট শেষ হওয়া পর্যন্ত (১৪ মে, ১৯৪৮) ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের অধিবাসীদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর ন্যস্ত থাকলেও তারা তা পালন করেনি বা পালন করতে চায়নি। তিনি বলছেন, ‘১৯২৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনকে ব্রিটিশ বলয়ের অধীনে একটি রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করত, উপনিবেশ হিসেবে নয়। ব্রিটিশ অভিভাবকত্বে এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে ইহুদিদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও ফিলিস্তিনিদের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা দুই-ই পূরণ হতে পারে। তাই তারা এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল, যা সংসদে ও সরকারে দুই সম্প্রদায়েরই সমতাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে। বাস্তবে অবশ্য যা করা হলো, তা হলো জাইয়নবাদী উপনিবেশগুলোকে বাড়তি সুবিধা দান ও সংখ্যাগুরু ফিলিস্তিনিদের প্রতি বৈষম্য। প্রস্তাবিত নতুন আইনসভার ভারসাম্য ইহুদিদের অনুকূলে গেল। সেখানে ব্রিটিশ প্রশাসনের নিযুক্ত সদস্যরা ইহুদিদের মিত্র ছিল।’ (পৃ-১৪)।

আরব বিশ্বের মধ্যে জর্ডানের বাদশা আবদুল্লাহ গোপনে বেন গুরিয়নের সঙ্গে সমঝোতা করে সে দেশের সেনাবাহিনীকে ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় নিয়োজিত করেননি। যেটুকু করেছিলেন, তা ছিল লোক দেখানো। ইলান পেপে লিখেছেন, ‘যদিও জর্ডানের সেনাবাহিনী ছিল আরব বাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী আর তারা ইহুদি রাষ্ট্রটির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠেছিল, তবু ফিলিস্তিন যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই তাদের নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল বাদশা আবদুল্লাহ যে জাইয়নবাদী আন্দোলনের সঙ্গে কৌশলগত মৈত্রী গড়ে তোলেন তার মাধ্যমে।৫ আর তাই আরব লিজিওয়েনর ইংরেজ কমান্ডার-ইন-চিফ গ্লাব পাশা ১৯৪৮ সালের যুদ্ধকে “নকল যুদ্ধ” বলে অভিহিত করেছিলেন।’ (পৃ-১২৮)।

পেপে জানাচ্ছেন, মিসর একেবারে শেষ মুহূর্তে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হওয়ার মাত্র দুদিন আগে ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় ১০ হাজার সৈন্য প্রেরণ করে, যার ৫০ শতাংশই ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য, যারা সদ্য জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে। তাদের কোনো সামরিক প্রশিক্ষণই ছিল না, ছিল কেবল জঙ্গিপনা। সিরীয় বাহিনী তুলনামূলকভাবে প্রশিক্ষিত ছিল, তাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিও জোরালো ছিল। কিন্তু ফরাসি ম্যান্ডেট থেকে সদ্যমুক্ত হওয়া দেশটির স্বল্পসংখ্যক সৈন্য ফিলিস্তিনে এমন বাজেভাবে লড়েছিল যে ১৯৪৮ সালের মে মাস শেষ হওয়ার আগেই ইহুদি রাষ্ট্রটি তার উত্তর-পূর্ব সীমান্ত সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয় গোলান উপত্যকা দখলের মাধ্যমে। অবশ্য ইসরায়েল গোলান উপত্যকা দখলে নেয় ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর। লেবাননের সেনাবাহিনী তো অনীহাভরে কোনোমতে সীমান্তসংলগ্ন গ্রামগুলো রক্ষার চেষ্টা করেছিল। একমাত্র ইরাকি সেনাবাহিনী কিছুটা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল, যার ফলে ওয়াদি আরার ১৫টি গ্রাম রক্ষা পায়। সোজা কথায়, ইসরায়েলি শক্তিশালী বাহিনীর বিপরীতে আরব সেনাবাহিনীগুলো ছিল দুর্বল, সমন্বয়হীন ও দায়িত্বহীন। আরব সরকারগুলো দ্বিমুখী আচরণ করেছে। আরব লিগ জর্ডানের বাদশা আবদুল্লাহকে সব আরব বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার নিয়োগ করে। অথচ তিনি পশ্চিম তীর জর্ডানে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন, বেন গুরিয়নের এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ইহুদি রাষ্ট্র আক্রমণে বিরত থাকেন। একজন ইরাকি জেনারেলকে করা হয়েছিল ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার। কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারেননি। আর কথিত যুদ্ধ শুরুর অল্প পরেই আরব বাহিনীগুলোতে অস্ত্র সরবরাহে ঘাটতি দেখা যায়। পেপে বলছেন, ‘জর্ডানীয়রা কখনোই ১৯৪৮ সালের মে, জুন ও জুলাই মাসের দিনগুলো ফিরে দেখেনি, যখন তারা সাধারণ আরব প্রচেষ্টাকে নিস্তেজ করার জন্য সবকিছুই করেছিল। অথচ ১৯৫৮ সালে বিপ্লবী শাসকেরা ইরাকে ক্ষমতায় আসার পর সে দেশের জেনারেলদের তাদের এই (১৯৪৮ সালের ফিলিস্তিন) বিপর্যয়ে ভূমিকার জন্য বিচারের মুখোমুখি করেছিল।’ (পৃ-১৩০)।

মোটকথা, আরব শাসকেরা শুরু থেকেই জাইয়নবাদীদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ইসরায়েলের শক্তিমত্তা সম্পর্কেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল না। একইভাবে নিজ বাহিনীগুলোর ক্ষমতা সম্পর্কেও তারা ছিল অসচেতন। তাদের এই দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে বেন গুরিয়ন বেশ ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন। ফলে তিনি ও অন্য জাইয়নবাদী নেতারা ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন ও নিধনের যে ছক কষেছিলেন, তা অনেক সহজ হয়েছিল। সে কারণেই মিসরীয় যুদ্ধবিমান যখন কয়েক দফা তেল আবিবে বোমাবর্ষণ করে কিংবা সিরীয় বাহিনী যখন মিসরে ইহুদি বসতি দখল করে নেয়, তখন বেন গুরিয়ন তাত্ক্ষণিকভাবে পাল্টা আক্রমণ বা প্রতিশোধের কোনো পদক্ষেপই নেননি। কেননা, তিনি জানতেন যে অল্প সময়ের ব্যবধানে এই দৃশ্যপট পাল্টে যাবে। তার চেয়ে বরং ফিলিস্তিনিদের দেশছাড়া করার কাজটি জোরেশোরে চালিয়ে যাওয়াই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পেপে বলছেন, ‘ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার অন্যতম মিথ যুদ্ধ (যা কিনা আরবদের আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল) শুরু থেকেই ফিলিস্তিনিরা স্বেচ্ছায় পালাতে শুরু করার বিষয়টি যে হালে পানি পায় না, তা এতক্ষণে স্পষ্ট। আর এটা নিতান্তই অতিরঞ্জন যে ফিলিস্তিনিদের থেকে যেতে ইহুদিরা চেষ্টা চালিয়েছিল। অথচ এটাই ইসরায়েলি পাঠ্যবইয়ে এখনো তুলে ধরা হচ্ছে। আমরা যেমনটা দেখেছিলাম, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বলপূর্বক বিতাড়িত হয়। আর যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহে আরও কয়েক লাখ এই বিতাড়নের শিকার হয়। আসলে বেশির ভাগ ফিলিস্তিনির জন্য ১৯৪৮ সালের ১৫ মে সেই সময় কোনো বিশেষ গুরুত্ব বয়ে আনেনি। বরং সেটি ছিল জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের ভয়াবহ দিনপঞ্জিতে আরেকটি বাড়তি দিন। আর এই নিশ্চিহ্নকরণ শুরু হয়েছিল পাঁচ মাসের বেশি সময় আগে।’ (পৃ-১৩১)।

জাতিসংঘের ভূমিকারও সমালোচনা করেছেন পেপে। তাঁর মতে, জাতিসংঘ পুরো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে ও এখনো করে যাচ্ছে—সমস্যা সমাধানে একের পর এক বেঠিক ও বিভ্রান্তিকর প্রস্তাব এনে। ১৯৪৭ সালে মাত্র দুই বছরের অনভিজ্ঞ জাতিসংঘ ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশেষ কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ওই বছরের ২৯ নভেম্বর সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড আরব ও ইহুদিদের মধ্যে বিভক্ত করার যে প্রস্তাব দেয়, তাতে দেশটির জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক বা জাতিগত পরিচিতি ও প্রাধান্য পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়। পেপের মতে, ‘যদি জাতিসংঘ ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি বিবেচনায় নিয়ে তাদের ভবিষ্যত্ রাষ্ট্রের আয়তন নির্ধারণ করত, তাহলে তা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের বেশি হতো না। কিন্তু জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের ওপর জাইয়নবাদী আন্দোলনের জাতীয়তাবাদী দাবি মেনে নেয় এবং আরেক ধাপ এগিয়ে ইউরোপে নাজি হোলোকাস্টের ক্ষতিপূরণ দিতে চায়।’ (পৃ-৩১)।

জাইয়নবাদীরা ফিলিস্তিনিদের নিজ বাসভূম থেকে উত্খাতে জৈব-সন্ত্রাস বা জৈব-যুদ্ধভীতি৬ তৈরির কাজও করেছিল, যদিও সেটা ছিল খুব সীমিত পর্যায়ে। পরবর্তী সময়ে ইসরায়েলে জৈব অস্ত্র গবেষণা ও উদ্ভাবনের যে বিস্তার ঘটে, তার বীজ নিহিত ছিল এর মধ্যে। পেপে জানাচ্ছেন, উপকূলবর্তী আক্রে শহরটিতে বোমাবর্ষণ করেও তা দখলে নিতে বেগ পেতে হয়। ১৯৪৮ সালের মে মাসে একপর্যায়ে হাগানা বাহিনী ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহরের পানির মূল উত্স কাবরি ঝরনাধারায় টাইফয়েডের জীবাণু মিশিয়ে দেয়। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই আক্রেবাসী রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। দ্বিমুখী আক্রমণে দুর্বল ও ভীত হয়ে তারা ইহুদি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। শহরটির পতনের পর ইহুদি বাহিনী অবাধে লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পেপে আরও বলেন, ‘(একই বছর) ২৭ মে গাজায় পানির উেস বিষ মেশানোর এ রকম আরেকটি অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। মিসরীয়রা ডেভিড হরিন ও ডেভিড মিজরাচি নামের দুই ইহুদিকে আটক করে। এরা গাজার কূপগুলোতে টাইফয়েড ও ডিসেন্ট্রির জীবাণু মেশানোর চেষ্টা করছিল। জেনারেল ইয়াদিন ঘটনাটি তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেনগুরিয়নকে অবহিত করেন, যা তিনি তাঁর ডায়েরিতে টুকে রেখেছিলেন কোনো বাড়তি মন্তব্য ছাড়াই। পরবর্তী সময়ে মিসরীয়রা ওই দুজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিবাদ করেনি।’ (পৃ-১০১)।

জাতিগত নিধনপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনি নারীদের ধর্ষণ ও লাঞ্ছনার বিষয়টিতেও আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন পেপে। তবে তিনি বলছেন যে এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক রেডক্রসের কাছে কিছু তথ্য থাকলেও তা তারা সমন্বিতভাবে প্রকাশ করেনি। ইসরায়েলি আর্কাইভেও কিছু তথ্য মেলে ধর্ষকদের শাস্তি হওয়ার। বেন গুরিয়নের দিনলিপিতেও ইহুদি সেনাদের ধর্ষণকীর্তির উল্লেখ আছে। এগুলোর বাইরে ধর্ষক ও ধর্ষিতার বয়ান থেকে কতিপয় ধর্ষণের ঘটনা জানতে পাওয়া যায়, যদিও পেপের মতে, ‘প্রথম ক্ষেত্রে তথ্য পাওয়া খুব কঠিন, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তাদের কাহিনিগুলো ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের সবচেয়ে মর্মভেদী ও অমানবিক কিছু অপরাধের ওপর আলোকপাতে সহায়তা করে।’ (পৃ-২১০)।

তিনি আরও বলেছেন, প্রথাগত লজ্জা ও ক্ষত ফিলিস্তিনি নারীদের ধর্ষণবিষয়ক তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাধা হিসেবে রয়ে গেছে। তবে তিনি আশাবাদী যে ১৯৪৮-৪৯ সময়কালে ইহুদি সেনারা হত্যা-লুণ্ঠনের পাশাপাশি যে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন করেছে, তা একদিন অবশ্যই কেউ না কেউ বিস্তারিত প্রকাশ করবে।

চার

‘নাকবা অস্বীকার ও শান্তিপ্রক্রিয়া’ শিরোনামে বইটির একাদশ অধ্যায়ে পেপে বলছেন যে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য দশকের পর দশক ধরে যে প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে, তা আসলে একধরনের ধোঁকাবাজি এবং ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্নকরণ অব্যাহত রাখতে ইসরায়েলি কূটকৌশল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর নিজেদের শক্তিমত্তা ও ক্ষমতা প্রবলতর হয়ে ওঠায় জাইয়নবাদী রাষ্ট্রটি কথিত এই শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়ায় তিনটি দিকনির্দেশনা বা স্বতঃসিদ্ধ নির্ধারণ করে। প্রথমত, ‘ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মূল রয়েছে ১৯৬৭ সালে, যা সমাধানে দরকার একটি চুক্তি, যা পশ্চিম তীর ও গাজার ভবিষ্যত্ নির্ধারণ করবে। অন্য কথায়, যেহেতু এই এলাকাগুলো ফিলিস্তিনের মাত্র ২২ শতাংশ, সেহেতু ইসরায়েল এক ধাক্কায় শান্তিপ্রক্রিয়াকে মূল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ক্ষুদ্র একটি অংশে সীমিত করে ফেলে।...ইসরায়েলের দ্বিতীয় স্বতঃসিদ্ধটি হলো, পশ্চিম তীর ও গাজায় দৃশ্যমান সবকিছুই ভাগ করা হবে। আর এই বিভক্তিকরণ শান্তির অন্যতম স্তম্ভ। ইসরায়েলের জন্য দৃশ্যমান সবকিছুর ভাগ শুধু ভূখণ্ড নয়, বরং মানুষ ও প্রাকৃতিক সম্পদসমূহও এই ভাগের অন্তর্ভুক্ত। ইসরায়েলের তৃতীয় স্বতঃসিদ্ধ হলো, ১৯৬৭ সালের আগে নাকবা, জাতিগত নিধনসহ যা কিছু ঘটেছে, সেগুলো কখনোই আলাপ-আলোচনায় আসবে না। এর তাত্পর্য খুব পরিষ্কার: এটা শান্তি আলোচনা থেকে শরণার্থীদের বিষয়টি পুরোপুরি সরিয়ে ফেলে ও ফিলিস্তিনিদের ফিরে আসার অধিকারকে নাকচ করে দেয়। ইসরায়েলি দখলদারির সমাপ্তিকে সংঘাতের সমাপ্তির সঙ্গে সমর্থক করে তোলা হয় এই স্বতঃসিদ্ধটির মাধ্যমে, যা কিনা আগের দুটি স্বতঃসিদ্ধ থেকে উত্সরিত। ফিলিস্তিনিদের জন্য অবশ্যই ১৯৪৮ সাল হলো সবকিছুর প্রাণ এবং কেবল অতীতের অন্যায়গুলোকে সংশোধন করা হলেই এই অঞ্চলে সংঘাতের অবসান হতে পারে।’ (পৃ-২৩৯)।

ইসরায়েলের শিক্ষা ও জ্ঞানজগতের বেশির ভাগ মানুষ ফিলিস্তিনের জাতিগত নিধনকে বৈধতা দেয়, ফিলিস্তিনিদের দুর্দশাকে উপেক্ষা করে ও তাদের ভবিষ্যত্ সম্পর্কে উদাসীন থাকে। বিষয়টি ইলান পেপেকে পীড়িত করেছে, যা বইয়ের সমাপনী (এপিলগ) অধ্যায়ে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘ইসরায়েলের অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ও জ্ঞানায়তনিক (একাডেমিক) গবেষণার স্বাধীনতা সমুন্নত রাখায় নিবেদিত। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি ক্লাবকে বলা হয়, সবুজ বাড়ি (গ্রিনহাউস)। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল শায়েখ মুয়ান্নিস গ্রামের মুখতারের বাড়ি। কিন্তু আপনি যদি সেখানে নৈশভোজে কিংবা দেশের এমনকি তেল আবিব শহরের ইতিহাসবিষয়ক কোনো কর্মশালায় আমন্ত্রিত হন, তাহলে কখনোই এ কথাটি বলতে পারবেন না। ক্লাবের রেস্তোরাঁর মেন্যু কার্ডে জায়গার পরিচিতি হিসেবে বলা হয়েছে, এটি উনিশ শতকে গড়ে ওঠা, যা ছিল শায়েখ মুনিস নামের এক ধনাঢ্য লোকের। এই লোক আসলে কল্পিত, স্থানহীন অবস্থানে বাস্তবে অস্তিত্বহীন একটি বানোয়াট মানুষ, যেমনটা আরও অনেক অস্তিত্বহীন মানুষের কথা জানা যায়, যারা কিনা শায়েখ মুয়ান্নিস গ্রামে বসবাস করত আর যে জায়গাটিতে তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হয়েছে। অন্য কথায়, এই গ্রিনহাউস হলো ফিলিস্তিনের জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের জায়নবাদী মহাপরিকল্পনা অস্বীকারের একটি প্রতীক। আর এই মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে অল্প দূরে সৈকতের নিকটবর্তী ইয়ারকান স্ট্রিটে অবস্থিত লাল বাড়ির (রেড হোম) তৃতীয় তলায়।’ (পৃ-২৫৭)। উল্লেখ্য, তাঁর বইটির প্রারম্ভিকা অধ্যায় শুরু হয়েছে ‘লাল বাড়ি’-এর উপাখ্যান দিয়ে। পেপে বলেছেন, ১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ ১১ জন জাইয়নবাদী নেতা ও তরুণ ইহুদি সেনা এই লাল বাড়িতে বসেই ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছিল, যার সাংকেতিক নাম প্ল্যান দালেত।

ইলান পেপে দুঃখ করে বলেছেন, ‘যদি তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয় যথাযথ শিক্ষায়তনিক (একাডেমিক) গবেষণায় লিপ্ত থাকত, তাহলে উদাহরণ হিসেবে আপনি ভাবতে পারতেন যে এর অর্থনীতিবিদেরা ১৯৪৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত কী পরিমাণ ফিলিস্তিনি সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে,৭ তার হিসাব নির্ধারণ করেছেন এবং একটি বিস্তারিত পরিসংখ্যাপত্র বা তালিকা তৈরি করেছেন, যা কিনা বিরোধ মিটমাট ও শান্তি স্থাপনের জন্য সমঝোতার কাজে সহায়ক হবে। ফিলিস্তিনিদের বেসরকারি মালিকানায় থাকা ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক, ওষুধের দোকান, হোটেল ও বাস কোম্পানি, তাঁদের পরিচালিত কফি হাউস, রেস্তোরাঁ, কারখানা এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের আনুষ্ঠানিক দায়িত্বে তাদের অবস্থান- জাইয়নবাদীরা ফিলিস্তিন দখল করার পর এ সবই তো বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে, ধ্বংস করা হয়েছে অথবা “ইহুদি মালিকানায়” হস্তান্তর করা হয়েছে।...ক্যাম্পাসের দর্শনের অধ্যাপকেরা ইতিমধ্যে নাকবার সময় ইহুদি বাহিনীর গণহত্যার যে অপরাধ সাধন করেছিল, তার নৈতিক নিহিতার্থগুলো নিয়ে কাজ করতেন। ইসরায়েলি সেনা আর্কাইভ ও কথ্য ইতিহাস মিলিয়ে ফিলিস্তিনি উত্সগুলো ৩১টি নিশ্চিত গণহত্যার তালিকা করেছে, যা ১৯৪৭ সালের ১১ ডিসেম্বর তিরাত হাইফায় শুরু হয়ে ১৯৪৯ সালের ১৯ জানুয়ারি হেবরনের খিরবাত ইলিনে শেষ হয়েছে। এর বাইরে আরও অন্তত ছয়টি গণহত্যার ঘটনা রয়েছে। অথচ এখনো আমরা একটি সুবিন্যস্ত নাকবা স্মৃতি অভিলেখাগার পাইনি, যা কিনা গণহত্যায় নিহত ব্যক্তিদের নামগুলো জানতে যে কাউকে সহায়তা করবে।...তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ইতিহাসবিদেরা আমাদের যুদ্ধ ও জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের পূর্ণাঙ্গ চিত্র দিতে পারতেন। কেননা, প্রয়োজনীয় সব সরকারি ও সামরিক দলিল ও অভিলেখাগারের সামগ্রী দেখায় তাঁদের অগ্রাধিকার রয়েছে। তবে, তাঁদের বেশির ভাগই আসলে সমজাতীয় আদর্শের মুখপাত্র হিসেবে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাঁদের যাবতীয় কাজে ১৯৪৮ সালের ঘটনাপ্রবাহকে “স্বাধীনতার যুদ্ধ” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, এতে অংশগ্রহণকারী ইহুদি সেনা ও কর্মকর্তাদের গৌরবগাথা তুলে ধরা হয়েছে আর তাদের অপরাধকে লুকানো হয়েছে আর ভুক্তভোগীদের ওপর কলঙ্কলেপন করা হয়েছে।’ (পৃ-২৫৭-২৫৮)।

পেপে বিশ্বাস করেন, ১৯৪৮ সালে তাদের সেনাবাহিনী যে হত্যা-লুণ্ঠন চালিয়েছে, সে বিষয়ে ইসরায়েলের সব ইহুদি অন্ধ নয়। বিতাড়িত, আহত, নির্যাতিত ও ধর্ষিতদের আহাজারির প্রতি তারা বধির নয়। বরং ফিলিস্তিনিদের নিধনযজ্ঞের বিষয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি ইহুদি এখন ওয়াকিবহাল এবং তার চেয়েও বড় কথা, এই অপরাধের জন্য লজ্জিত, মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। হতে পারে তাদের মোট সংখ্যা এখনো অনেক কম, তারপরও তারা আছে এবং বিশ্বাস করে যে শরণার্থী সমস্যাই চলমান সংঘাতের মূলে রয়েছে। এই ইহুদিরাই ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে মিলে শান্তিতে বসবাস করতে আগ্রহী। পেপের ভাষায়, ‘এদেরকেই পাওয়া যায় প্রায় পাঁচ লাখ “অভ্যন্তরীণ” ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রামগুলোয় যৌথ তীর্থযাত্রায় এরাই যোগদান করে, প্রতিবছর (হিব্রু দিনপঞ্জি অনুসারে) ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক “স্বাধীনতা দিবসে”-এর পাশাপাশি নাকবা স্মরণ অনুষ্ঠানে এরা উপস্থিত থাকে।’ বস্তুত ইলান পেপে যাদের কথা বলছেন, এ রকম অনেক শান্তিবাদী ইসরায়েলিকে আমরা কয়েক দশক ধরে সক্রিয় দেখতে পাই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইসরায়েলের অপরাধ-অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে। আর তা করতে গিয়ে তাঁরাও স্বজাতির ও স্বদেশের মানুষের কাছে নানাভাবে অপদস্থ হয়েছেন।

পাঁচ

ইলান পেপের তথ্যবহুল ও বিশ্লেষণধর্মী বইটি সংক্ষেপে দেখলে যে মূল বিষয়গুলো পাওয়া যায়, তা এ রকম: (১) জাইয়নবাদীরা বাইবেলের মিথের ওপর ইহুদিদের জন্য প্রতিশ্রুত ও স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি তৈরি করেছে; (২) এই প্রতিশ্রুত ও স্বতন্ত্র আবাসভূমি একটি কল্পিত ধারণা, যা প্রতিষ্ঠার জন্য অর্ধসত্য, মিথ্যা ও কল্পনানির্ভর নিরন্তর প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে ও এখনো হচ্ছে; (৩) এই আবাসভূমি বা ইসরায়েলের ভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য বলপূর্বক অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিনি আরবদের তাদের আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে; (৪) এই উচ্ছেদপ্রক্রিয়া একটি দীর্ঘ পরিকল্পনার মাধ্যমে করা হয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতিগতভাবে ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া; (৫) ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্নকরণের কাজটিকে জোরালোভাবে অস্বীকার করা হয়েছে; (৬) অস্বীকারকে প্রতিষ্ঠা করতে সমষ্টিগত স্মৃতি থেকে ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্নকরণের কর্মকাণ্ড মুছে ফেলার নিরন্তর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে; (৭) ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্নকরণ আজও অব্যাহত আছে। বইটিতে উল্লিখিত প্রতিটি বিষয় তথ্য-উপাত্ত সহযোগে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দিন-তারিখ ধরে বিভিন্ন হত্যা ও লুণ্ঠনের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।

তাহলে এই অবস্থা থেকে আদৌ কোনো উত্তরণ হবে কি? পেপে এর কোনো ইতিবাচক জবাব দিতে পারেননি এ জন্য যে তিনি জাইয়নবাদের স্বরূপ সম্যকভাবে বুঝেছেন। তিনি মনে করেন, ‘না ফিলিস্তিনি, না ইহুদি, কেউই একে অন্যের থেকে বা নিজেরা নিজেদের থেকে রক্ষা পাবে, যদি ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের নীতিকে যে আদর্শবাদ ধাবিত করছে, তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা না হয়। ইসরায়েল রাষ্ট্রের সমস্যা এর ইহুদিত্ব নয়। ইহুদিবাদের নানা রূপ আছে, যার অনেকগুলোই শান্তি ও সহাবস্থানের নিখাদ ভিত্তি তৈরি করে দেয়। সমস্যা হলো এর জাতিগত জাইয়নবাদী চরিত্র। ইহুদিবাদ যতখানি বহুত্ববাদী (প্লুরালিজম) অবস্থানের সুযোগ দেয়, জাইয়নবাদ তা দেয় না, ফিলিস্তিনিদের জন্য তো নয়ই। তারা কখনোই এই জাইয়নবাদী রাষ্ট্রের অংশ হতে পারবে না, এখানে স্থান পাবে না। ফলে তাদের লড়াই চলবে আর এটা আশা করা যায় যে তা শান্তিপূর্ণ ও সফল হবে। যদি তা না হয়, তাহলে তা হবে বেপরোয়া ও প্রতিশোধপরায়ণ, অন্তহীন বালুরাশি টেনে একটি ঘূর্ণিবায়ুর মতো, যা শুধু আরব ও মুসলিম বিশ্বেই নয়; বরং ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেও উন্মত্ততার মতো ছড়িয়ে পড়বে। আর এই দুুই শক্তিই তো যে ঝড় ধেয়ে আসছে আমাদের ধ্বংস করার জন্য, সেই ঝড়কে উসকে দিয়েছে। ২০০৬ সালের গ্রীষ্মে গাজা ও লেবাননে ইসরায়েলের আক্রমণ এটাই ইঙ্গিত করে, এই ঝড় ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো সংগঠন, যারা ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের একতরফা চাপিয়ে দেওয়ার অধিকারকে সাহসের সঙ্গে প্রশ্ন তুলে ইসরায়েলি সামরিক পরাক্রমের শিকার হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত (বই ছাপাখানায় যাওয়ার প্রাক্কালে) টিকে রয়েছে। কিন্তু এর শেষ অনেক দেরি। এই প্রতিরোধ আন্দোলনের আঞ্চলিক দুই পৃষ্ঠপোষক, সিরিয়া ও ইরান, ভবিষ্যতে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে, যা আরও বড় ধরনের সংঘাত ও রক্তপাতের ঝুঁকি তৈরি করেছে, যা আগে কখনো এতটা প্রবল ছিল না।’ (পৃ-২৬১)।

তথ্যসূত্র

১.         Ethnic Cleansing-এর বাংলা হিসেবে এখানে ‘জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ’ ও ‘জাতিগত নিধন’ শব্দযুগল ব্যবহার করা হয়েছে। বিষয়টি বোঝাতে এটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়। তাই আগে আরেক আলোচনায় ব্যবহূত ‘নৃতাত্ত্বিক শুদ্ধি অভিযান’ এখানে পরিহার করা হয়েছে।

২.         Media, ISM (২০১০)

৩.        p-92, Chomsky, Noam (২০০৪)

৪.         p-95, Chomsky, Noam (২০০৪)

৫.         ম্যানডেট শেষ হওয়ার অল্প কদিন আগে গোল্ডা মেয়ার (ইসরায়েলের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্বের তৃতীয়) ছদ্মবেশে জর্ডানে গিয়ে বাদশার সঙ্গে দেখা করেন। যদিও আবদুল্লাহ তখন আরববিশ্বের অন্যদের চাপে আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছিলেন। তাতে অবশ্য পরিস্থিতি তেমন পাল্টায়নি।

৬.        Biological warfare

৭.         ফিলিস্তিনের অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়ে আঙ্কটাডের হালনাগাদ প্রতিবেদনের কিছু তথ্য পরিশিষ্টে তুলে ধরা হয়েছে। (http://unctad.org/en/pages/newsdetails. aspx?OriginalVersionID=1317)

তথ্যপঞ্জি ও টীকা

১.         Media, ISM. (2016). ‘Interview with Ilan Pappé:.’ International Solidarity Movement. N.p., 09 July 2013. Web. 23 Nov. 2016. <https://palsolidarity.org/2013/07/interview-with-ilan-pappe-the-zionist-goal-from-the-very-beginning-was-to-have-as-much-as-palestine-as-possible-with-as-few-palestinians-in-it-as-possible/>.

২.         Lendman, Stephen. (2016) ‘The Ethnic Cleansing of Palestine by Ilan Pappe.’ Global Research, 7 Feb. 2007. Web. 30 Oct. 2016. <http://www.globalresearch.ca/the-ethnic-cleansing-of-palestine-by-ilan-pappe/4715>.

৩.        Chomsky, Noam (2005) Fateful Triangle: The United States, Israel and the Palestinians. New Delhi, 2005.

পরিশিষ্ট-১

ইসরায়েলি দখলদারত্বে থাকা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের (পশ্চিম তীর ও গাজা) অর্থনীতি নিয়ে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড) এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইসরায়েলি দখলদারত্ব বজায় না থাকলে ফিলিস্তিনের অর্থনীতি অন্তত দ্বিগুণ হতো, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য হারে কমত। একাধিক সমীক্ষা বিশ্লেষণ করে আঙ্কটাড বলছে, ফিলিস্তিনিদের জমিজমা, পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদ বাজেয়াপ্ত, মানুষ ও পণ্যের চলাচল সীমিত এবং সম্পত্তি ও উত্পাদনশীলতা ধ্বংস করে দেওয়ার পাশাপাশি ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণ, অভ্যন্তরীণ বাজার বিভক্ত করে দেওয়া, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা ও ইসরায়েলি অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের দখলদারত্ব ফিলিস্তিনি জনগণকে মানবাধিকার ও উন্নয়নের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে, ফিলিস্তিনের অর্থনীতিকে ফাঁপা করে দিচ্ছে। আঙ্কটাডের হিসাব বলছে, ১৯৭৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ৪০ বছরে ফিলিস্তিনের জিডিপিতে বাণিজ্যযোগ্য কৃষি ও শিল্পপণ্যের হিস্যা অর্ধেকে নেমেছে—৩৭ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ১৮ শতাংশে। আর কর্মসংস্থানে এর অবদান ৪৭ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ২৩ শতাংশে।

ইসরায়েলি শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর বিভাগ মোট যে পরিমাণ আমদানি পণ্য শুল্কায়ন ও ছাড় করে, তার মাত্র ৬ শতাংশ ফিলিস্তিনের আমদানি। অথচ এই আমদানির বিপরীতে চড়া হারে মাশুল আদায় করে ইসরায়েল, যা দিয়ে জাইয়নবাদী রাষ্ট্রটির শুল্ক বিভাগের বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নির্বাহ করা হয়। আঙ্কটাড বলছে, যদি ফিলিস্তিনের আমদানির আনুপাতিক হারে মাশুল আদায় করা হতো, তাহলে ফিলিস্তিন জাতীয় কর্তৃপক্ষ বছরে অন্তত পাঁচ কোটি ডলার বাড়তি ব্যয় থেকে রেহাই পেত আর তাদের রাজস্ব ঘাটতি কমত অন্তত সাড়ে ৩ শতাংশ।

ইসরায়েলি দখলদারত্বে থাকা পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশ ও আবাদযোগ্য ৬৬ শতাংশ ভূমিতে (যা এলাকা-সি হিসেবে পরিচিত) ফিলিস্তিনিদের প্রবেশাধিকার নেই। ফলে ২০১৫ সালে ফিলিস্তিনি জিডিপির (৪৪০ কোটি ডলার) অন্তত ৩৫ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। গাজায় উত্পাদকেরা চাষযোগ্য অর্ধেক জমিতে ও ৮৫ শতাংশ মত্স্য সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। আর ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে তিনটি ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে যে ক্ষতি হয়েছে, তা গাজার জিডিপির কমপক্ষে তিনগুণ।

ফিলিস্তিনিদের জীবিকার অন্যতম প্রধান উত্স জলপাই। ১৯৬৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৮ লাখ জলপাইগাছসহ ২৫ লাখের বেশি ফলদ গাছ বিনষ্ট করা হয়েছে। শুধু ২০১৫ সালেই কেটে ফেলা ও উত্পাটন করা হয়েছে ৫ হাজার ৬০০ ফলদ গাছ। ফিলিস্তিনিদের পানির উত্স পুরোপুরি ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে। তারা নিজেরা কুয়া খনন করতে পারে না। ইসরায়েলি কোম্পানির কাছ থেকে চাহিদার অন্তত ৫০ শতাংশ পানি চড়া দামে কিনতে হয়। ইসরায়েল ফিলিস্তিনের অন্তত ৮২ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানি অসলো চুক্তিতে নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি মাত্রায় টেনে নিচ্ছে শক্তিশালী মোটর ব্যবহার করে।

আঙ্কটাড প্রতিবেদন দেখায়, দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বেকারত্ব ২৫ শতাংশ আর সেখানকার ৬৬ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। গাজার চিত্র অবশ্য আরও করুণ, যেখানে বেকারত্ব ৩৮ শতাংশ আর ৭৩ শতাংশ অধিবাসীর মানবিক সাহায্য প্রয়োজন। তথ্যসূত্র: http://unctad.org/en/pages/newsdetails.aspx?OriginalVersionID=1317