সারসংক্ষেপ
৪৬ বছর পার হওয়ার পরও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস জড় বস্তু হিসেবেই রয়ে গেছে। ইতিহাসের বয়ানগুলো এখনো বহুমাত্রিক আলোচনা গ্রহণ করতে নারাজ। যেই জটিল এবং স্ববিরোধী সমীকরণের সমষ্টি থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছিল, ঐতিহাসিকেরা আজও সেই জটগুলো খোলার চেষ্টা করেনি। একই সঙ্গে, জাতিগত বিদ্বেষ এবং উন্মত্ততার যেই মিশেল পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহিংসতার পথে নিয়ে গিয়েছিল, তারও ব্যাপক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এই গবেষণা বাংলাদেশকে স্বাধীনতা-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের অর্থপূর্ণ বিশ্লেষণে সাহায্য করবে এবং পাকিস্তানকে তার বর্তমান সামগ্রিক সংকটের মূল খুঁজতে সহায়তা করবে। যুদ্ধ নিয়ে লেখা বেশ কয়েকটি নতুন বইয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে শর্মিলা বসুর ডেড রেকনিং (অন্ধকারে নিশানা)। এই বই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ মোচনের একটি অসংলগ্ন প্রচেষ্টা। এত দিন পরও আমরা অপেক্ষা করছি একাত্তরের সহিংসতার প্রকৃতি, সংকটের দফারফা, অনিচ্ছাকৃত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং ইতিহাসের এতিমদের একটি অনুপুঙ্খ তদন্তের জন্য। যুদ্ধের সময় মানুষ সব সময়ই স্ববিরোধিতা, সাহসিকতা, ভীতি এবং স্নায়ুবৈকল্যের সমন্বয়ে কাজ করে। এটাই মানুষ হওয়ার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য—স্থিরতার অভাব। বাংলাদেশ এখনো ১৯৭১-এর সেই মানবিক ইতিহাসের জন্য অপেক্ষা করছে।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ: ১৯৭১, গবেষণা, বয়ান, কথ্য ইতিহাস, নথিপত্র
‘১৯৭৩ সালে আমি ছয় মাস পাগলাগারদে ছিলাম। আমি কেন পাগল হয়ে গেলাম? আসলে আমি সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের সামষ্টিক অপরাধবোধে ভুগছিলাম, যে গণ-অপরাধ ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যেই বন্ধ করা উচিত ছিল।’
—কর্নেল নাদির আলী, পাকিস্তানি সেনাসদস্য, আ খাকি ডিসিডেন্ট অন ১৯৭১।
ভূমিকা
বাংলাদেশ ৪৭ বছরে পদার্পণ করল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং যুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যা, বাংলাদেশের অস্তিত্ব এবং গতিপথের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে রয়েছে। কিন্তু বহির্বিশ্বে ১৯৭১ প্রায়বিস্মৃত একটি অধ্যায়। বাংলাদেশি ঐতিহাসিকদের অধিকাংশ কাজই বাংলায়, যার ফলে এই প্রান্তিকায়ন আরও বেড়ে গেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমে সচরাচর ‘তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ হিসেবেই একাত্তরকে উল্লেখ করা হয়। এই ভুল নামকরণ ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের জন্য সুবিধাজনক, কারণ তারা প্রচলিত ইতিহাসকে তাদের নিজ দাবির সপক্ষে দেখিয়ে (বিশেষ করে কাশ্মীরে) ফায়দা হাসিল করে।
স্বাধীনতার আরও একটি বর্ষপূর্তি উপলক্ষে [মূল লেখাটি ইংরেজিতে বেরিয়েছিল ২০১১ সালে] যুদ্ধের বিষয়ে বেশ কয়েকটি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে: বইয়ের লেখকেরা হচ্ছে নয়নিকা মুখার্জি১, ইয়াসমিন সাইকিয়া২, শ্রীনাথ রাঘাভান এবং সলিল ত্রিপাঠি। তবে সবার আগে প্রকাশিত হয়ে গেছে শর্মিলা বসুর ডেড রেকনিং। এই বইয়ে আছে কিছু মৌলিক গবেষণা এবং কিছু উগ্র পলেমিক। সেই পলেমিকের স্বর এত কর্কশ যে ভিন্নমতাবলম্বী বয়ান হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে।
ডেড রেকনিং লেখিকা শর্মিলা নিজেকে কাহিনির কেন্দ্রে স্থাপন করেছে এবং তার নেওয়া সাক্ষাত্কারগুলো এই বইয়ের মৌলিক উপাদান। নম্রতার ছলনায় সে সূচনায় বলেছে, ‘১৯৭১ সালের সঙ্গে আমার যে বর্ণনাতীত সম্পর্ক, তা ভবিষ্যত্ অন্য কোনো লেখকের থাকবে না’৩ (পৃ. ১৫), ‘আমার গবেষণা অদ্বিতীয় হয়ে থাকবে’ (৬) এবং ‘আমার পক্ষপাতহীনতা পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল’ (৯)। বসুর পূর্বনির্ধারিত পক্ষপাত প্রকাশ পায় ঘটনা নির্বাচন, নির্দিষ্ট বর্ণনার প্রতি বিশ্বাসপ্রবণতা এবং অন্য বিশ্বাসকে নাকচ করার মধ্য দিয়ে। বসুর ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে পক্ষপাতিত্বকে সংশোধন করা। কিন্তু তা করতে গিয়ে তার গবেষণা এতটাই বিপরীতগামী হয়েছে যে নতুন একধরনের পক্ষপাতিত্ব তৈরি হয়েছে। বইটি শেষ পর্যন্ত সংশোধনের মাধ্যমে বিশোধনের রূপ নিয়েছে।
বইয়ের সূচনায় বসু লিখেছে, ১৯৭১ নিয়ে ভারতীয় সাজানো ইতিহাস পড়ে সে বড় হয়েছে। আমরা বাংলাদেশের যে ইতিহাস জানি (ত্রুটিপূর্ণ, কিন্তু ভিন্ন প্রবণতার) তার থেকে সেই ভারতীয় ইতিহাস ভিন্ন। গবেষণাকালে বসু যখন ফাঁকফোকর খুঁজে পেয়েছে (যেগুলো বাংলাদেশি গবেষকদের একটি প্রজন্মের কাছে পরিচিত), তখন ১৯৭১-এর ওপর তার বিশ্বাস ভেঙে গেছে এবং সে পাল্টা প্রতিলিখন শুরু করেছে। ফলে ডেড রেকনিং-এ ফুটে উঠেছে গাঢ় ক্রোধ, অসংগত গবেষণা-পদ্ধতি এবং নানা অন্ধ গলি। পাঠক কিন্তু ১৯৭১-এর যথাযথ বিশ্লেষণ পেল না; যে গবেষণায় থাকবে সহিংসতার প্রকৃতি, সংকটের দফারফা, অনিচ্ছাকৃত প্রভাবসমূহ এবং ইতিহাসের এতিমরা।
সহমর্মিতার বলয়
এই বইয়ে এক পক্ষের প্রতি ক্রমবর্ধমান সহমর্মিতা এবং অন্য পক্ষের প্রতি নির্লিপ্ততা, আমার কাছে অতি পরিচিত মনে হয়েছে। ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের থমাস জে. ওয়াটসন ফাউন্ডেশনের গবেষক হিসেবে আমি যুদ্ধের ওপর একটি কথ্য ইতিহাস প্রকল্প শুরু করি। সেই সময়ে ১৯৭১৪ সালের কথ্য ইতিহাসের কাজ তুলনামূলকভাবে নতুন ছিল, কিন্তু ইতিমধ্যে কাহিনিগুলোতে পুনরাবৃত্তির ছায়া পড়া শুরু করেছিল। তখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্থাপিত না হলেও, মুক্তিযুদ্ধের ওপর কিছু ‘পরিচিত’ উত্স এবং বই ছিল। ফলে আমি এমন কিছু লোকের সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম যাদের কথা ইতিমধ্যে কয়েকবার লিপিবদ্ধ হয়েছে—স্নাতকোত্তর থিসিস, সাময়িকীর প্রবন্ধ এবং টেলিভিশনের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে।
একপর্যায়ে আমার মনে হলো যে সীমান্ত পার হওয়ার একই ধরনের গল্প বারবার শুনছি। প্রায় সব সময়ই কোনো হূদয়বান গ্রামের লোক (দাড়িওয়ালা) তাদের সাহায্য করেছিল। সে হয়তো বলেছিল, ‘আপা, আপনারা যান, আমি থাকি। আরও লোক পার হবে।’ এই আত্মোত্সর্গকারী মহত্ গ্রামবাসীর সঙ্গে কি সবারই দেখা হয়েছিল? নাকি একটি সামষ্টিক কিংবদন্তি ব্যক্তিগত স্মৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল? বিভিন্ন মানুষের অভিজ্ঞতার অদ্ভুত মিল দেখে আমার অমিতাভ কুমারের গুজরাট দাঙ্গা সাক্ষাত্কারের কথা মনে পড়ে যায়: ‘সে যেভাবে একনাগাড়ে বর্ণনা করে চলেছে তা দেখে আমার মনে হলো, দয়ার নামে এবং সংবাদের প্রয়োজনে, এই ছোট্ট ছেলেটিকে একটি রোবট বা মর্মবেদনা-যন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে।’৫
যুদ্ধসাক্ষীদের উত্সাহ নিষ্প্রভ করার পেছনে কিছু বিষয় কাজ করছিল। পাকিস্তানি রাজাকার বাহিনীর অভিযুক্ত প্রধান গোলাম আযম ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করে (এর আগে সে মেয়াদ উত্তীর্ণ ভিসাসহ পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে বসবাস করছিল)।৬ রায় ঘোষণার দিন ঢাকায় তুমুল দাঙ্গা হয়েছিল। সাক্ষাত্কার নিতে যাওয়ার সময় আমি রাস্তায় পোড়ানো গাড়ি এবং ওল্টানো রিকশা দেখছিলাম। আমি যাদের সাক্ষাত্কার নিচ্ছিলাম, তারা অনেকেই এবার বিষণ্ন হয়ে পড়েছিল। ২০টি হতাশ বছরের কারণে ‘আমরা কি আসলেই স্বাধীন?’ বলে যে অনুভূতি কাজ করছিল, গোলাম আযমের নাগরিকত্বের রায়ের পরে এই বিষণ্নতা আরও ঘনীভূত হয়ে যায়। পরবর্তী বছরগুলোতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রকল্প৭ যখন মুখ থুবড়ে পড়ে, তখন হতাশার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়। সাক্ষাত্কার নিতে গিয়ে আমিও দেখতে পাই যে গৌরবান্বিত গল্পের বদলে সবাই বলতে চাইছে ক্লান্তিকর একটি গল্প—১৯৭১-পরবর্তী বছরগুলো কীভাবে তাদের পরাভূত করেছে।
গবেষণার দ্বিতীয় পর্যায়ে আমি পাকিস্তানে যাই। সেখানে গবেষণার বিষয় ছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করা উর্দুভাষীরা (বাংলায় যাদের সাধারণত ভুলভাবে “বিহারি” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়)৮। বাংলাদেশ থেকে একজন গবেষকের আগমন ১৯৯৪ সালে মোটামুটি অভিনব ব্যাপার ছিল, তাই তারা উত্ফুল্ল এবং আগ্রহী ছিল। আমি থাকছিলাম করাচির ওরাংগি টাউনে। হঠাত্ করে সেই এলাকা সরকার এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী মোহাজির কওমি মুভমেন্টের (এমকিউএম) মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। ব্যাপক গোলাগুলির পর কারফিউ ঘোষণা করা হয় এবং আমি কাজ বাদ দিয়ে ঘরবন্দী হয়ে যাই। কিন্তু এই ছেদ একটা অভাবনীয় সুফল নিয়ে আসে—১৯৭১ নিয়ে কথা বলার ব্যাপারে আরও বেশি আগ্রহ দেখা দেয়। একজন মোহাজির বিচ্ছিন্নতাবাদী সাক্ষাত্কারের সময় বলে, ‘দেখো, ভুট্টো পরিবার ১৯৭১ সালে এই একই কাজ করেছিল। তারা আবার সেই ঘটনা ঘটাবে।’৯ অন্যরা ১৯৭১-এর ভাঙনকে অনিবার্য এবং ভবিষ্যতে বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং সিন্ধে অনুরূপ বিদ্রোহ হবে বলে আশা প্রকাশ করে।১০
বাংলাদেশে অনেক সাক্ষাত্কারদাতাকে অবসাদগ্রস্ত এবং বিষণ্ন বলে মনে হয়েছিল। পক্ষান্তরে পাকিস্তানে যাদের সঙ্গে দেখা হলো, তারা অবশেষে কথা বলার একটা জায়গা পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। একজন বিহারি মর্মস্পর্শী ভাষায় বলেছিল, ‘আমি পশ্চিম পাকিস্তানে আশ্রয় নিলাম, কিন্তু তখনো আমার ভাই চট্টগ্রামে ছিল। একদিন আমি জানতে পারি, তোমাদের মুক্তিবাহিনী আমার ভাইকে হত্যা করেছে। জানো, সংবাদটি শোনার পর আমি কাঁদিনি; কিন্তু ঢাকার পতনের খবর পাওয়ার পর আমি অবশেষে কেঁদেছিলাম।’১১ স্থানীয় বিহারিদের ওপর বাঙালিদের সহিংসতার গল্প শুনে আমার গবেষণার পথে একটা বড় দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কারণ, তখন পর্যন্ত আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম যে বাঙালিরা শুধু পাকিস্তানি সৈন্যদেরই হত্যা করেছিল।
বসুর বই পড়ে মনে হলো যে সেও পাকিস্তানে উষ্ণ আতিথেয়তা পেয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৪ সালে আতিথেয়তা পাওয়ার পরও আমি বসুর পদ্ধতিগত ফলাফলের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করি। বাঙালিরা যদি নির্দোষ বিহারিদের হত্যা করে থাকে, তবে আমি তা সমর্থন করি না। কিন্তু ইতিহাস লেখার সময় ভূমিকা, মাত্রা এবং ক্ষমতার বিষয়গুলো বিশ্লেষণে আনতে হয়। বিশৃঙ্খল, স্বপ্রণোদিত জনতার সহিংসতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রত্যক্ষ মদদে সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর সংগঠিত সহিংসতার মধ্যে একটি পার্থক্য করা প্রয়োজন। ইতিহাসবিদ আফসান চৌধুরী প্রতিশোধের রাজনীতি এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন: ‘বাঙালিরা অবশ্যই নৃশংসতা এবং বিহারি নারীদের ধর্ষণে অংশগ্রহণ করেছিল। এটা যত দিন আমরা স্বীকার করব না, তত দিন আমাদের নিজেদের অবস্থানে দাঁড়াবার নৈতিক শক্তি থাকবে না। এসব ঘটনায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভূমিকাও আমি ব্যাখ্যা করেছি এবং বিহারিদের জন্য এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানিরা কীভাবে ভাবতে পারল যে তারা ঢাকায় বাঙালিদের আক্রমণ করবে, আর ওদিকে সারা বাংলাদেশে অরক্ষিত এবং অনিরাপদ অবস্থায় বসবাসরত বিহারিদের গায়ে কেউ হাত তুলবে না? আমি বিশ্বাস করি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিহারিদের কথা ভাবেইনি এবং পরোক্ষভাবে তারা বিহারিদের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেছিল। ডিসেম্বরে পরাজয়ের পরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিহারিদের ফেলে রেখে ভারতীয় সেনা পাহারায় পালিয়ে যায়। যার ফলে বাঙালিদের প্রতিহিংসা পুরোপুরি গিয়ে পড়ে বিহারিদের ওপর, যারা অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্নের শেষ বলি।’১২
কথ্য ইতিহাসের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হলো, উভয় পক্ষই জোরালো দাবি তোলে। কিন্তু বাছাই করা কিছু গল্প থেকে সরাসরি সামষ্টিক ইতিহাসে যাওয়া যায় না; তার সঙ্গে যুক্ত করতে হয় বৃহত্ প্রবণতার বিশ্লেষণ। অর্থাত্ কথ্য ইতিহাস লেখার সময় বিস্তারিত গবেষণা এবং কিংবদন্তিগুলোর সাংকেতিক অর্থ আলোচনা করাও প্রয়োজন। বসু তার নেওয়া সাক্ষাত্কার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেশ কিছু ভুল করেছে। প্রথমত, পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়মমাফিক যুদ্ধ করেছে, এই দাবি সে সাবধানে পরখ করেনি। দ্বিতীয়ত, দখলদারির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেভাবে মদদদাতা হিসেবে কিছুসংখ্যক বিহারি এবং বাঙালিকে ব্যবহার করেছিল (তথ্য সরবরাহকারী, কৌশলগত অবস্থান এবং ডেথ স্কোয়াডের সদস্য), সে ব্যাপারেও সে বিশেষ কোনো আলোচনা করেনি। তৃতীয়ত, আকাঙ্ক্ষিত শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সে দুই পাকিস্তানের (পূর্ব ও পশ্চিম) মধ্যে বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগ্রামের বিষয়টা অনেকাংশে পাশ কাটিয়ে গেছে।
সেন্টিমেন্টের ঘোর
পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের একটা মহিমান্বিত দর্শন ধারণ করে রেখেছে। কিন্তু এপার বাংলায় আমরা শুধু ১৯৭১ সালের সুউচ্চতা নয়, পরবর্তী দুই দশকের ভয়াবহ বিফলতা ও হানাহানি দেখেছি। ১৯৭৩ সালে গোপন বিপ্লবী বাম এবং সরকারের মধ্যে তুমুল গৃহযুদ্ধ, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ, ১৯৭৫ সালের নৃশংস বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং আরও দুটি পাল্টা-অভ্যুত্থান, ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ভেতরে তুমুল অস্থিরতা, ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যাকাণ্ড—সবকিছু মিলিয়ে একটি কঠিন ও রূঢ় বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী অভিজ্ঞতা এবং সংকট শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের পরিচ্ছন্ন ইতিহাসকে তীব্র সংকটে ফেলে দিয়েছে। লরেন্স লিফশুলজের ভাষায় বাংলাদেশ ছিল একটি ‘অসমাপ্ত বিপ্লব’।
ওদিকে একাত্তর নিয়ে পশ্চিম বাংলার আবেগী ধোঁয়া যুদ্ধের সময়ই শুরু হয়। কলকাতার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘বাংলাদেশি’ গানগুলোর কথা ভাবা যাক। এই গানগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা ছিল পশ্চিম বঙ্গীয় বাঙালির লেখা। যার ফলে এই গানগুলোতে সীমান্তের অন্য পারের এককালীন ভাই-বোনদের জন্য ভালোবাসা ও ক্ষমার আবহ ফুটে ওঠে। জনপ্রিয় গান ‘শোন একটি মুজিবরের’১৩-এ একটি লাইনে বলা হচ্ছে ‘হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব’। অথবা ‘আমরা সবাই বাঙালি’১৪ গানটি, যেখানে অসম্ভব আশা নিয়ে দেশভাগের বিয়োগান্ত ঘটনাকে মুছে দিয়ে একটা ধর্মনিরপেক্ষ সমষ্টির স্বপ্ন স্থান পেয়েছে (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলমান—সবাই বাঙালি)। অথবা ‘পদ্মা নদীর পাড়ে আমার ছোট্ট সবুজ গ্রাম’১৫ গানে ১৯৪৭-পূর্ব মনোরম গ্রামজীবনের স্মৃতি রোমন্থন। শেষ পর্যন্ত সেই ধর্মনিরপেক্ষ যুক্ত বঙ্গের স্বপ্ন একাত্তরের পরে মুখ থুবড়ে পড়ে, কিন্তু গান লেখার সময় পশ্চিমবঙ্গের কেউই সেটা কল্পনা করতে পারেনি।
পশ্চিম বাংলার একটি প্রজন্মের জন্য ১৯৭১ একধরনের বৃহত্তর বাংলা গঠনের অপূর্ণ সম্ভাবনা হিসেবে রয়ে গেছে (রাজনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে না হলেও, ন্যূনপক্ষে দার্শনিকভাবে)। যুদ্ধ ছিল সমরূপতা প্রকাশের সময়, যখন বাঙালি মুসলমানরাও নিজেদের এই একই সংস্কৃতি দ্বারা পরিব্যাপ্ত বলে ঘোষণা করে এবং সংস্কৃতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। ১৯৭১ সাল একটি ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছে, যেখানে পশ্চিম বাংলা অবশেষে দেশভাগের ক্ষত উপশম হবে বলে কল্পনা করেছিল।
সত্তর ও আশির দশকে যখন পশ্চিম বাংলা অর্থনৈতিকভাবে নিষ্প্রভ হয়ে যায়, তখন মানুষ সস্নেহে ১৯৭১-এর কথা স্মরণ করত এমন সময় হিসেবে, যখন তারা বিশ্ব ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিল। এই সময়ে মার্কিন সিনেটর এবং প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী এডওয়ার্ড কেনেডি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করতে দমদম বিমানবন্দরে নেমেছিল। ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থীদের বিপর্যয়কর চাপের কথা বিশ্বসভায় তুলে ধরেছিল। সব মুহূর্তেই কলকাতা ছিল ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বসুর মতো প্রতিটি পরিবারেই এই সময়ের কোনো একটা স্মৃতি ছিল। নিজেদের ঘরে মুক্তি গেরিলাদের আশ্রয় দিয়েছিল অনেকে। সেই গেরিলা যদি হয় একজন মুসলমান, যুদ্ধের এই প্রথা ভাঙার গল্প আরেকটু বেশি তাত্পর্য বহন করত: ‘জানো তো, আমাদের রান্নাঘর অবধি ঢুকতে দিতাম।’১৬ চাঁদা তোলা, কবিতা লেখা, গান গাওয়া থেকে শুরু করে সবশেষে আসে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুকে অল্প সময়ের জন্য দেখা এবং তাঁর দেওয়া প্রণাম। ২০১০ সালে যখন কিংবদন্তি রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্রের মৃত্যু হয়, কলকাতা টিভি ১৯৭১ সালের একটি চাঁদা সংগ্রহের অনুষ্ঠানে তাঁর গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে বিশেষভাবে তুলে ধরে। ভিডিওটিতে তাঁর গাল বেয়ে অশ্রু ঝরতে দেখা যায়। এই হলো ১৯৭১-এর সঙ্গে কলকাতার রোমান্টিক সম্পর্ক।
পশ্চিম বাংলার কয়েকজন সহকর্মী বিস্ময় প্রকাশ করেছে যে তাদের নিজেদেরই পটভূমির একজন কীভাবে একাত্তরের ওপর এমন জোরালো আক্রমণ করতে পারল। কিন্তু শর্মিলা বসুর বক্তব্য আসলে সেই অতি সেন্টিমেন্টের একটি যুক্তিযুক্ত পাল্টা-বিবর্তন। ১৯৭১ নিয়ে পশ্চিম বাংলায় যে আবেগময় দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তার করেছে, বসুর ভাবাদর্শ সম্ভবত এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ১৯৭১ সালে যে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরা ছিল ভাই, আজ বিজেপি নেতাদের কাছে তারা অবৈধ অভিবাসী এবং ডানপন্থী রাজনীতি উসকে দেওয়ার মোক্ষম অস্ত্র। বাম রাজনীতিবিদেরাও তাঁদের জনমুখী রাজনীতির জন্য এই একই শরণার্থীর দোহাই দেয়। এমনকি কংগ্রেস এবং তৃণমূল নেতারা বলে যে শিয়ালদহ স্টেশনে দারিদ্র্যক্লিষ্ট শরণার্থীদের দেখে তাঁরা রাজনীতিতে যোগ দেয়, যাতে করে একটা উন্নত দেশ গড়া যায়।
১৯৭১ অনেক সময় একটা শূন্য ক্যানভাস হিসেবে কাজ করে, যার ওপর প্রতিদ্বন্দ্বী দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করা যায়। সেই তরঙ্গের অংশ হিসেবেই বসুও একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। যুদ্ধ সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়, বসু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে সে প্রমাণ করবে এগুলো সব মিথ্যা। উদয়ন চট্টোপাধ্যায়ের মতে, যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা আবেগ পশ্চিম বাংলার মানুষের ওপর আরোপ করা হয়েছিল। এত বছর পার করে এবং বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত তিক্ত সম্পর্ক দেখে, অনেকেই নিজেকে প্রশ্ন করে, ‘সেই উদ্দীপনা কোথায় হারিয়ে গেল?’১৭ সাবেক প্রেমিকের এই হতাশা একটি শক্তিশালী ধারা, যা শর্মিলা বসুকে হয়তো ভুল স্বপ্নের প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দীপনা দিয়েছে।
বন্ধ দরজা এবং প্রিয়পাত্ররা
বাংলাদেশি তথ্যদাতাদের সঙ্গে বসুর বিরোধ শুরু হয় কিছু পুরোনো লেখার মাধ্যমে। তিনটি প্রবন্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: ২০০৩ সালে প্রকাশিত একটি উপসম্পাদকীয়১৮ এবং যথাক্রমে ২০০৫ ও ২০০৭ সালে প্রকাশিত দুটি প্রবন্ধ১৯। এই রচনাগুলোয় মোটা দাগে বসু বলে যে ‘সাহসী পাক সেনাবাহিনী’ (সে ঠিক এই শব্দগুলোই ব্যবহার করেছে) নিষ্কলঙ্কভাবে আচরণ করেছিল; পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর আরোপিত ধর্ষণের অভিযোগগুলো সত্য নয়২০, মুক্তিযুদ্ধের বাঙালি বয়ানটি ইচ্ছাকৃতভাবে অতিরঞ্জিত। পরবর্তী সাইবার যুদ্ধ এবং একটি অনুষ্ঠানের প্রশ্ন-উত্তর পর্বে এই গবেষণা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রতীয়মান হয়। যৌথভাবে লিখিত একটি উপসম্পাদকীয়তে পাকিস্তানের কাছে মার্কিন যুদ্ধবিমান বিক্রয়ের প্রশংসা করার কারণে বসুর নাম আরও ক্ষুণ্ন হয়।২১ ফলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর খাস লোক হিসেবে সে পরিচিতি পায় এবং ঢাকায় অনেকে তার সঙ্গে সহযোগিতা করতে অপারগতা প্রকাশ করে। সেই কথা তার বইয়ের মধ্যেও আছে: ‘স্বাধীনতাপন্থীরা কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি’ (১২)।
সম্ভবত গবেষণায় বাঙালিরা কোনো ধরনের সহযোগিতা না করায়, বসুর গদ্যে বিনা বাধায় এবং সহানুভূতির কণ্ঠে, পাকিস্তানি বয়ান গৃহীত হয়েছে। বসুর লিখিত বই এবং প্রবন্ধগুলো সূক্ষ্মভাবে পড়লে দেখা যাবে যে ২০০৩ সাল থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের একটি অনানুষ্ঠানিক গোষ্ঠী তাকে মুগ্ধ করতে সফল হয়েছিল। অন্যদিকে বাঙালিরা তার রোষ এবং অনীহার শিকার হয়, ফলে বাঙালিদের গল্পগুলোকে সে সূক্ষ্মভাবে খাটো করে দেখায়। বসুর নেওয়া সাক্ষাত্কারগুলোর ক্ষেত্রেও এই অসামঞ্জস্য লক্ষণীয়। সাক্ষাত্কারের জন্য পাকিস্তানে সে ৩০ জন সেনা কর্মকর্তা এবং তিনজন বেসামরিক ব্যক্তিকে বাছাই করেছে। একই সঙ্গে চারজন সেনা কর্মকর্তা সাক্ষাত্কার দিতে রাজি হননি বলেও সে জানিয়েছে। অর্থাত্ তার বাছাই করা পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মোট ৩৪ জন সেনা কর্মকর্তা এবং তিনজন বেসামরিক ব্যক্তি। ফলে বইটি পড়লে মনে হবে এটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিশালাকার পুনর্মিলনীর সময়ে লিপিবদ্ধ করা। বইটির মূল বিশ্বাসের জায়গা: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভূমিকা যাচাই করতে সবচেয়ে নির্মোহ উত্স হচ্ছে তারা নিজেরাই।
অন্যদিকে, যেসব পাকিস্তানি নাগরিক সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল, তাদের কথা বসুর সাক্ষাত্কার এবং উদ্ধৃতিগুলোতে অনুপস্থিত। এমনকি ১৯৭১ সালে প্রতিবাদ, ভূমিকার জন্য যে ৪০ জন পাকিস্তানিকে বাংলাদেশ সরকার পুরস্কৃত করেছে, তার উল্লেখও বসু করেনি।২২ এই ভিন্নমতাবলম্বীদের মধ্যে ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং মেজর ইকরাম সেগাল (উভয়ই প্রতিবাদ করে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেছিল), এয়ার মার্শাল আজগর খান, বালুচ নেতা মীর গাউস বাজিনজো, ন্যাপ নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান, অ্যাডভোকেট জাফর মালিক, সাংবাদিক সাবিহউদ্দীন গাউসি এবং আই এ রহমান, অধ্যাপক এম আর হোসেন, তাহেরা মাজহার ও ইমতিয়াজ আহমদ। ১৯৭১ সালে ভিন্নমত প্রকাশ করায় কারাবরণ করে সিন্ধি নেতা জি এম সাইদ, মালিক গোলাম জিলানি, কবি আহমদ সালিম এবং পাকিস্তান বিমানবাহিনীর আনোয়ার পীরজাদা। বসু কর্নেল নাদির আলীর কথাও এড়িয়ে গেছে, যার বইয়ে আদেশকারী অফিসারের নির্দেশনা হুবহু আছে: ‘বেজন্মাদের যত পার হত্যা কর, কোন হিন্দু যেন বেঁচে না থাকে... হিন্দুদেরকে মেরে ফেল। এই আদেশ সবার জন্যই’।২৩ সে শাইখ আয়াজ, হাবীব জাবিল, আজমল খাত্তাক এবং ফয়েজ আহমদ ফয়েজের মতো প্রতিবাদী কবিদের মতামত গ্রাহ্য করেনি। ‘আমার থেকে দূরে থাক: বাংলাদেশ-১’ (আমি কীভাবে হত্যার এই উত্সবকে অলংকৃত করতে পারি,/ কীভাবে সাজাতে পারি এই নৃশংসতাকে?) এবং ‘বাংলাদেশ-২’ নামে ফয়েজ আহমদ ফয়েজের বিখ্যাত কবিতার কোনো উল্লেখ সে করেনি।২৪ নিঘাত সাঈদ খান এবং নিলাম হুসাইনের মতো নারীবাদী কণ্ঠস্বরগুলোও বসুর লেখায় অনুপস্থিত।২৫ পাকিস্তানি গবেষক সাদিয়া তুর ডেড রেকনিং-এর গবেষণা-পদ্ধতির বিষয়ে মন্তব্য করেছে: ‘শর্মিলা বসু পাকিস্তানে কোনো প্রগতিশীল মানুষের সঙ্গে কথা বলেনি।’২৬
বাংলাদেশে বসু ৩৯ জনের সাক্ষাত্কার নিয়েছে এবং এদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক সাক্ষাত্কারদাতার অভিজ্ঞতা পাকিস্তানে সাক্ষাত্কারদাতাদের সমতুল্য। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বসু শুধু মেজর জেনারেল ইমামুজ-জামান এবং শমসের মুবিন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছে। বিহারি হত্যাকাণ্ডের স্থানগুলো চিহ্নিত করার জন্য সে চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলের তথ্য ব্যবহার করলেও, তার চলচ্চিত্রের অন্য বয়ানগুলো এড়িয়ে গেছে২৭, যেখানে বাঙালি এবং বিহারি উভয়েরই সহিংসতার কথা আছে। অধ্যাপক মেঘনা গুহঠাকুরতা এক জায়গায় তার বাবার হত্যাকাণ্ড সবিস্তারে বর্ণনা করেছে,২৮ কিন্তু তার জেন্ডার-সম্পর্কিত গবেষণা আমলে নেওয়া হয়নি। মেঘনা আমাকে বলেছে,
বসু আমাকে ২৫ মার্চের ঘটনাগুলো সম্পর্কে বলতে বলেছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, যে অফিসারটি আমার বাবাকে নিয়ে যেতে এসেছিল, সে বলেছিল, ‘বাসার ভিতরে থাকেন, ঘরে কোনো ছেলে আছে?’ কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে ওই রাতে কোনো নারী হত্যা করা হয়নি। বসু মধু দা’র পরিবারের কাছে প্রমাণগুলো দেখতে পারত; বা সেই নারী সাংবাদিক, যাকে প্রথম রাতে হত্যা করা হয়...আমি বসুকে জগন্নাথ হলে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেখানে সে হিন্দু কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ২৫ মার্চ রাতে হামলার শিকার হওয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছিল। আশ্চর্যের বিষয়, এত কিছুর পরও সে এটাকে জেনোসাইড, বা এমনকি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলতে অস্বীকার করছে।২৯
বইটিতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বিষয় উল্লেখ আছে, তবে তা তাচ্ছিল্যের মোড়কে আবৃত। বসু দুবার উল্লেখ করেছে যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালক মফিদুল হক ময়মনসিংহে একটি সেনানিবাস থাকার কথা জানত না [অন্যত্র বসু স্বীকার করেছে যে এটি ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি অগোছালো স্থানীয় কেন্দ্র (৮৩)]। পরে আবার সে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কঠোর সমালোচনা করেছে, কারণ জাদুঘর থেকে তাকে একটি প্রকাশনা দেওয়া হয়েছিল, যেখানে দুজন ডাক্তারের সাংকেতিক অঙ্গচ্ছেদের বর্ণনা ছিল (এটি হয়তো একটি যুদ্ধকালীন মিথ)। আমি যখন মফিদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, সে বলেছিল:
শর্মিলা বসু তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এ রকম সবকিছুই এড়িয়ে গেছে। বইটি আমাদের কাজ তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। সে আমাদের ইতিহাস নিয়ে যা করেছে তা দেখার পর, জাদুঘর নিয়ে তার কথাবার্তায় আশ্চর্য হচ্ছি না।৩০
আত্মসমালোচনামূলক কণ্ঠস্বরগুলো
তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ (মুক্তির গান, মুক্তির কথা এবং মাটির ময়না), নায়েবুদ্দীন আহমদ (ধর্ষণের শিকার বাঙালিদের ছবি), রেহনুমা আহমেদ (ধর্ষণ এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর লিখিত প্রবন্ধগুলো), ইসরাত ফেরদৌসি (দ্য ইয়ার দ্যাট ওয়াজ), বদরুদ্দীন উমর (ভাষা আন্দোলনের সমন্বিত ইতিহাস), বশীর আলহেলাল (ভাষা আন্দোলন), রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী (বাংলাদেশ ১৯৭১), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (ধর্ষণের কথ্য ইতিহাস প্রকল্প), সিরাজুল ইসলাম, রেহমান সোবহান এবং আফসান চৌধুরীর কাজসহ বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বাংলা ও ইংরেজি প্রধান দলিল, বই এবং চলচ্চিত্রগুলো বসু তার গবেষণায় আনেনি। আফসান চৌধুরীর কাজ এড়িয়ে যাওয়া বিস্ময়কর, কারণ বসুর গ্রন্থপঞ্জিতে উল্লেখিত ১১ খণ্ডের স্বাধীনতার ইতিহাস বইয়ের সহসম্পাদক এবং পরবর্তী সময়ে একটি চার খণ্ডের ইতিহাস বইয়ের লেখক, এই একই আফসান চৌধুরী।৩১ বসু বইগুলো পাদটীকায় উল্লেখ করলেও এগুলোর কোনোটাই বোধ হয় পড়েনি।
অন্যান্য বাংলা উত্স গ্রন্থপঞ্জিতে উল্লেখ করা হয়েছে (নীলিমা ইব্রাহিম, মুইদুল হাসান, রশীদ হায়দার), কিন্তু মূল বইয়ের অধ্যায়গুলোতে এসব সূত্রের কোনো উল্লেখ নেই। বরং বসু শ্রদ্ধাসহকারে যে আনুষঙ্গিক উত্সগুলো প্রায়ই উল্লেখ করেছে, সেগুলো হলো পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র, আর্চার ব্লাড ও হেনরি কিসিঞ্জার। ফলে আমরা পাকিস্তান সরকার (এবং সেনাবাহিনী), যুক্তরাষ্ট্রের একজন রাষ্ট্রদূত এবং নিক্সনের পাকিস্তান পলিসির মূল হোতার মতামতই জানতে পারছি। বাংলাদেশের এই ইতিহাসে বাংলাদেশিদের মতামতই অনুপস্থিত।
হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট উদ্ধৃত করা হলেও, এর সার্বিক উপসংহারগুলো বসুর বইতে স্থান পায়নি। এই উপসংহারগুলোর মধ্যে ছিল লে. জেনারেল নিয়াজির কথাবার্তা এবং পদক্ষেপগুলো হত্যাকাণ্ড এবং ধর্ষণ উত্সাহিত করার অভিপ্রায়ে পরিকল্পিত ছিল, সামরিক অভিযানের সময় অতিরিক্ত শক্তির ব্যবহার, উত্পাটনের সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার এবং সদস্যের আচরণ এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের প্রতি সেনা কর্তৃপক্ষের আচরণ।৩২
বসু বাংলাদেশে একটি উত্স হিসেবে ডেভিড লাডেনকে ধন্যবাদ দিয়েছে, কিন্তু লাডেন এই বিশ্লেষণকে বিভ্রান্তিকর হিসেবে বর্ণনা করেছে:
এই প্রকল্পের শুরুর দিকে আমার সঙ্গে শর্মিলার মতবিনিময় হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বসুর গবেষণা পদ্ধতির মানোন্নয়ন করা এবং তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা; তবে এর কিছুই সম্ভব হয়নি। একপর্যায়ে সে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তার প্রাথমিক কাজগুলোর যে সমালোচনামূলক পর্যালোচনাগুলো আমি করেছিলাম, সে কখনো সেগুলোর উত্তর দেয়নি। বসু তার বইয়ের কৃতজ্ঞতা স্বীকারে আমাকে উদ্ধৃত করেছে, কিন্তু সে কখনো আমাকে বইটি পাঠায়নি, বা এই বইটা যে প্রকাশিত হয়েছে, এই খবরও জানায়নি।৩৩
পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে গল্পগুলো বলেছে, বসু সেগুলোকে সত্য হিসেবে প্রচার করেছে, খুব কম ক্ষেত্রেই সে এগুলো যাচাই করে দেখেছে। যে গল্পগুলোতে বাঙালিদের কাপুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর প্রতি সে অতিরিক্ত বিশ্বাসপ্রবণতা দেখিয়েছে। কামাল হোসেনের আত্মসমর্পণ বিষয়ে বসুর গল্পটির কথাই ধরা যাক (পৃ. ২১১, ফুটনোট ৪৯)। হামিদা হোসেনের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে, সে জানায়:
ওই রাতে সেনা কর্মকর্তারা সৈন্যসহ এসেছিল, তারা স্টেনগান এবং অন্যান্য অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। তারা শিশুসহ আমাদের সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড় করিয়ে কামাল কোথায় জানতে চায়। যেই বুয়া বাচ্চাদের দেখাশোনা করত, তাকে আঘাত করেছিল এবং আমার ভাগনিকেও থাপ্পড় মেরেছিল। কামাল হোসেন কোথায়, তা জানলেও সে এটা তাদের বলবে না; এই কথা বলায় আমার ভাগনিকে আঘাত করে। পাকিস্তানি অফিসারদের কাছে আত্মসমর্পণের কোনো বার্তা কামাল পাঠায়নি। সে কয়েকটি বাসায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিল এবং সবশেষে লালমাটিয়ায় এক আত্মীয়র সঙ্গে ছিল; এই অবস্থাতেই এক রাতে সেনাবাহিনী তাকে খুঁজে পায় এবং তুলে নিয়ে যায়।৩৪
যখন আমি হামিদা হোসেনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বসু এই ঘটনাগুলো সহজেই যাচাই করতে পারত কি না, তখন সে উত্তর দিয়েছিল, ‘কামালের কাছে সত্যটা যাচাই না করেই বসু জেনারেল মিঠাকে উদ্ধৃত করেছে। যখন বসু ঢাকাতে তার কথিত ‘নিবিড় গবেষণা’ করছিল, তখন কামাল ঢাকাতেই ছিল এবং বসু খুব সহজেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারত।’৩৪
বিহারিবিরোধী সহিংসতার বিষয়ে যে বাংলাদেশিরা কথা বলেছে তাদের কথা আমলে না নিয়ে বসু শুধু পাকিস্তানি প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানই ব্যবহার করেছে। এর ফলে ‘বাংলাদেশে বেশ উচ্চ স্বরে এবং ভারতেও এই বিষয়টা কিছুটা অস্বীকার করা হয়’ (১৪) বলে বসু যে দাবি করেছে, তা বেশ পাকাপোক্ত হতে পেরেছে। কিন্তু বিহারিবিরোধী সহিংসতার বিষয়টি ঠিক কতটা অস্বীকার করা হয়? যেসব বাংলাদেশি বিহারিবিরোধী সহিংসতা বিষয়ে লিখেছে, যেমন আফসান চৌধুরী, নওশাদ নুরী, তাজ উল-ইসলাম হাশমি (দ্য বিহারি মাইনোরিটিস ইন বাংলাদেশ), যতীন সরকার (পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যুর দর্শন), আহমেদ ইলিয়াস (বিহারিস: দ্য ইন্ডিয়ান এমিগ্রেস ইন বাংলাদেশ ৩৫), মীজানুর রহমান (অ্যা কমিউনিটি ইন ট্রানজিসন: দ্য বিহারিস ইন বাংলাদেশ ৩৬), জাকিয়া হক (উইমেন, ওয়ার অ্যান্ড স্টেইটলেসনেস: স্ট্র্যানডেন বিহারি উইমেন অ্যান্ড গার্লস ইন বাংলাদেশ), হরিপদ দত্ত (মহাজের) ও মাহমুদ রহমান (কিলিং দ্য ওয়াটার)-এর কাজ বসু বিবেচনা করেনি।
‘প্রথম’ হওয়ার জন্য বসু এতটাই উদ্গ্রীব ছিল যে বাংলাদেশের ভেতরে চার দশক ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সক্রিয়ভাবে প্রশ্ন করে যে গবেষণাগুলো হয়েছে, সেগুলোর কথা সে বলেনি। ১৯৭১-এর বয়ানের সমস্যাগুলোর কথা যদি অন্যরা লিখে থাকে, তবে বসুর বইটিকে ‘যুগান্তকারী’ (বইয়ের মলাটে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে) দাবি করা যায় না।
গণহত্যা চিহ্নিত করা
মীমাংসিত সত্যগুলোর বাইরেও, ১৯৭১ সালে উভয় পক্ষেই যে কথ্য ইতিহাসগুলো তৈরি হয়েছিল, তা আন্তর্জাতিক (সুপারপাওয়ারদের প্রক্সি দ্বন্দ্বসহ) এবং স্থানীয়ভাবে সংঘটিত এই সংগ্রামের প্রপাগান্ডা প্রবৃত্তি দ্বারা ভারাক্রান্ত ছিল। কিন্তু তার বইতে বসু শুধু পাকিস্তানি পক্ষের বর্ণনাগুলোকে উচ্ছ্বসিত এবং গুরুত্বারোপ করেছে। তার প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র এবং পশ্চিম পাকিস্তানি ও বাঙালি সরকারপন্থী বর্ণনাগুলো (৩১)। বিশেষত, সে পাকিস্তান সরকারের হোয়াইট পেপার অন দ্য ক্রাইসিস ইন ইস্ট পাকিস্তান, আগস্ট ১৯৭১-এর ওপর নির্ভর করেছে। সে রিপোর্টের ভাষ্য অনুযায়ী বাঙালিরাই এই সহিংসতার জন্য সেনাবাহিনীকে প্রচণ্ডভাবে প্ররোচিত করেছিল; বিহারিদের জীবন, সম্পদ এবং জাতীয় ঐক্য রক্ষা করার জন্যই সেনাবাহিনীকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছিল এবং এই গোটা বিধ্বংসী ঘটনার জন্য দায়ী ছিল ভারতীয় হস্তক্ষেপ। জাতিসংঘে বিষয়গুলো উপস্থাপনের জন্যই পাকিস্তান সরকার এই দলিলটি তৈরি করেছিল (পরবর্তী সময়ে যেই কাজটা ভুট্টো করেছিল)। যুদ্ধের সময় প্রকাশিত আরও কয়েকটি শ্বেতপত্রকে বসু অগ্রাহ্য করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি৩৭, মার্কিন সিনেট৩৮ এবং হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস৩৯ এর একাধিক শুনানি এবং ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরস্টিস-এর জেনেভা সেক্রেটারিয়েট।৪০ ১৯৭১ বিষয়ে প্রতিবেদনের প্রাপ্যতা এবং সম্ভাব্য পক্ষপাতের সমস্যা অবশ্যই রয়েছে, তবে পাকিস্তানি সরকারের শ্বেতপত্র এবং হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টের পক্ষপাতমূলক বর্ণনার (ভুট্টোর চাপে, ১৯৭২ সালের প্রতিবেদনের রাষ্ট্রের প্রতিকূল ‘অপলাপ’ এবং ‘জঞ্জাল’ বাদ দেওয়ার পর, ১৯৭৪ সালে সম্পূরক অংশ প্রকাশিত হয়) ভারসাম্য রক্ষার খাতিরে ওপরে উল্লিখিত দলিলগুলো বিবেচনার যোগ্য।
ডেড রেকনিং প্রকাশিত হওয়ার পর ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময়ে ধর্ষণের ওপর গবেষক নয়নিকা মুখার্জি৪১ দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রশ্ন করে, ‘একটি নতুন গবেষণা পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের শান্ত এবং দয়ালু হিসেবে দেখেছে। এটা কি ন্যায্য হতে পারে?’৪২ শ্রীনাথ রাঘাবান ক্রোধান্বিত হয়ে তার পর্যালোচনায় লিখেছে, ‘এই বই যেসব চাতুরী, বিভ্রান্তি, ফাঁকি এবং পদ্ধতিগত ত্রুটি দ্বারা আক্রান্ত, তার সবগুলো পর্যালোচনা করা অসম্ভব।’৪৩ বইটিতে ভুলের একটি তালিকা করতে বসে আমি রাঘাবানের সঙ্গে একমত হই—সম্ভব-অসম্ভবের চেয়ে বড় কথা, এর শেষ নেই।
বইটির অধিকাংশ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা প্রাথমিক উত্স ছিল। নির্বাচন-পরবর্তী আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর, লে. জেনারেল গোলাম মোস্তাফা দাবি করে ‘প্রথম দিকে সেনাবাহিনী শৃঙ্খলা রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল’ (৩১)। অন্যদিকে লেফটেন্যান্ট মুহাম্মদ আলী শাহ ‘ঢাকা ক্লাবের মতো জনপ্রিয় জায়গাগুলোতে বাঙালিদের সঙ্গে ভালো সামাজিক জীবনের অবসান’ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে। উত্তপ্ত মার্চ মাস সম্পর্কে বসু জানাচ্ছে, ‘যতজন অনুগত সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে আমি কথা বলেছি...তারা জানিয়েছে যে সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান এবং শক্তি প্রয়োগ না করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল (৩৩)।’
২৫ মার্চের দমন-পীড়ন যখন চলছিল, লেফটেন্যান্ট মুহাম্মদ আলী শাহর দাবি যে ‘ওই রাতে গোটা পথে বিশ বা পঁচিশ জনের বেশি লোককে হত্যা করা হয়নি’; শাহ অস্ত্রের একটি হিসাব দিয়েছে, যা বসু মেনে নিয়েছে—‘গোটা ঢাকাতে ওই তিনটি ট্যাংকই ছিল’, ‘ট্যাংকের প্রধান অস্ত্রগুলো ওই রাতে ব্যবহার করাই হয়নি’, এবং ‘আনুষঙ্গিক অস্ত্রগুলো শুধু শক্তির প্রদর্শন হিসেবেই চালানো হয়েছিল’ (৫৫)। বাঙালি পরিচয়ে মৌলিক আঘাত ছিল শহীদ মিনার ধ্বংস করা। সেই ঘটনাকে শুধু ‘ধ্বংসোন্মাদনা’ এবং ‘কোনো সামরিক কারণ না থাকায়’ ‘সময় এবং সম্পদের অর্থহীন অপচয়’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে (৫৮)। গোটা সামরিক দমন-পীড়ন অভিযান পর্যবেক্ষণ করে বসু শান্তভাবে মন্তব্য করেছে, ‘তর্কসাপেক্ষে, যেকোনো পরিস্থিতিতেই এটি সঠিক নীতি ছিল না।’
নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় বা অন্য কোনোভাবে সংজ্ঞায়িত একটি গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার সুনির্দিষ্ট অভিপ্রায় গণহত্যার আইনি সংজ্ঞা। এই ক্ষেত্রে বসু এটা প্রমাণ করতে উদ্গ্রীব যে হামলার লক্ষ্যবস্তুর কোনো ধর্মীয় ভিত্তি ছিল না। চুকনগরে হিন্দুদের সুনির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ডকে সে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে, যেন সে জেনোসাইড শব্দটি এড়িয়ে যেতে পারে: ‘যদিও মার্কিন কনসাল জেনারেল ব্লাড একভাবে বর্ণনা দিয়েছে, তারপরও এই হত্যাকাণ্ডকে সাধারণভাবে সব হিন্দুর বিরুদ্ধে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে উল্লেখ করা যায় না, কারণ হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্য হিসেবে শুধু প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদেরই বেছে নেওয়া হয়েছিল’ (১২৩) এবং ‘সামরিক সরকার সম্ভবত কোনো একজন ব্যক্তির হিন্দু হওয়ার বিষয়টিকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হওয়ার রাজনৈতিক সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করেছিল’ (১২৪)। ভারত সরকারের হিসাব অনুসারে ১৯৭১ সালের মে মাস পর্যন্ত ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের ৮০% ছিল হিন্দুধর্মাবলম্বী৪৪, যা প্রমাণ করে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হামলার লক্ষ্য হিসেবে ধর্মকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করেছিল। কিন্তু বসু এই বিষয়টি তার বিশ্লেষণে আনেনি।
হামলার নির্দিষ্ট লক্ষ্য
বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকদের হত্যার বিষয়ে বসু বলেছে, ‘সৈন্যরা সব বাসার দরজাই ভেঙেছিল’, ফলে এটা ‘কোনো নামের তালিকার ভিত্তিতে টার্গেট করার বিষয় ছিল না’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের হত্যাকাণ্ডকে তালিকা না থাকার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে: ‘যদি সেনাবাহিনীর কাছে অধ্যাপকদের কোনো তালিকা থাকত, তবে তাতে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের নাম থাকাই স্বাভাবিক ছিল, কারণ সে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিল (৬৩)।’ বসু যেটা বিশ্লেষণে আনেনি তা হচ্ছে, তালিকা অবশ্যই ছিল, কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে পূর্বাঞ্চলের এলাকাগুলো অপরিচিত ছিল এবং অবশ্যই ভাষা ও হাতের লেখাও পরিচিত ছিল না; যার ফলে প্রায়ই ভুল লোক আটক করা হতো, যেমনটা ঘটেছিল পরিসংখ্যান বিভাগের মনিরুজ্জামানের ক্ষেত্রে (এ কারণেই বাঙালি এবং বিহারি সহযোগীরা সেনাবাহিনীর ‘চোখ ও কান’ হিসেবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে এবং তা করা হয় আনুষ্ঠানিক শান্তি কমিটি গঠন করার মাধ্যমে)। তালিকা অনুসারে হত্যা করতে গিয়ে যদি বিশৃঙ্খলা এবং ভুল হয়, তার মানে এই নয় যে, সেখানে কোনো তালিকাই ছিল না।
ব্রিগেডিয়ার (লে. কর্নেল) [বন্ধনীর ভেতরে আছে যুদ্ধকালীন র্যাংক] তাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার বিষয়টি অস্বীকার করে। সে দাবি করে, ‘শিক্ষকদের কোয়ার্টারগুলোতে কেউ যায়নি’ (৬০)। কিন্তু তার মিথ্যাটা ধরা পড়ে যায় যখন বসু নিশ্চিত করে যে কয়েকজন সৈনিক অবশ্যই কোয়ার্টারে গিয়েছিল। এরপর কি ব্রিগেডিয়ার তাজকে একজন নির্ভরযোগ্য সাক্ষী হিসেবে গণ্য করা উচিত? তারপরও বসু ব্রিগেডিয়ার তাজের দাবির সঙ্গে একমত প্রকাশ করে উল্লেখ করে যে, শিক্ষকদের টার্গেট করে ‘কোনো তালিকা ছিল না’ এবং মেজর জেনারেল উমরও একই দাবি করেছে (৬০)। পুনরায় ব্রিগেডিয়ার তাজ ৪৪ জন মৃতের হিসাব দিয়েছে, যা পাকিস্তান রেডিওতে ঘোষণাকৃত ৩০০ জন মৃতের হিসাবের চেয়ে অনেক কম এবং এই সংখ্যাটি বসুও উদ্ধৃত করেছে। যাঁরা সবচেয়ে ভালোভাবে জানেন ‘এ রকম দুজন ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের দেওয়া হিসাবমতে মৃতের সংখ্যা ৪৪ থেকে ৩০০; এই মৃতের সংখ্যার হিসাব কীভাবে মেলাবে?’ (৬৭)। এমনকি খোদ সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির ডেভিড ব্লির মতে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা অনেক লোককে হত্যা করেছে’৪৫ কিন্তু তারপরও বসু মৃতের সংখ্যা বাড়াতে নারাজ।
লেফটেন্যান্ট মুহাম্মদ আলী শাহ দাবি করে, সে জিঞ্জিরায় ‘উন্মত্ত জনতার মাথার ওপর দিয়ে গুলি করেছে’ এবং বসুর জন্য এই দাবিই যথেষ্ট। সে সহানুভূতির সঙ্গে ‘বিদ্রোহ মোকাবিলা করতে সেনাবাহিনীর হিমশিম খাওয়ার’ বিষয়টি উল্লেখ করেছে (৭৭)। একইভাবে, পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বরইতলা হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করেছে, কারণ তারা এটিকে ‘উদ্ভট’ হিসেবে বিবেচনা করে এবং উল্লেখ করে যে, ‘লোকজনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হত্যার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি না’ (১৪৫)। খুলনায় বিহারিদের হত্যা সম্পর্কে বসু মেজর বাবরের গল্পগুলো নির্দ্বিধায় মেনে নেয়। মেজর বাবরের মতে, বিহারিদের বিরুদ্ধে ‘গিলোটিন’-এর মতো কাঠামো, ‘ধামা’, ‘পাঞ্জা’ এবং অন্যান্য ‘নির্যাতনের হাতিয়ার’ (৮২) ব্যবহার করা হয়। বসু এই বর্ণনা যাচাই না করে মেনে নেয়।
সান্তাহারে বিহারি হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে ক্যাপ্টেন (ব্রিগেডিয়ার) শওকাত কাদির ‘লাশে ভর্তি’ গভীর গর্ত, ‘শিশুদের লাশে ভর্তি’ কক্ষ, এবং ‘মানুষের মগজ লেপ্টে থাকা দেয়ালের’ কথা বলেছে; অন্যদিকে মেজর আনিস আহমদ ‘পচা লাশে ভর্তি প্ল্যাটফর্ম-’এর কথা স্মরণ করেছে (৮৫)। ক্যাপ্টেন সারওয়ার ঈশ্বরদীতে ‘বিহারি শিশুদের বর্শাবিদ্ধ এবং নারীদের চিরে ফেলা লাশ’ দেখার কথা উল্লেখ করেছে (৮৫)। অন্যদিকে বর্শাবিদ্ধ বাঙালি শিশুর একই ধরনের বর্ণনা ক্যাথলিক চার্চের তহবিল তোলার প্যামফলেটে ছাপা হয়েছিল। এসব পরস্পরবিরোধী, অবিকল বর্ণনাগুলো বসু যেভাবে উদ্ধৃত করেছে, তা অন্তত কিছু প্রমাণসহকারে উপস্থাপনের দাবি রাখে। ঈশ্বরদীতে সেনা কর্মকর্তারা বিহারি নিধনযজ্ঞের ছবি তুলেছে বলে দাবি করেছে, কিন্তু সেই ছবিগুলো কোথায় গেল?
থানাপাড়ায় বাঙালিদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু তারপরও সূক্ষ্মভাবে দায়টা বাঙালি বিদ্রোহীদের ওপরই চাপানো হয়েছে: ‘যদি বাজারে কেউ তাদের ওপর গুলিবর্ষণ না করত, তবে সম্ভবত সেনা ইউনিটটি চলে যেত এবং গ্রামবাসীদের হত্যা করার প্রয়োজন বোধ করত না’ (১১১)। চুকনগরকে বর্ণনা করা হয়েছে এমন ঘটনা হিসেবে, ‘যা নিয়মিত ঘটনার ব্যতিক্রম হিসেবে ঘটেছে বলে মনে হয়’ (১২২)। ওই অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করা তিনজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার বয়ান গ্রহণ করেছে বসু। এই অফিসাররা কেউই ‘চুকনগর ঘটনাটি সম্পর্কে শোনেনি’। তাদের বর্ণনা থেকে সে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, চুকনগরে হিন্দু শরণার্থীদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি শুধু ‘পঁচিশ থেকে ত্রিশ জনের একটি দল’ ঘটিয়েছিল। এখানে ‘দল’ শব্দটি বসু দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছে—পরোক্ষভাবে সে দলছুট মিলিশিয়া, এবং অবশ্যই এই দলের অল্প লোকবল, ইঙ্গিত করেছে। এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে টার্গেট করা কিলিং থেকে বসু দায়মুক্তি দিচ্ছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বয়ান গ্রহণ করে বসু লিখেছে: ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা যেভাবে বেসামরিক বা সামরিক ব্যক্তিদের নির্যাতন, অঙ্গচ্ছেদ এবং হত্যা করেছে, তা বর্বরোচিত; ফলে তা স্বাধীনতাপন্থীদের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে (১১২)।’ এখানে বসু একটি ঘটনা উল্লেখ করেছে (ঈশ্বরদীর বিহারি হত্যা) এবং এর ফলে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে পাকিস্তানের পক্ষের লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে।
ইঙ্গিতময় বিশেষণ
ইঙ্গিতময় বিশেষণ ব্যবহারের মাধ্যমে গোটা বইতেই বসুর রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। শুরুতে তার মূল্যায়ন হচ্ছে ‘পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা ভালো লোক ছিল, যারা তাদের সর্বোচ্চ ভালোটুকু করছিল’ (১৩)। জেনারেল ওমর সেনা অভিযানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার কথা অস্বীকার করে এবং বসু তা গ্রহণ করে: ‘তার ভূমিকা পরিষ্কার করার জন্য সে স্পষ্টবাদী ছিল’, ‘যুক্তি দেখায়’, ‘অস্বীকার করে’, ‘দাবি করে’। অন্যদিকে মেজর জেনারেল মিঠা ‘একজন সত্ এবং প্রতিভাবান কর্মকর্তা’ (৪৯)। মেজর জেনারেল মিঠা সত্ হয়তো হতেও পারে, কিন্তু ধারাবাহিকভাবে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বাহুল্য এবং একপক্ষীয় প্রশংসা করা কি ইতিহাসবিদের কাজ? ঘটনাপ্রবাহকে নিজের মতো করেই ফুটে উঠতে দেওয়া উচিত।
শুধু ঘটনা নয়, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত শব্দের ক্ষেত্রেও একই সমালোচনা প্রযোজ্য। ডেড রেকনিং-এর পর্যালোচনায় উর্বশী বুটালিয়া এই বিষয়টির ওপর মন্তব্য করেছে। ‘বাংলাদেশি বর্ণনাগুলোকে “দাবি” বলা হয়েছে, পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের বর্ণনাকে সরাসরি বয়ান হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে (১৪২-৪৫)।’৪৬ আমি ৭৬ থেকে ৯৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত বিশেষণগুলোকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। এই অংশে আমরা পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সাক্ষাত্কারগুলো পাব, যেগুলো প্রায়ই পাদটীকা বা নথি ছাড়া উপস্থাপন করা হয়েছে: লেফটেন্যান্ট মুহাম্মদ আলী শাহ [‘নিজেকে এই অবস্থায় পেয়েছে’ (৭৬)], ব্রিগেডিয়ার করিমুল্লাহ [‘তার নথি একটি স্পষ্ট চিত্র উপস্থাপন করেছে’, ‘নথিগুলো’, ‘তারা জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল’, ‘তারা পেয়েছিল’ (৭৮, ৭৯)], মেজর সামিন জান বাবর [‘বলে’ (৮২)], ক্যাপ্টেন (ব্রিগেডিয়ার) শওকত কাদির [‘লিখেছে’, ‘বর্ণনা করেছে’ (৮৪)], মেজর আনিস আহমেদ [‘বলছে’ (৮৪)], ক্যাপ্টেন সরওয়ার [‘সম্পর্কিত’, ‘বলেছে’ (৮৫)], লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ শাহ [‘কিছু দেখেছে’, ‘এখনো মনে রেখেছে’ (৮৯, ৯০)], মেজর আবদুল মজিদ [‘বলেছে যে এটা সবাই জানত’, ‘বলেছে’ (৯৩, ৯৪)]। কিন্তু প্রায় ২০ পৃষ্ঠাজুড়ে স্বাধীনতাপন্থী বাঙালি অফিসার বা বেসামরিক নাগরিকদের অন্য ধরনের বিশেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে: লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাকিব [‘অজ্ঞতা প্রকাশ করেছে’ (৭৮)], ব্রিগেডিয়ার মজুমদার [‘উল্লেখ করেনি’ (৭৮)], লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদ [‘দাবি করে’ (৭৮)], মেজর সফিউল্লাহ [‘দাবি করে’ (৭৮)], রুস্তম আলী শিকদার [‘দাবি করে যে’, ‘কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ উপস্থাপন করতে পারেনি’ (৮০)], লেফটেন্যান্ট ইমামুজ জামান [‘দোষারোপ করে’ (৯২), ‘মারাত্মক অভিযোগ’, ‘অভিযোগ’, ‘অভিযুক্ত অপরাধী’—সবই এক অনুচ্ছেদে (৯৩)] এবং সবশেষে জয়নাল আবেদীন (‘অভিযোগ করে’ যে ‘আধা ডজন (পাকিস্তানি) সৈন্য গ্রামের ঘরে ঘরে যায়, সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে এবং সবাইকে হত্যা করে’) (৮৮)।
যুদ্ধের সময় উভয় পক্ষই হয়তো বিশ্বের সহমর্মিতা পাওয়ার জন্য মৃতের সংখ্যা পরিবর্তিত করে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু এই বইতে শুধু এক পক্ষের দাবিগুলোই যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। বসুর বর্ণনায় যুদ্ধ-ক্লান্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেন জোসেফ হেলারের ক্যাচ ২২ উপন্যাসের একদল শোষিত পুরুষ, ‘যারা ডাল-রুটি খেয়ে বেঁচে আছে’ (৩৩)। সোজা কথায়, যুদ্ধ খুব বাজে জিনিস এবং রক্ষার প্রথম পদক্ষেপটি হচ্ছে ভালো খাবার খাওয়া। একজন পাকিস্তানি কর্মকর্তার সহিংসতাকে সব সময়ই গুজব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘ক্যাপ্টেন বুখারি এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইয়াকুবের নামে মানুষ হত্যার গুজব ছিল।’ পরবর্তী একটা লাইনে বলা হয়েছে, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী পক্ষও কোনো অংশে ভালো ছিল না।’ একই অধ্যায়ে, একই পাতায় এবং এই গোটা বইয়ের মধ্যে কোন অভ্যন্তরীণ যুক্তির ভিত্তিতে যুদ্ধরত দুই পক্ষের বয়ান ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে? এখানে বইটির সম্পাদক ভূমিকা পালন করতে পারত—প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের ক্ষেত্রে ‘অভিযোগ করে’ ব্যবহার করা যেত, বা কোনো বিশেষণ ব্যবহার করা থেকেই বিরত থাকতে পারত। কিন্তু যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো কথা উচ্চারিত হচ্ছে, তখনই বেছে বেছে বিশেষ কিছু শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে।
‘হিট অ্যান্ড রান’ শিরোনামের অধ্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্করণগুলোকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা লক্ষ করা যাক। হরিলাল সিংহানিয়া লুটের যে বর্ণনা দিয়েছে, তাতে মনে হয় এখানে অনেক লোক জড়িত ছিল (দুজন পাকিস্তানি সৈনিক এবং ১২ জন পাকিস্তানপন্থী বেসামরিক লোক), যা এই অভিযোগকে বসুর কাছে ‘অবিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে এবং প্রকাশের পূর্বে তা আরও বিশদভাবে যাচাই করা উচিত ছিল’ (১৩৮)। কিন্তু এর বিপরীত অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে কেন একই ধরনের সূক্ষ্ম যাচাই প্রযোজ্য হবে না? পোলাঘাট রেল ফ্যাক্টরিতে লুট, জোরপূর্বক কাজ করানো এবং হত্যাকাণ্ডের যে দাবি সিংহানিয়া করেছে (বসু এটাকে ‘চাঞ্চল্যকর অভিযোগ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে), তা খণ্ডনের জন্য বসু কর্নেল মুহাম্মদ সাফির দ্বারস্থ হয়েছে, যাকে বসু ‘মৃদুভাষী কিন্তু মতামতে অটল’ বলেছে, যে ‘প্রতিটি অভিযোগের সরাসরি উত্তর দিয়েছে’। ইতিহাস কি তাহলে স্নিগ্ধ আচার-ব্যবহার এবং আতিথেয়তায় পর্যবসিত হয়েছে (‘কোনো পূর্বপরিচয় ছাড়াই আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলো’)? (১৩৮) যে সবচেয়ে ভালো গল্প বলে, সে হবে নথির ইতিহাসবিদ? লুট সম্পর্কে কর্নেল সাফির উত্তর হচ্ছে ‘এ রকম ঘটনার কথা কখনো শুনিনি’ এবং ‘যদি একজন কর্মকর্তা... এ রকম কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকত, তবে এটা রিপোর্ট হওয়ার কথা ছিল’ (তাহলে বলতে হয় যুদ্ধক্ষেত্রে শৃঙ্খলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান পৃথিবীতে অনন্য!)। জোরপূর্বক কাজ করানোর বিষয়ে সাফির বক্তব্য হচ্ছে, এটা স্বেচ্ছাশ্রম ছিল, কারণ ‘মানুষ দল বেঁধে এসেছিল’ (১৩৯)। বসু বাকি শূন্যস্থানটুকুও জুড়ে দেয়: ‘সম্ভবত মজুরি হিসেবে কাঠ মূল্যবান ছিল’। অধিকন্তু, সাফি লোকজনকে ‘খাবার পানি, চিকিত্সাসেবা’ দিয়েছিল এবং ‘অবিরত ভারতীয় চলচ্চিত্রের গান’ শুনিয়েছিল, যার জন্য ‘হাজার হাজার লোক এসেছিল’ (১৩৯)।
বইয়ের এই অংশ পড়ার পর বাঙালি পাঠকেরা হয়তো আবার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাইবে, শুধু স্বেচ্ছাশ্রমের এই স্বর্গে অংশগ্রহণের জন্য। একটা পর্যায়ে বসু অবশেষে বুঝতে পারে যে, সাফির গল্প একটু বেশি উদ্ভট কল্পনায় পরিণত হচ্ছে। ফলে সে শেষে যোগ করে: ‘এটা হতে পারে যে যেসব স্থানীয় লোককে কর্নেল সাফি দায়িত্ব দিয়েছিল, তারা অনেক স্বেচ্ছাশ্রমিককে জোর করে কাজে এনেছিল’। সুতরাং বোঝা গেছে, স্থানীয় সহযোগীদের দায়ী করা যায় (যাদের রক্ষা করতে বসু অনাগ্রহী), কিন্তু সেনাবাহিনী কখনোই সহিংসতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। পরিশেষে, হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কর্নেল সাফির সহজ বক্তব্য হচ্ছে, ‘সেনাবাহিনীর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।’ এখানেই বিষয়ের সমাপ্তি—বসুর বইতে সমীকরণের দুই দিক মিলে গেছে।
অন্যদিকে, ঠাকুরগাঁওয়ে বাঘের খাঁচায় বাঙালিদের অত্যাচার করার কাহিনির মধ্যে সম্ভবত অতিশয়োক্তি থাকতে পারে, কিন্তু এটা উন্মোচন করার দায়িত্ব অভিযুক্ত অত্যাচারকারীদের দেওয়া উচিত হবে না। এখানেও অত্যাচারের শিকার শফিকুল আলম ‘দাবি করে’, ‘অভিযোগ করে’ এবং ‘আপাত অবিশ্বাস্য’ (১৪০, ১৪১)। কিন্তু বসু যখন অত্যাচারকারী হিসেবে অভিযুক্ত ব্রিগেডিয়ার (লেফটেন্যান্ট কর্নেল) আমির মুহাম্মদ খানের সঙ্গে দেখা করে, তার তদন্তপ্রবণতা উবে যায়। বসু মেনে নেয় যে মুহাম্মদ খান ‘শুধু শফিকুলকে ভেতরে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল’। ‘এটাই একমাত্র ঘটনা ছিল’, যদি অন্য কেউ বাঙালিদের নির্যাতন করে থাকে ‘তবে মুহাম্মদ খান তা অবশ্যই জেনে যেত’ এবং ‘সেনানিবাসে কাউকে গুলি করা হয়নি’ (১৪২)। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের মসৃণ আদর দ্বারা বসু কীভাবে চমত্কৃত (বাঙালি কর্মকর্তাদের কোনো গুণ বসুর চোখে পড়েনি) তা ব্রিগেডিয়ার খানের বর্ণনা থেকে ফুটে ওঠে: ‘কৌতুক রসবোধসম্পন্ন একজন প্রাণবন্ত মানুষ’, যে প্রশ্নগুলোকে ‘ভালোভাবেই নিয়েছিল’ (১৪২) এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য ‘স্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছিল’। নির্যাতনের গল্পগুলো দ্রুত বাতিল করার পর বসু ব্রিগেডিয়ার খানের একটি গল্প হুবহু বর্ণনা করে, যেখানে একজন পাকিস্তানি কর্মকর্তা এবং তার পরিবারকে ‘সবচেয়ে নির্মমভাবে’ হত্যা এবং ‘জাতিগত হত্যার মাধ্যমে ৩-৪ হাজার বিহারি পরিবারকে পিতৃহারা করা হয়’ (১৪৩)।
বর্ণনার বিষয় থেকে সরে এসে, বসু তার সঙ্গে খানের একটি রসপূর্ণ আলাপের কথা উল্লেখ করে, ‘আমি তাকে বলেছিলাম যে, আমি তাকে “ঠাকুরগাঁওয়ের আওরঙ্গজেব” হিসেবে আমার পাণ্ডুলিপিতে বর্ণনা করছি এবং আরও বলেছিলাম যে সে যদি বাঙালিদের গান এবং নাচ বন্ধ করে দেয়, তবে মানুষ তার সম্পর্কে যে নিন্দা করে তার জন্য সেই দায়ী!’ বসু এরপর উল্লেখ করে, ‘আমির বিষয়টি হাস্যরসের সঙ্গেই নিল।’ আমিরের রসাল এবং নির্দোষ আত্মা শান্তি পাক! সুরসিক কাজী খালিদ আশরাফ বসুর এই গদ্যের বিদ্রূপ করে লিখেছে:
ও, তিনি নিতান্তই আদুরে, খুবই প্রীতিকর। আমি সারা জীবনই বুঝতে পারলাম না যে, কেন অক্ষম বাঙালি পুরুষ (এবং কিছু ছ্যাঁচড়া নারীরাও) তাকে ‘দানব’, ‘পশু’ ইত্যাদি সব জঘন্য নামে ডাকে... যদি আমি পারতাম, তবে এসব নাম পরিবর্তন করতাম এবং ‘হ্যালো কিটির’ মতো আদুরে নাম দিতাম। আমি এটাকে বলতাম, ‘হ্যালো জেনারেল’। হুম, আমি জেনারেলদের প্রতি এই অবিচার মেনে নিতে পারছি না। আমি কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা খুবই ভালো, তারা সব সময়ই ফিটফাট এবং আচার-ব্যবহারে গোছানো ছিল। ১৯৭১ সালের ‘দুর্বৃত্তরা’ তাদের ভুলভাবেই চিহ্নিত করেছে।৪৭
শর্মিলা বসু তার বইয়ের শুরুতে সঠিকভাবেই উল্লেখ করেছে যে, বিদেশি সাংবাদিকদের প্রতিবেদনগুলোও সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন, যেন ‘শোনা গল্পের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনগুলো থেকে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণকে আলাদা করা যায়’ (১০)। কিন্তু কয়েক অধ্যায় পরে সে নিজেই নিজের উপদেশ ভুলে গিয়েছে। বসু লিখেছে, বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোও কারখানাতে অবাঙালিদের গণহারে হত্যা করার প্রমাণ প্রকাশ করেছিল (৮৭)। এ রকম একটি ‘বিদেশি সংবাদমাধ্যমের’ কথা সে ফুটনোটে উল্লেখ করেছে। এটা হচ্ছে ১১ মে ১৯৭১ সালের নিউইয়র্ক টাইমস-এর ম্যালকম ব্রাউনের প্রতিবেদন। যখন আমি মূল প্রবন্ধটি খুঁটিয়ে দেখলাম, তখন এই স্বীকারোক্তিটি দেখলাম: ‘অফিশিয়াল এসকোর্টদের সহায়তায় পাকিস্তান সরকার যে ছয়জন বিদেশি সংবাদকর্মীকে পূর্ব পাকিস্তানে ভ্রমণের সুযোগ দিয়েছিল, তাদের একজন এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।’ যদি যুদ্ধরত একটি সেনা সরকার ভ্রমণের গাইডের ব্যবস্থা করে, পরিষ্কারভাবেই এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিরোধীপক্ষের নির্মমতার সাজানো প্রমাণগুলো সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরা। ভ্রমণটি যে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত, সেই কথা বসু উল্লেখ করল না কেন? পাকিস্তান সরকারের প্রচারণার কৌশল সম্পর্কে তারিক আলী লিখেছে:
বালুচিস্তানের ওপর অভিযান পরিচালনার সময় যে ধরনের প্রেস সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছিল, বাংলাদেশ জেনোসাইডের ক্ষেত্রে তার প্রকৃতি ছিল ভিন্ন। পূর্ববঙ্গের ক্ষেত্রে সরকার একটি সহজ গোয়েবেলসীয় নীতি অনুসরণ করেছিল: মিথ্যাগুলো বিরক্তিকরভাবে প্রতিদিন প্রেস, রেডিও এবং টেলিভিশনে বারংবার প্রচার করা হতো।৪৮
বসু অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে সমালোচনা করেছে বাঙালি হত্যার ঘটনার পরোক্ষ বিবরণ উপস্থাপন করার জন্য। অথচ যেই ম্যালকম ব্রাউনের ওপর বসু নির্ভর করেছে, সেও সমানভাবে পরলব্ধ: ‘শোনা যায় বিপুলসংখ্যক বিহারিকে হত্যা করা হয়েছে’ এবং ‘সংবাদকর্মীদের কবরগুলো দেখানো হয়, যেখানে ১৫২ জন বিহারিকে কবর দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়’।
১২ মে ১৯৭১ সালের নথিপত্র থেকে দেখা যায় যে, একাধিক পত্রিকা এই সরকারি পরিদর্শন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ভিন্নভাবে প্রকাশিত একমাত্র খবরটি ছিল এপির জন্য করা মোর্ট রোজেনব্লুমের প্রতিবেদন।৪৯ এই প্রতিবেদনে সম্পাদক রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ভ্রমণের কথা উল্লেখ করে এবং লেখে ‘এই প্রত্যক্ষদর্শীর প্রতিবেদনটি ব্যাংকক থেকে পাঠানো হয়েছে, যা পাকিস্তানি সরকারের সেন্সরশিপের বাইরে’। রোজেনব্লুম ‘দৃশ্যমান প্রমাণ এবং সরকারি বর্ণনার বাইরে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার’ ওপর নির্ভর করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিল। সে এই বলে শেষ করে যে ‘সম্ভবত পাঁচ লক্ষেরও বেশি দেহ’ এবং ‘কেউ জানে না কত বাঙালি পরিবারকে সেনাবাহিনী হত্যা করেছে বা কতজন অভিবাসী বিহারি শ্রমিককে বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কুপিয়ে হত্যা করেছে’। তথ্য ধামাচাপা দেওয়ার কথা উল্লেখ করে সে বলে: ‘২৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান থেকে সংবাদকর্মীদের বহিষ্কার করা হয়। এই সময় ৪০ জন সংবাদকর্মীকে একত্র করে তাদের নোট এবং ফিল্ম কেড়ে নেওয়া হয়। এরপর ৬-১১ মে ছয়জন সাংবাদিকের একটি দলকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়।’ রোজেনব্লুম কি অন্য পাঁচজন প্রতিবেদকের চেয়ে অধিক সঠিক চিত্র তুলে ধরেছিল? আমরা এখনো সেটা জানি না, এবং বসুও তা জানে না। কিন্তু সে শুধু নিজের হাইপোথিসিসের সঙ্গে মিল রাখা প্রতিবেদনগুলো বাছাই করেছে।
সংখ্যা ও শব্দের সংযুক্তি
বইটির প্রকাশনা-পরবর্তী প্রচারণায় ফলাও করে বলা হয় যে ডেড রেকনিং ‘মিথকে ভুল প্রমাণিত’ করবে। ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যার দাবি বসুকে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করেছে, যা সে ‘দৈত্যাকার রূপকথা’ শীর্ষক একটি অধ্যায়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করেছে। মৃতের সংখ্যার এই হিসাব যে বেশি হতে পারে, তা ১৯৭২ সালেই বাঙালি গবেষকেরা আলোচনা করেছিল। কিন্তু বসু শেষতক হামুদুর রহমান কমিশনের হিসাবকেই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হিসেবে মেনে নিয়েছে—যেখানে মৃতের সংখ্যা ‘সর্বোচ্চ’ ২৬ হাজার বলে অনুমান করা হয়েছিল। বৈশ্বিক সহমর্মিতা আদায়ের কাজে বাঙালি এবং ভারতীয়রা মৃতের সংখ্যার অতিশায়ন করে থাকতেই পারে, কিন্তু বসু পাকিস্তানি হিসাবকেই আঁকড়ে ধরেছে, এমনকি যেখানে কমিশনের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিল এই হিসাবে ‘ভুল থাকতে পারে, মৃতের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে’ (১৭৮)। মৃতের সংখ্যা ৩০ লাখ বা তার চেয়ে কম হোক, এটা কি অস্বীকার করা যাবে যে জেনোসাইড ঘটেছিল? যে বইতে মৃতের সংখ্যা এবং জেনোসাইড উভয় বিষয়কেই অস্বীকার করা হয়েছে, সেই বইতেই শেষ পৃষ্ঠায় একটি দোষক্ষালন সতর্কীকরণ রয়েছে: ‘পরিশেষে, সংখ্যা বা নামকরণ মূল বিষয় নয়’ (১৮৩)। যদি এগুলো মূল বিষয় না হয়ে থাকে, তবে এগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য এতগুলো পাতা খরচ করা হলো কেন?
বসু দাবি করেছে, সে-ই এই মৃতের সংখ্যাকে ‘প্রথম’ চ্যালেঞ্জ করেছে। কিন্তু আফসান চৌধুরী উল্লেখ করেছে যে সংখ্যা নিয়ে তর্কবিতর্কের কারণে ১৯৭২ সালেই জরিপগুলো শুরু হয়, এবং অবশেষে জিয়ার শাসনামলে এই জরিপগুলোর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমি জেলা পর্যায়ে জরিপ পরিচালনা করে এবং তাদের জরিপে মৃতের সংখ্যা প্রচলিত ধারণার চেয়ে কম পাওয়া যায়।৫০ ১৯৭৪ সালের পর মৃতদেহ কবর থেকে তোলার বিষয়টি আলোচনার বাইরে চলে যায়—এই বিষয়টি বসু বুঝতে পুরোপুরি ভুল করেছে। ফলে সে লিখেছে, ‘প্রথম বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা এবং সহায়তার অনেক প্রস্তাব ছিল (৬৮)।’ এই সময়ে ওআইসির (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন) সমর্থন পাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু যে অসম চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন, বসু তা বিবেচনায় আনেনি। শেখ মুজিব এই চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন, কারণ তখন অর্থনীতির অবস্থা চূড়ান্ত মাত্রায় নাজুক ছিল—ফলে তেল-অর্থের গুরুতর প্রয়োজন ছিল। পরবর্তী সময়ে বসু এটাও উল্লেখ করেছে যে, জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছেন, ফলে তাঁর শাসনামলকে মৃতের সংখ্যা হিসাব করার প্রচেষ্টার সময় হিসেবে দেখা উচিত। কিন্তু এটা জিয়ার শাসনামলের ভুল ব্যাখ্যা। সেই সময়ে লীগের প্রতি বিশ্বস্তদের বাইরে একটি শক্তিকাঠামো তৈরির প্রচেষ্টা ছিল, যা অংশত ১৯৭১-এ অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে জিয়া সরকার সম্পন্ন করে।
১৯৯২ সালে জুনায়েদ কাজী প্রথম দিককার একটি ইন্টারনেট সাইটের জন্য মৃতের সংখ্যা সম্পর্কিত গণমাধ্যমের হিসাবগুলো সংগ্রহ করে।৫১ সংখ্যাগুলো ৩০ লাখ (সর্বোচ্চ) থেকে শুরু করে ২ লাখের (সর্বনিম্ন) মধ্যে ছিল। এই পরিসংখ্যানটি নিয়ে বাংলাদেশ সাইবার-সার্কেলে বিতর্ক হয় (এটা ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রচলনের আগেকার সময়, তাই বিতর্কগুলো প্রধানত soc.culture.bangladesh গ্রুপেই হয়েছিল)। পরবর্তী সময়ে আফসান চৌধুরীর গবেষণাতেও সংখ্যার এই তারতম্য উঠে আসে এবং তাঁর উপসম্পাদকীয়তেও একই কথাগুলো উল্লেখ করা হয়।৫২ এই সবকিছুই বাংলাদেশি ইতিহাস-সম্পর্কিত গণবিতর্কে স্থান করে নিয়েছে। ফলে বসুর বড় দাবি—মৃতের সংখ্যা নিয়ে ভিন্নমত পোষণকারী ‘প্রথম’ হচ্ছে এই বই—একটি অসত্য এবং আত্মপ্রচারকারী দাবি।
কিছু নামকরণ গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত ১৯৭১ সালের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর আইনগত চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিলে। পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি ইতিমধ্যে সম্ভবত হাতছাড়া হয়ে গেছে। এই কাজের জন্য উপযুক্ত সময় ছিল ১৯৭২, কিন্তু সেই সময় এই অফিসাররা পাকিস্তানে বন্দী বাঙালিদের বিনিময়ে দাবার ঘুঁটি হিসেবে কাজ করেছে। ‘বিহারি’ বা ‘আটকে পড়া পাকিস্তানিদের’ প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি এখন মীমাংসিত—তাদের বাংলাদেশে আত্তীকরণের মাধ্যমে, এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়ে আদালতের আদেশের মাধ্যমে (লজ্জাজনকভাবে দেরিতে)। আদালতের এই আদেশে তাদের সম্পূর্ণ ভোটের অধিকার দেওয়া হয়। এখন পাকিস্তানিদের সমর্থনে যেসব বাঙালি যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচার বাকি আছে [প্রবন্ধটি ২০১১ সালে রচিত]। বর্তমান রাজনীতির ওপর এর একটি সরাসরি প্রভাব রয়েছে, কারণ অভিযুক্তদের অনেকে প্রধান ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জামায়াতের প্রধান গোলাম আযম ইতিমধ্যে অবসর গ্রহণ করেছে (সম্ভবত দলের নবীন সদস্যরা তাকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করেছে, যারা ১৯৭১-এর কলঙ্কচিহ্নটি মুছে ফেলতে চায়), কিন্তু দ্বিতীয় সারির নেতারা বর্তমান সরকারের তদন্তের আওতায় আছে।
অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সম্ভাবনা এখনো একটি খুব আবেগঘন বিষয় এবং আওয়ামী লীগ ‘স্মৃতি একাত্তর’-এর ওপর দলীয় দাবি শক্তিশালী করার আশা করে, যা ধারাবাহিকভাবে তাদের সাহায্য করে এসেছে, বিশেষত তরুণ ভোটারদের ক্ষেত্রে। কিন্তু ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের আইনি কাঠামো আরও শক্তিশালী করতে হবে বলে বিশ্লেষকেরা বলেছে।৫৩ জামায়াত ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের ব্যবহারে নিজেদের শক্তি দেখিয়েছে। তারা ইকোনমিস্ট-এর একটি প্রবন্ধকে আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করেছে৫৪, যেখানে আলবদরের প্রধান হিসেবে জামায়াতের মতিউর রহমান নিজামীর নাম উল্লেখ করা হয়। ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’ নামক চ্যানেল ফোর-এর প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির দ্বারা মানহানির মামলায় পরাজিত হয়েছে।
জামায়াতের ব্যবহূত একটি কৌশল হচ্ছে ১৯৭১ সালে সংঘটিত সহিংসতার প্রকৃতির পুনঃসংজ্ঞায়ন করা। ২০০৭ সালে জামায়াতের একজন আইনজীবী টেলিভিশনে ডেথ স্কোয়াড থাকার কথা অস্বীকার করে। সে আরও বলে, যেসব ব্যক্তি পাকিস্তানপন্থী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছিল, তারা বৈধ একক কাঠামোকে রক্ষা করছিল এবং তাদের এই কাজগুলো যুদ্ধাপরাধ ছিল না। যে পরিস্থিতিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিভিন্ন ধরনের আইনি এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, সেখানে ১৯৭১-এ সংঘটিত জেনোসাইডের উপস্থিতি মুছে ফেলার যে চেষ্টা বসু করেছে, তা ঘটনা-নিরপেক্ষ কাজ হতে পারে না।
প্রয়োজনমাফিক পাঠ
যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পর্কে ব্যবহার করা শব্দের তালিকা বসুকে খেপিয়ে তুলেছে। শব্দগুলো হচ্ছে: ‘খানসেনা’, ‘পাঞ্জাবি জারজ’, ‘বর্বর’, ‘মানব জানোয়ার’, ‘হিংস্র হায়েনা’ এবং ‘বাঘ’। বসু কামরুল হাসানের বিখ্যাত পোস্টার ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’-কে উদ্ধৃত করেছে, যেখানে মানুষখেকো হিসেবে ইয়াহিয়া খানের ব্যঙ্গচিত্র ছিল। একই সঙ্গে পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে ব্যবহূত শব্দগুলোকে সে সংযমী বলে উল্লেখ করেছে: ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘মুক্তি’, ‘আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্ত’ ইত্যাদি। সে সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, বাঙালিরা বর্ণবাদী অবমাননায় লিপ্ত হয়েছিল; অন্যদিকে পাকিস্তানি রাষ্ট্র রাজনীতি, আইন এবং শৃঙ্খলার ভাষায় কথা বলেছিল।
বসু যে বিষয়টি হিসাবের মধ্যে আনেনি সেটা হচ্ছে, পাকিস্তানি রাষ্ট্রের শ্বেতপত্র ও দাপ্তরিক নথিগুলোয় স্বল্পসংখ্যক শব্দ নথিভুক্ত থাকার কারণ ছিল বিদ্রোহের মাত্রা এবং জনপ্রিয়তা কম প্রমাণ করা। এটাকে পাকিস্তান যুদ্ধকালীন কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছিল। কম সংখ্যার অর্থ হলো মুক্তিবাহিনী ‘পথভ্রষ্ট’ এবং মোটের ওপর ‘সন্ত্রাসী’। এই কাঠামোতে ‘দুষ্কৃতকারী’ এবং ‘দুর্বৃত্ত’ (১৬২) ভালো খাপ খায়।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সহিংসতা, বর্ণবাদ এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রমাণ খুঁজে বের করা কি খুব কঠিন? আমরা যদি ঢাকা ক্লাবে বাঙালিদের সঙ্গে ভালো সামাজিক সম্পর্কের গল্প থেকে বেরিয়ে আসি, অনেক ম্যাক্রো এবং মাইক্রো সূচক খুঁজে পাব। সাদিয়া তুর ১৯৪৭-পরবর্তী পাকিস্তান৫৫ নিয়ে তার বইয়ে উল্লেখ করেছে যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি এলিটদের আচরণ ক্রমবর্ধমানভাবে বর্ণবাদী হয়ে উঠছিল।৫৬ তুর কথোপকথনে এই মনোভাবের সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরেছে,
অবশ্যই সাংস্কৃতিক কিছু অন্ধবিশ্বাস ছিল। এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে, পূর্ববঙ্গের মুসলমানেরা সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দু সংস্কৃতির খুব বেশি দাসত্ব করত। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিজস্ব জ্ঞানভাষ্য আরও অধিক বর্ণবাদী ছিল। তারা ব্রিটিশদের শেখানো উপমহাদেশের ‘সামরিক গোত্র’ মতাদর্শে বাঙালিদের ‘পৌরুষত্বহীন’ বলে অবজ্ঞা করত। ১৯৭১ সালে সেনা অভিযানের সময় এই বর্ণবাদ সবচেয়ে বেশি প্রকাশ্য রূপ নিয়েছিল। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে বর্ণবাদ গড়ে উঠেছিল যে, বাঙালিরা যেহেতু একটি নিচ জাত, তাই তাদের জিন-পুল অবশ্যই শোধরাতে হবে এবং এর জন্য তারা বাঙালি নারীদের জোরপূর্বক গর্ভবতী করার পথ বেছে নেয়। ’৭০’র দশকের পর থেকেই বিশ্লেষকেরা এটি নিয়ে কথা বলা শুরু করেন। তাঁদের মতে, পশ্চিম পাকিস্তানে সেনাবাহিনী এবং উদারবাদী সমাজের উচ্চবিত্তদের একটি নির্দিষ্ট অংশের মধ্যে এই আচরণ পরিপক্ব হতে থাকে।৫৭
তারিক আলী এই বিষয়টির ওপর মন্তব্য করেছে,
সৈনিকদের বলা হয়েছিল যে, বাঙালিরা একটি নিচু জাত; খাটো, কালো, দুর্বল (সামরিক পাঞ্জাব জাতের মতো নয়) এবং তারা হিন্দুত্ববাদের দ্বারাও আক্রান্ত। জুনিয়র এবং সিনিয়র উভয় ধরনের অফিসারই অভিযানের সময় বাঙালিদের জিন শোধরাতে চাওয়ার কথা বলেছে। এই ধরনের ফ্যাসিস্ট কথাবার্তা বাঙালি নারীদের গণধর্ষণের সবুজসংকেত হিসেবে কাজ করেছে এবং এই ক্ষেত্রে শ্রেণি বা ধর্মবিশ্বাস বিবেচনা করা হয়নি।৫৮
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস একই ভাবে পূর্ব পাকিস্তানিদের ‘অর্ধ মুসলমান’৫৯ এবং ‘কাফের’ এবং বাঙালি হিন্দুদের ‘অনির্ভরযোগ্য, অবাঞ্ছিত বহিরাগত’৬০ বিবেচনার সমীকরণ নথিভুক্ত করেছে। কুমিল্লাতে এক পাঞ্জাবি কর্মকর্তা মাসকারেনহাসকে বলে, ‘হায় আল্লাহ, এ রকম সুন্দর জমি দিয়ে আমরা কত কিছুই না করতে পারতাম... কিন্তু বেশি দিন এখানে থাকলে আমরা ওদের মতো হয়ে যেতাম।’৬১
উপাখ্যানগুলোর চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অবকাঠামো। পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটির সুপারিশ এবং ডন পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাঙালিদের নিম্নতর নাগরিক হিসেবে দেখা হতো। এই ইতিহাস বসু এড়িয়ে গেলেও, তুর তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছে। পাকিস্তান সরকারের জাতীয় ভাষানীতি থেকে এই ইতিহাস শুরু হয়—এই নীতির যেকোনো বিরোধিতাকারীকে জিন্নাহ ‘পাকিস্তানের শত্রু’ আখ্যা দেয়।৬২ ১৯৫২-পরবর্তী সময়ে বাংলা স্বীকৃতি পায়, তবে তা এই শর্তে যে ‘সংস্কৃত ভাষার শব্দ ব্যবহারের নিরর্থক প্রবণতাকে’৬৩ নিরুত্সাহিত করার জন্য এই ভাষাকে ‘পুনর্গঠন’৬৪ করা হবে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তানের গণমাধ্যমে উঠে আসে ধর্মীয় শ্লেষ এবং বহিরাগত শক্তির গুজব নিয়ে। প্রতিবেদনগুলোতে ‘অমুসলিম বিদেশি’৬৫ ‘যারা ভিন্ন পোশাক পরে’৬৬ এবং ‘হিন্দুরা উর্দুবিরোধী রচনা বিতরণ করছে’৬৭ বলে অভিযোগ করা হয়। এই ঘটনাকে মুসলিম লিগ ‘হিন্দুদের চক্রান্ত’৬৮ হিসেবে উল্লেখ করে। ১৯৫২ সালের বিপদ কেটে যাওয়ার পর দমনের কাঠামো আরও পাকাপোক্ত হয়, যা বাঙালিদের প্রতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে অবাঙালি সদস্যদের মানহানিকর আচরণের মাধ্যমে বর্ধিত রূপ ধারণ করে।৬৯ বসুর বইয়ের কমতি সম্পর্কে তুরের মত হচ্ছে, ‘ক্রমাগত এই মাত্রায় তথ্য এড়িয়ে যাওয়াকে ভুল বা অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি হিসেবে বিবেচনা করা যায় না’।৭০
পাকিস্তান আমলের মানহানিকর ভাষা বসুর বইয়ের মধ্যেও ঢুকে গেছে। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ব্যবহূত প্রাণিবাচক বিশেষণগুলো সম্পর্কে সে নিন্দা করলেও বাঙালিদের সম্পর্কে একই রকম দুটি বর্ণনা দিয়ে তার বইটি শুরু হয়েছে: ‘মৌমাছির ঝাঁকের মতো’ (মেজর জেনারেল হাকিম কোরেশি, পাকিস্তান সেনাবাহিনী) এবং ‘ভোমরের ঝাঁক’ [আর্চার ব্লাড (৮)]। সে আরও উল্লেখ করে যে নীরদ চৌধুরী বাঙালির ‘আত্মকরুণার’ (২১) কথা বলেছে, এবং জি ডব্লিউ চৌধুরী বলেছে যে ‘কঠোর পরিশ্রম এবং গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের চেয়ে বাঙালিরা নেতিবাচক এবং ধ্বংসাত্মক মনোভাবের অধিকারী হিসেবে পরিচিত’ (২১)।
এই জাতিগত ভাষা দাঁড় করানোর পর, বসু বাঙালিদের ১৯৭১ সম্পর্কিত বয়ানকে ‘তথ্যগত যথার্থতা বা বিশ্লেষণগত জটিলতার ব্যাপারে অমনোযোগী’ (৫), ‘একরোখা ঘৃণা এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ’ (৮), ‘নাটকীয় ভাষা এবং বর্ণনা’ (৪৬), ‘কিছুটা অতিনাটকীয় ভঙ্গিতে ভাষার ফুলঝুরি’ (১৪০) এবং ‘নির্বোধ মিথ্যা বর্ণনা’ (১৬৩) হিসেবে উল্লেখ করেছে। সর্বোপরি, একজন বাঙালি একজন ভালো ‘আড্ডাবাজ’ (৭৪)—বসুর কাছে সে উচ্ছ্বসিত গল্পকার, কিন্তু ইতিহাসের উত্স হিসেবে নির্ভরযোগ্য নয়।
বাঙালি লাইন-সর্দার হারুনের ঘটনাটি বিবেচনা করা যাক। তাকে বিহারি ডেথ স্কোয়াড ধরে ফেলে এবং বয়লারে নিক্ষেপ করে। এই ঘটনাকে বসু বাঙালিবিরোধী সহিংসতা হিসেবে বিবেচনা করেনি, বরং এটা বাঙালিদের কাপুরুষতার প্রমাণ: ‘ঘরভর্তি বাঙালিরা বসে বসে তা দেখল, একজনও অসহায় হারুনকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল না’ (৮৩)। একটি ‘ছোট’ বিহারি ডেথ স্কোয়াডের বিরুদ্ধে বাঙালিদের নিষ্ক্রিয়তা আসলে এটাই প্রকাশ করে যে, এসব সংগঠনের পেছনে সেনাবাহিনীর সমর্থন ছিল ভয়াবহ—কিন্তু বসু সে দিকটা ধরতে পারেনি।
যুদ্ধরত বাঙালিদের সে অযৌক্তিক কাজে ব্যস্ত বলে বিচার করেছে। যেমন জাহানারা ইমামের ছেলে রুমীর মৃত্যুকে সে ঠান্ডা মেজাজে মূল্যায়ন করেছে। রুমীর সাহসী অভিযানগুলোকে বাতিল করেছে এই বলে যে, এগুলো ‘নিছক শিশুসুলভতা এবং শৌখিন আচরণ’। পরবর্তী সময়ে আরও প্রশ্ন করেছে ‘এই “অ্যাকশন” বাংলাদেশের স্বাধীনতায় কীভাবে অবদান রেখেছে?’ (১৩৫)। “অ্যাকশন” শব্দটিতে উদ্ধৃতি চিহ্নের ব্যবহার আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে, গোটা বইটিতে যে বিষয়গুলোকে বসু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখেছে, সেগুলো উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে; এই বিষয়ে আরেক দিন আলোচনা করব। বসু দুই দিক থেকে সুবিধা নিয়েছে—রুমীর স্বল্পস্থায়ী অভিযানগুলোকে ‘শিশুসুলভ’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাজের সঙ্গে এগুলোর তুলনা করেছে: ‘তার মতো “শত্রু যোদ্ধাদের” (বসু এখানে ৯/১১ পরবর্তী মার্কিন শব্দ ‘এনিমি কমব্যাট্যান্ট’ ব্যবহার করেছে) হত্যা করাকে সঠিক মনে করলে অন্য পক্ষের কি সমালোচনা করা যায়? এই যোদ্ধারা তো তাদের দেশকে বিভক্ত করতে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল (১৩৬)।’ রুমীদের দলটিকে গ্রেপ্তার করার ঘটনাটি সামরিক পদক্ষেপের ন্যায্যতা প্রমাণের হাতিয়ার হয়ে যায়: ‘যারা এসব কাজের সঙ্গে সত্যিকার অর্থে যুক্ত নয়, এ রকম কাউকে তারা আটকে রেখেছিল বলে মনে হয় না (১৩৭)।’
সংঘর্ষের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে
১৯৭০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী আলাপ-আলোচনা থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মার্চে সামরিক অভিযান পর্যন্ত ঘটনা অনেকভাবেই আবছা রয়ে গেছে। কারণ, অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। অনেক সাংঘর্ষিক প্রবণতাসহ ক্রমবর্ধমানভাবে হতাশ বাঙালি জনগণ, এবং গোটা পাকিস্তানের নেতা হওয়ার নির্বাচনী ম্যান্ডেট—এই দুই প্রবণতার মাঝে থেকে বঙ্গবন্ধু কীভাবে নেতৃত্বের ভারসাম্য বজায় রেখেছিলেন? লীগের মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব এবং চরমপন্থী ছাত্রনেতাদের (যারা শিক্ষাঙ্গনে বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিল) মধ্যে বিরোধগুলো কী ছিল? ঠিক কোন মুহূর্তে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ল? এই সবকিছুই কিছুটা ঝাপসা, কারণ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক বাঙালি নেতাকেই সত্তরের দশকে হত্যা করা হয়।
এই জটিল ঘটনাগুলোর প্রতি বসু সম্পূর্ণভাবে অনীহা দেখিয়েছে, কারণ সে শুধুই যুদ্ধের ক্ষতির হিসাব করতে উদ্গ্রীব ছিল। ১৯৭০ সালের ভয়ানক ঘূর্ণিঝড় এবং বিশৃঙ্খল ত্রাণ ব্যবস্থা—বসু তাকে শুধু ‘ভয়াবহ বন্যা’ (১৯) এবং অলস বাঙালিদের দোষ হিসেবে বর্ণনা করেছে। প্রকৃতপক্ষে ত্রাণ বিতরণ, এবং দুর্যোগকবলিত অঞ্চল পরিদর্শনে ইয়াহিয়ার বিলম্ব, বঙ্গবন্ধুর জন্য নির্বাচনী প্রচারণার হাতিয়ারে পরিণত হয়। সোনার বাংলা শ্মশান কেন পোস্টারের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের বিকারহীনতার চিত্র ফুটে ওঠে। ফলে ত্রাণ বিতরণ প্রচেষ্টার বিশৃঙ্খলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে কাজ করে। বসু এই গোটা বিষয়টি এড়িয়ে যায়। এর পরিবর্তে সে শুধু লেফটেন্যান্ট জেনারেল (লেফটেন্যান্ট) গোলাম মোস্তাফার ত্রাণ বিতরণের স্মৃতির কথা উল্লেখ করেছে: ‘আমরা কাজ করেছি, আর বাঙালিরা দাঁড়িয়ে দেখছিল এবং অভিযোগ করছিল যে, কিছুই করা হয়নি।’
দুই পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক অসমতার বিষয়টি বাঙালি এবং আমেরিকান অর্থনীতিবিদেরা বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন। কিন্তু বসুর মতে, এগুলো ‘শুধুই পরিসংখ্যান যা ‘অসমতা’ তুলে ধরে, কিন্তু তার অর্থ ‘বৈষম্য’ নয়’ (২০)। কিন্তু এসব বিশ্লেষণে শুধু অসমতাকেই চিহ্নিত করা হয়নি, বরং পূর্ব পাকিস্তানে উত্পাদিত রাজস্ব কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে চালান হচ্ছিল, তা-ও সুনির্দিষ্টভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্ব আয়ের অন্যতম বড় খাত ছিল পাট রপ্তানি। যেহেতু এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর সবকিছু পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত ছিল, তাই যেকোনো রাজস্ব আয় প্রথমে পশ্চিম পাকিস্তানে যেত, তারপর সেখান থেকে তার অংশবিশেষ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ হতো। ওই সময় ‘পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার’ শিরোনামের একটি ছক গবেষক মহল এবং রাজনৈতিক পরিসরে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। ১৯৫৬ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রেহমান সোবহান,৭১ আখলাকুর রহমান,৭২ এ আর খান,৭৩ নুরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান এবং অন্যদের৭৪ অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট দেখানো হয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদের স্থানান্তরের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন ধারাবাহিকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল।
বসু খুব সাধারণভাবে উল্লেখ করেছে যে, ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান যেহেতু বেশ দরিদ্র অবস্থায় যাত্রা শুরু করেছিল, তাই অসমতা ‘এক রাতেই দূর করা সম্ভব ছিল না’ (২০)। তবে অর্থনীতির তত্ত্ব অনুসারে অন্য সব চালক স্থির থাকলে, এবং সরকারের স্বতঃপ্রণোদিত ব্যর্থতা না থাকলে, একটি সুসংহত অর্থনীতিতে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র অঞ্চল তুলনামূলক ধনী অঞ্চলের চেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। অর্থাত্ অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য, অধিকতর দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। একই নিয়মেই তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। বসু ইচ্ছাকৃতভাবেই বিদ্যমান সব অর্থনৈতিক বিশ্লেষণকে অগ্রাহ্য করেছে। এমনকি ইয়াহিয়া খানও ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকে স্বীকার করেছিল যে, অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষোভগুলো যুক্তিযুক্ত ছিল (এই বৈঠকে বৈদেশিক এবং প্রতিরক্ষা নীতি নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে বিবাদের বিষয়ে পরিণত হয়)। রেহমান সোবহানের মতে,
ষাটের দশকের প্রথম থেকেই পাকিস্তানিরা স্বীকার করা শুরু করে যে, পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কিত নীতিমালা এবং সম্পদের বণ্টনে বৈষম্য ছিল। মাহবুবুল আলম তাঁর স্ট্র্যাটেজি ফর ইকোনমিক প্ল্যানিং শীর্ষক বইতে এই বিষয়টি বেশ যুক্তিসহকারে তুলে ধরে। এই বিষয়ে প্রচুর রচনা রয়েছে এবং এগুলো স্পষ্টতই শর্মিলা বসু পড়েনি।৭৫
সামরিক বাহিনীকে ব্যবহারের ব্যাপারে বসু বলে, ‘ইয়াহিয়া খান এটা করতে অসম্মতি প্রকাশ করে (২০)।’ কিন্তু এই বাক্য নির্বাচন-পরবর্তী ক্ষমতার সমীকরণের একেবারেই ভুল ব্যাখ্যা। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সামরিক বাহিনী দাবি করে যে, তারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার হস্তান্তর চেয়েছিল, এবং যুদ্ধের জন্য শুধু রাজনীতিবিদেরা দায়ী। বসু এই দাবি মেনে নেয়, যদিও বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল ছিল। অভূতপূর্ব একটি সর্ব-পাকিস্তান অভ্যুত্থানের ফলে আইয়ুব খানের কাছ থেকে ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। এই অভ্যুত্থানের তিনটি চিহ্নিত শত্রু ছিল: ভূস্বামী এলিট, ব্যবসায়ী শ্রেণি (প্রায় সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি), এবং সামরিক বাহিনী। বরাবরের মতোই, নিজেদের বাঁচানোর জন্য সামরিক বাহিনী আইয়ুবকে বলি দেয়। ইয়াহিয়ার মূল দায়িত্ব ছিল বেসামরিক রাজনীতিবিদদের কাছে ক্ষমতার হস্তান্তর এবং একই সঙ্গে প্রধান ক্ষমতার ক্ষেত্রগুলোতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বজায় রাখা (এটি বর্তমানের ‘জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের’ একটি পূূর্বরূপ)।
নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, এই নিয়ে সেনাবাহিনীর মনোভাবের বিষয়ে ডেড রেকনিং-এ কোনো আলোচনা নেই। স্থানীয় গোয়েন্দাদের (বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানে) ভুল তথ্যের দ্বারা পথভ্রষ্ট হয়ে, বা পাকিস্তানের রাজনৈতিক শ্রেণির বিবাদময় অতীত দ্বারা অতি-আশ্বস্ত হয়ে, সামরিক বাহিনী ভেবেছিল যে নির্বাচনের ফলাফল একটি ‘ঝুলন্ত সংসদ’ হবে। যেখানে কোনো দলই একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। ফলে সেনাবাহিনী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এবং মধ্যস্থতাকারী হবে। ইয়াহিয়া আশা করেছিল যে নির্বাচনের পর সে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাবে। ফলে শেষতক সে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবে এবং সেনাবাহিনীর ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করবে।
বসু ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের দিকে তাকায়নি এবং নির্বাচন থেকে মাওলানা ভাসানীর প্রত্যাহার বিষয়ে শুধু একটি বাক্য ব্যয় করেছে (২১)। কিন্তু এই দুটি ঘটনা নির্বাচন-পূর্ববর্তী অনেক হিসাব-নিকাশ তছনছ করে দিয়েছিল। ১৯৫৭ সালেই ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের পৃথক হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করে পশ্চিম পাকিস্তানকে বলেছিলেন ‘আসসালামু আলাইকুম’৭৬। কিন্তু তাঁর বিরোধীদের (এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধকালীন আওয়ামী নেতৃত্ব এবং ৭১-পরবর্তী লীগ) সফলতার ঢেউয়ে তিনি শেষতক অনেক পিছিয়ে পড়েছিলেন। নির্বাচন থেকে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার মাধ্যমে ভাসানী প্রতীকী মূল্য অর্জন করার আশা করলেও এর ফলাফল ছিল একেবারে বিপরীত। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় ভাসানীর দল এবং অন্য শরিক বাম গোষ্ঠীগুলো পরবর্তী আলোচনার সময় অংশ নিতে পারেনি (এবং যুদ্ধকালীন সরকারেও তাদের অংশগ্রহণ ব্যাপক ছিল না)।
নির্বাচনের ফলাফল এক আচমকা তুফান তৈরি করেছিল—যার ফলে তৈরি হয় একাধিক রণকৌশল, কৃত্রিম আক্রমণ, গলদ হিসাব এবং চক্রান্ত। স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ নির্ধারণী এই দিনগুলোর কোনো বিশ্লেষণ বসু করেনি। বরং ভুল মন্তব্য করেছে, ‘পরবর্তী তিন মাসে অনেক উত্থান-পতন থাকলেও শেষতক আশাবাদ বজায় ছিল।’ এই বইতে সামরিক অভিযান-পূর্ববর্তী সময়ের ঘটনাপ্রবাহ একেবারেই উঠে আসেনি। যদিও সেই ঘটনাপ্রবাহ আওয়ামী লীগের ‘একগুঁয়েমি’ (বসুর ভাষায়), বিহারিবিরোধী সহিংসতা এবং রাজপথের বিশৃঙ্খলা বুঝতে সাহায্য করে। বসু সেই সময়ের উত্তপ্ত রাজনীতির নিন্দা করেছে এবং এর মাধ্যমে সামরিক অভিযানের বৈধতা দিয়েছে:
যদি ২৫ মার্চ একটি রাজনৈতিক সমস্যার সামরিক সমাধান চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নৈতিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে ভুল হয়ে থাকে, তবে এর পূর্ববর্তী সপ্তাহগুলোতে শাসনের দায়দায়িত্বগুলো প্রত্যাখ্যান করাও কম ভুল ছিল না (৩৪)।
২৫ মার্চ পূর্ববর্তী আলাপ-আলোচনার ঘটনাপঞ্জি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এগুলো কি নিতান্তই অস্বচ্ছ ছিল? বসু এ রকমটাই মনে করে, ফলে সে বলে, ‘তারা কেন ব্যর্থ হলো, তার চূড়ান্ত বিশ্লেষণ শুধু ভবিষ্যত্ বিশেষজ্ঞরাই করতে পারবে’ (২২)। কিন্তু সে বইয়ের পরিশিষ্টের শুরুতে প্রথমেই উদ্ধৃত করেছে সিসন এবং রোজ-এর ওয়ার অ্যান্ড সেসেশন ৭৭ বইটি। তার মতে, এটি হচ্ছে ১৯৭১ সালের সংঘর্ষের ওপর লিখিত একমাত্র বিস্তৃত এবং পদ্ধতিগতভাবে গবেষণানির্ভর বই (১৮৬)। বইটিতে কিছু পক্ষপাতিত্ব থাকলেও (বইতে ৩৩ জন পাকিস্তানি, ৪৯ জন ভারতীয়, ৩৯ জন আমেরিকান এবং ১২ জন বাংলাদেশির সাক্ষাত্কার নেওয়া হয়েছে), সিসন ও রোজের বইটি সংঘর্ষের ওপর লিখিত একটি ভালো বই। কিন্তু বসু এই বইকে দিকনির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করে থাকলেও সে বোধ হয় অধ্যায় ৪, ৫ ও ৬ পড়তে বা বুঝতে ভুলে গেছে (সিসন ও রোজ, ৫৪ থেকে ১৩৪ পৃষ্ঠা)। বইটির এই অধ্যায়গুলোতে সমঝোতার বিস্তৃত সূক্ষ্ম বিবরণ আছে এবং এই অংশ থেকে ভেতরকার চক্রান্তের কিছু বিষয় আঁচ করা যায়। কিন্তু ডেড রেকনিং-এ সিসন ও রোজের বই শুধু দুটি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমত, একে অপরের মুখ দেখাদেখি করতে অস্বীকার করা মুজিব ও ভুট্টো সম্পর্কে মুখরোচক গল্পের উত্স হিসেবে—তাদের ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ় নবদম্পতি’ আখ্যা দিয়ে ইয়াহিয়া আলোচনায় সেনাবাহিনীকে নিরপেক্ষ এবং সংবেদনশীল পক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। দ্বিতীয়ত, সিসন ও রোজের বইয়ের দশম অধ্যায়ের ২৪ নম্বর ফুটনোট, যেখানে ১৯৭১ সালে মৃতের সংখ্যা ‘৩ লাখ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ৩ লাখ থেকে কমাতে শুরু করে বসু তার ‘মনস্টরাস ফেবলস’ শিরোনামের অধ্যায়ে ১৯৭১ সালে মৃতের সংখ্যা ২৬ হাজারে নামিয়ে এনেছে।
ভুট্টোর কৌশল
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে চলমান সমঝোতা আলোচনা প্রকৃতপক্ষে বিপুল ক্ষমতার লড়াইয়ের একটি কেস স্টাডি। বানচাল সমঝোতা থেকে ভুট্টোই আইনগত প্রাপ্তির চেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল—একাত্তর-পরবর্তী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অপ্রত্যাশিতভাবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, যা আলোচনার সময় তাদের জন্য সম্পদ এবং একই সঙ্গে দায়ে পরিণত হয় (সামরিক বাহিনী লীগের ওপর বিশ্বাস রাখতে নারাজ ছিল, কারণ তারা ভয় পেত এই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সামরিক বাজেট হ্রাস করাসহ যেকোনো আইন প্রণয়নের জন্য ব্যবহার করা হবে)। ভুট্টো চালাকি করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) অর্জিত ক্ষুদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে শেখ মুজিব এবং লীগের সঙ্গে সমকক্ষ হিসেবে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। পাঁচ বছর আগে ভুট্টো আইয়ুব শাসনের আসন্ন পতন আঁচ করতে পেরেছিল। ফলে সে ১৯৬৬ সালে দ্রুত সামরিক মন্ত্রিসভা ত্যাগ করে বিদ্রোহী পিপিপি পার্টি গঠন করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ভিন্নমতাবলম্বী মনোভাবকে কবজা করে। ভুট্টোর জমিদারি পরিবার এবং সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করলে তার এই নতুন রাজনৈতিক পোশাক অদ্ভুত মনে হবে। একইভাবে ১৯৭১ সালে সামগ্রিক অবস্থা যে বেশ ভঙ্গুর, ভুট্টো তা দ্রুত বুঝতে পেরেছিল। পাকিস্তানের ভেতর তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল অল্প এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে তার দলের অনেক সদস্যই অন্য দলে গিয়ে ভিড়ত। ফলে মুজিব সরকারের বিরোধী দল হিসেবে সংসদে আসন গ্রহণ করলে পিপিপি অবশ্যই চুপসে যেত। ভুট্টো আরও বুঝতে পেরেছিল যে, একটি ঐক্যবদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানি অবস্থানের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেও অনেকেই হয়তো শিগগিরই ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ জোট ত্যাগ করত—সামরিক বাহিনীর ওপর ভুট্টোর নিয়ন্ত্রণ স্পষ্ট হওয়ার পর, মার্চের শেষ দিকে কয়েকটি দল এ রকমই করেছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারির এক বক্তব্যে৭৮ ভুট্টো লীগের সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের সাবধান করে দেয় যে ‘পা ভেঙে ফেলব’ এবং ‘তোমরা বিশ্বাসঘাতক হবে’।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ‘নিরপেক্ষ’ আলোচনার সময় সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ভুট্টোর বিশেষ যোগাযোগ ছিল। সিসন ও রোজ লারকানাতে ভুট্টোর পারিবারিক জমিদারি বাড়িতে ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার ব্যক্তিগত আলোচনার কথা বর্ণনা করেছে। এই আলোচনায় ভুট্টো মুজিবকে ‘চালাক বেজন্মা’ ডাকে এবং আরও বলে, মুজিবকে ‘সত্যিই বিশ্বাস করা যায় না’, কারণ সে জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে ‘জোর করে’ সংবিধান পাস করাতে চাইছে। পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক প্রকৃতি সম্পর্কে সেনাবাহিনীর বিশ্বাসকেও ভুট্টো কাজে লাগিয়ে প্রশ্ন করে, শেখ মুজিব ‘সত্যিকার পাকিস্তানি’ কি না।৭৯ ভুট্টোর প্রভাবে ইয়াহিয়া পরে বলে যে ‘এই “বেজন্মাকে” শিক্ষা দিতে হবে’ এবং তার ‘আনুগত্য পরীক্ষার প্রয়োজন’।৮০ সেনাবাহিনীর ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ এবং কাশ্মীর বিষয়ে তাদের অবস্থানও বেশ নমনীয়। বিভিন্ন ধরনের ভয়কে কাজে লাগিয়ে ভুট্টো আওয়ামী লীগ সম্পর্কে সেনাবাহিনীর বদ্ধমূল ধারণাকে আরও উত্তেজিত করে।
আওয়ামী লীগের একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, ফলে কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়াই তাদের ক্ষমতা গ্রহণের আইনি অধিকার ছিল। তাদের মনস্তত্ত্ব সম্ভবত ১৯৭১ সালের ইতিহাস সম্পর্কে বেনজির ভুট্টোর ভুল বর্ণনা প্রসঙ্গে সালমান রুশদির মন্তব্যের সদৃশ ছিল: ‘বেনজিরকে কোনো কিছু ব্যাখ্যা করার জন্য খুব সহজ শব্দ ব্যবহার করা দরকার। শোন মা, লোকটি জিতেছিল, কিন্তু তোমার বাবাই গোঁয়ার্তুমি করছিল...।’৮১ তবে আইনসম্মত হওয়াই রাজনীতির শেষ কথা নয়। শেখ মুজিব সেনাবাহিনীকে আশ্বস্ত এবং ভুট্টোকে একঘরে করতে পারেননি। সরকারি দলের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে রাওয়ালপিন্ডি যাওয়ার অনুরোধ ফিরিয়ে দেওয়া, আলোচনার সময় নতুন অর্জিত স্বাধীনতাস্পৃহা প্রকাশ করা, আলোচনায় অংশগ্রহণের সময় গাড়িতে কালো পতাকা ব্যবহার করা এবং ভুট্টোর ঢাকা সফরের সময় তাকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করতে দেওয়া—এই সব ঘটনার ফলে ইতিমধ্যে ভীত সেনাবাহিনী আরও ভয় পেয়ে যায়। লীগ সঠিকভাবেই সন্দেহ করেছিল যে ভুট্টো সেনাবাহিনীর ‘ছদ্ম ঘোড়া’ এবং নতুন মন্ত্রিসভায় ভুট্টোকে জায়গা দিলে কিছুতেই তাকে বিশ্বাস করা যাবে না। তবে তাকে মন্ত্রিসভায় আমন্ত্রণ জানানোর পর আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করার পরে শেষতক মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার করা একটি পালাক্রমে কৌশল হতে পারত। লীগ এই ধরনের চাতুরী ব্যবহার করতে না পারলেও সমঝোতার সকল পর্যায়ে ভুট্টো এ রকম নানা ম্যাকিয়াভেলীয় কৌশল অনুসরণ করেছিল। ওদিকে আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই স্পষ্টভাবে ছয় দফার পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবি করে আসছিল।
এই সময় আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ বোধ হয় সামর্থ্যমতো সবকিছুই করেছিল। তবে একই সময়ে ভুট্টোর লোক দেখানো আলোচনা এবং সামরিক বাহিনীর শক্তি জোরদার করার মাধ্যমে সবার কাছে দৃশ্যমান হচ্ছিল যে রক্তপাত অবশ্যম্ভাবী। তারপরও ২০ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ইংরেজি ভাষায় মতামত প্রদানের প্রধান মাধ্যম দ্য ফোরাম-এ ‘অপশনস ফর অ্যা সেইন ম্যান’ (সুবিবেচক ব্যক্তির জন্য পথগুলো) শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় ছাপানো হয়। এই সম্পাদকীয়তে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা আবারও বলা হয়:
জনগণ পাকিস্তান কামনা করুক বা না করুক, সঙিন মুহূর্তে এটা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হোক, এটা অবশ্যই চান না... হাতে গোনা কয়েকজন দস্যু, যারা জাতিকে ২৩ বছর ধরে শোষণ করেছে, তাদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কি ইয়াহিয়া সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বিরুদ্ধে গণহত্যা শুরু করবে?...এই অবস্থায় জাতির রাজনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য ইয়াহিয়া যা করতে পারে তা হলো: প্রকাশ্যে শক্তি ব্যবহার পরিত্যাগ করা, ১ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত জড়ো করা সেনা ইউনিটগুলোকে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাহার করে নেওয়া এবং বাকিদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া।৮২
১৯৭১-এর অন্ধ গলি
বসু যদি জেনোসাইডের অভিযোগ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মুক্ত করার ব্যাপারে এতটা মনোনিবেশ না করত, তবে ১৯৭১ সালের ইতিহাসের জটিলতার রহস্যভেদ সে করতে পারত। তার বইটা হয়তো প্রচলিত বয়ানকে একটা দরকারি ঝাঁকুনি দিতে পারত। তা না করে সে এই সরল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, বাংলাদেশে একাত্তর-পরবর্তী সহিংস দশকটি ছিল একাত্তর দ্বারা প্ররোচিত সহিংস সংস্কৃতির (১৪) একটি সরাসরি প্রতিক্রিয়া। কিন্তু বিশৃঙ্খল সত্তরের দশকের ভেতরের বাস্তবতা আরও অনেক বেশি জটিল এবং বৈচিত্র্যময়।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর মধ্য একটি হচ্ছে সর্বব্যাপী শক্তি হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণাটি। ১৯৭১-এর মুক্তিসংগ্রামের রোমান্টিক বর্ণনায় বাঙালি হিন্দুরা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এটাই সত্যি যে আওয়ামী লীগসহ রাজনৈতিকভাবে অন্য প্রধান দলগুলোকে বাঙালি মুসলমানরাই নিয়ন্ত্রণ করত। ধীরগতিতে হলেও ধারাবাহিকভাবে দেশে হিন্দু জনসংখ্যার হ্রাস এই বিষয়টি তুলে ধরছে। এই ধারা আরও উসকে দিয়েছে একাত্তর-পরবর্তী ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’, যা ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় প্রণীত সাম্প্রদায়িক ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’-এর উত্তরসূরি। একের পর এক সরকার, এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা এই আইন ব্যবহার করে আদালতের নির্দেশ, ঘুষ এবং জোরপূর্বক হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করেছে।৮৩ যদিও সম্প্রতি এই আইন বাতিল করা হয়েছে, তবে ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিকভাবে হিন্দু জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে পিছিয়ে পড়েছে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে নিহিত আরেকটি বিষবৃক্ষ হচ্ছে এর কর্তৃত্ব মনোভাব, যেখানে অবাঙালিদের কোনো স্থান নেই, তা সে বিহারি, সমতলের আদিবাসী বা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম (পাহাড়ি) যে-ই হোক না কেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যখন সংবিধান প্রণয়ন শুরু হয়, তখনই এই সমস্যা সামনে চলে আসে। সংসদে দাঁড়িয়ে নতুন সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেছিল সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র লারমা। সংবিধানে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে শুধু বাঙালিদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল এবং লারমা এর প্রতিবাদ করে। লারমা ঘোষণা করে, ‘আপনি আপনার জাতীয় পরিচয় অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। আমি একজন চাকমা, বাঙালি নই। আমি বাংলাদেশের একজন নাগরিক, বাংলাদেশি। আপনারাও বাংলাদেশি কিন্তু আপনার জাতীয় পরিচয় হচ্ছে আপনি বাঙালি... পাহাড়ি মানুষরা কখনো বাঙালি হতে পারবে না।’৮৪ পার্বত্য চট্টগ্রামের দুঃখজনক ইতিহাসের সঙ্গে ১৯৭১ সালের ঘটনাগুলোর সাদৃশ্য রয়েছে: স্বায়ত্তশাসনের জন্য ২০ বছর স্থায়ী একটি গেরিলাযুদ্ধ, বাঙালি সেটেলারদের দ্বারা ধীরগতির জাতিগত উত্খাত এবং পরিশেষে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পর দুই দশকের ব্যর্থতা। একজন পাহাড়ির চোখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বাঙালি সেটেলারদের দমনমূলক শক্তিপ্রয়োগ এবং ১৯৭১-এর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং সশস্ত্র বিহারিদের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হবে।
১৯৭১-এর যুদ্ধ থেকে জন্ম নেওয়া আরেকটি অমীমাংসিত বিষয় হচ্ছে নেতৃত্বের স্থিতিশীলতা। রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অনন্যসাধারণ প্রতিভার কারণেই আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তুমুল বিজয় অর্জন করে। শেখ মুজিব জনসাধারণের মনকাড়া বক্তৃতা দিতে পারতেন, বিশেষ করে গ্রামে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, আন্দোলনে চিড় ধরা শুরু করে। সবার প্রথমে খন্দকার মোশতাক আমেরিকানদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে (এই মোশতাকই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর মসৃণভাবে বেসামরিক নেতৃত্বে আরোহণ করে)। চরম বামপন্থীরা লীগের যুদ্ধকালীন নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, যদিও ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে কোনো কোনো বাম বিশ্লেষক ‘দুটি বুর্জোয়া শক্তির মধ্যে লড়াই হিসেবে’ চিহ্নিত করে। যুদ্ধের সময় ভাসানীর জনবিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পায়। ভারতীয় নেতৃত্ব তাঁকে কড়া নজরদারিতে রাখে এবং একপর্যায়ে তাঁকে আধা-গৃহবন্দী করা হয়।
এতসব স্ববিরোধী উপধারার পথ ধরে ১৯৭১ সালের পর খুব দ্রুত বাম দলগুলো লীগের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। নতুন দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে লীগের ছাত্রসংগঠন কমিউনিস্ট-সমর্থিত ছাত্র ইউনিয়নের কাছে হেরে যায়। জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) কাছ থেকে জোরালো চ্যালেঞ্জ আসে। যেসব মানুষ আরও শক্ত বাম বিকল্পের জন্য আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেছিল, এই জোটে তারাও ঢোকে। যখন জেএসডিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছিল, তখন ইতিমধ্যে শক্তি অর্জন করতে থাকে মাওবাদীরা (ইন্দিরা গান্ধী ভয় পেত যে, এরা পশ্চিম বাংলার নকশালবাদীদের সঙ্গে আন্তসীমান্ত জোট গড়ে তুলতে পারে)। বিভিন্ন গোত্র গোপনে সর্বহারা পার্টি নামে সংঘবদ্ধ হয়। তাদের নাশকতা, নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে গুপ্তহত্যা, বোমা ফাটানো এবং ১৯৭৪ সালে সফল জাতীয় হরতাল (এটি ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর জাতীয় হরতালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়) পালনের ফলে সরকার খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। পুলিশি হেফাজতে সর্বহারা পার্টির নেতার মৃত্যু সরকারকে দুর্বল করে দেয়। ওদিকে চতুর নিন্দুকদের চাপে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বস্ত তাজউদ্দীনের দূরত্ব তৈরি হয়। শেষমেশ ১৯৭৫ সালে নিজের জীবন দিয়ে তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্য প্রমাণ করে। কিন্তু তখন বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে।
১৯৭১ সাল থেকে আরেকটি অমীমাংসিত বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যকার এবং সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের মধ্যে টানাপোড়েন। পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা অফিসার (যারা পাকিস্তানে জেলে বন্দী ছিল) এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া অফিসারদের মধ্যে প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব ছিল। সেনাবাহিনীর মধ্যে বামপন্থী অংশও ছিল; একই সঙ্গে ভারতবিরোধী, ইসলামপন্থী এবং অন্যান্য পরস্পর সম্পর্কিত এবং বিরোধী ধারার একটি সংমিশ্রণও ছিল। অনানুষ্ঠানিক গেরিলাদের একটি গোষ্ঠীও ছিল, যাদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল। এদের মধ্যে অনেককে কখনোই সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, আবার কেউ কেউ স্বাধীনভাবে কাজ করা শুরু করেছিল। ১৬ ডিসেম্বরের পর যেহেতু আন্তর্জাতিক সংবাদকর্মীদের দেশে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছিল, তাই অভিযুক্ত পাকিস্তানি দালালদের প্রকাশ্যে হত্যা করার ঘটনাটি ছিল ১৯৭১-এর সবচেয়ে বেশি স্থিরচিত্র ধারণ করা মুহূর্ত।৮৫ পরিহাসের বিষয়, এই ছবির ওপর ভিত্তি করেই বসু বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনে।
যেসব অফিসার একসময় শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু ডাকত, তাদের মধ্যেও অসন্তোষ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যে মেজর জিয়া চট্টগ্রাম বেতার দখল করে ‘মহান জাতীয় নেতা’ শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালের বিরোধপূর্ণ অভ্যুত্থান এবং পাল্টা-অভ্যুত্থান শেষে তিনিই একপর্যায়ে ক্ষমতায় চলে আসেন। শেখ মুজিব নিজের আধা সামরিক বাহিনী—রক্ষীবাহিনী ও লালবাহিনী—গঠন করার ফলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব আরও ঘনীভূত হয়। চূড়ান্তভাবে সেনাবাহিনী নিজের খুনে-যুক্তি অনুসারে প্রত্যুত্তর দিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেভাবে গণতন্ত্রকে ব্যাহত করেছিল, স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একই পথে হাঁটল। ১৯৭১ সালে সামরিক আদেশের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে বিদ্রোহ করার ফলে বাঙালি অফিসাররা ইতিমধ্যে একটি মানসিক সীমা অতিক্রম করেছিল—হুকুম অমান্য করার রেওয়াজ এখান থেকেই শুরু। শেক্সপিয়রীয় ট্র্যাজেডি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যখন, ১৫ আগস্টের সকালে, শেখ মুজিব তাঁকে আক্রমণ করতে আসা সৈনিকদের সঙ্গে দেখা করতে স্বেচ্ছায় সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছিলেন। তিনি হয়তো ভাবছিলেন, ১৯৭১ সালে তিনি এর চেয়েও ভয়ংকর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন এবং নতুন জাতির নেতা হিসেবে কারাগার থেকে ফিরে এসেছিলেন। এরা তো তাঁর নিজের সন্তান, এরা তাঁর ক্ষতি করতে পারে না।
গডোর অপেক্ষায়
ষাটের দশকে আমার বাবা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেডিকেল সার্জন ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে সেনা সদর দপ্তরে কর্মরত ছিলেন। তিনি নির্বাচনে লীগকে নির্ভয়ে ভোট দিয়েছিলেন এবং কাঙ্ক্ষিত ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য রেডিওর পাশে অপেক্ষা করছিলেন। অপ্রত্যাশিত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালি সেনা অফিসারদের পৃথক করে ফেলা হয় এবং সংবেদনশীল দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয়। একপর্যায়ে তাঁদের জিজ্ঞেস করা হয় তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে যেতে চান কি না। যাঁরা হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিয়েছিলেন, তাঁদের প্রিজন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এইভাবে আমি (তিন বছর বয়সে) এবং আমার মা-বাবা বান্নু প্রিজন ক্যাম্পে পৌঁছাই। এরপর আমাদের মন্ডি বাহাউদ্দিন এবং সবশেষে গুজরানওয়ালে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের নিকটবর্তী ক্যাম্পে আমার এক চাচা ও এক ফুফা ছিলেন, তাঁরা সেনাবাহিনীর প্রকৌশল শাখায় কাজ করতেন। আমি আমার মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এটা ভয়ংকর সময় ছিল কি না। তিনি উত্তর দিয়েছেন, ‘আমরা প্রতিটি দিন ভয়ে ছিলাম যে, তারা আমাদের মেরে ফেলতে পারে। ভবিষ্যতে কী হবে, এটা কেউ জানত না।’৮৬
১৯৭৩ সালে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের বিনিময়ে পাকিস্তান সরকার আমাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। রেডক্রসের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে ফোক্কার ফ্রেন্ডশিপ বিমান লাহোর বিমানবন্দরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। যখন আমরা বিমানে উঠছিলাম, আমার বাবা আমাদের বিছানাপত্র অন্য একটি বাঙালি পরিবারকে দিয়ে দিয়েছিলেন, যারা তখনো আটকে ছিল। সেই গ্রহীতা ছিলেন এ জি মাহমুদ। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান হয়েছিলেন। চার বছর বয়সে বেশি কিছু মনে থাকার কথা নয়। তবে আমার স্পষ্ট মনে আছে যে, আমার বাবা তাঁর সাদা ভক্সওয়াগনটি বিপজ্জনক গতিতে বিমানবন্দরের দিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার মায়ের বমি পাচ্ছিল, তবে বাবা গাড়ি থামানোর সাহস পাচ্ছিলেন না। ফলে আমার মা ক্রমাগত গাড়ির জানালা দিয়ে বমি করছিলেন। এভাবেই পাকিস্তানকে শরীর থেকে নির্গত করতে করতে আমরা ঘরে ফিরি।
বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে তখন ইতিমধ্যে সবাইকেই বিভিন্ন পদে পদায়ন করা হয়ে গেছে। তারা আসলে পাকিস্তান থেকে আমাদের ফেরার জন্য অপেক্ষা করেনি। হঠাত্ করেই অনেক বেশি লেফটেন্যান্ট, ক্যাপ্টেন ও মেজর তৈরি হয়ে গেল। পাকিস্তানে আটকে পড়ার কারণে সিনিয়ররা পিছিয়ে গেল, জুনিয়রদের স্যালুট দেওয়ার অপমান হজম করতে হলো। ১৯৭৪ সালের মধ্যে অফিসারদের ভেতরে যখন এই টেনশনগুলো ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তখন অনেক সেনা কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শেখ মুজিবকে হত্যার ছয় মাস আগে আরও অনেকের মতো আমার বাবাকে ডাক্তার হিসেবে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। সেখানে আমরা প্রথমে বঙ্গবন্ধু খুনের খবর পাই এবং পরবর্তী সময়ে আমার দাদার স্বাভাবিক মৃত্যুর খবরও পাই। মরুভূমিতে সেই নির্বাসনে একটি ছোট মিলাদের আয়োজন করা হয়েছিল। এই মিলাদ আমার দাদা, নাকি শেখ মুজিবের উদ্দেশে আয়োজন করা হয়েছিল, তা আমার মনে নেই। তবে মিলাদটি দুজনের জন্যই আয়োজন করা হয়েছিল ভাবতে আমি পছন্দ করি।
পরবর্তী সময়ে পাল্টা অভ্যুত্থানের ফলে শেখ মুজিবের কিছু হত্যাকারী পালিয়ে লিবিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। এতে বাঙালি কমিউনিটি বিরক্ত হয়েছিল (আন্তর্জাতিক অপরাধীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে ত্রিপলি সরকারের তখনই পরিচিতি ছিল)। শেষতক আমরা বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলাম এবং তখন একজন সামরিক কর্মকর্তা রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি গাঢ় সানগ্লাস পরতেন, নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছাড়ার কথা বলেছিলেন এবং জাতিকে খাল খনন করতে উত্সাহিত করার জন্য সাদা শার্ট পরে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি ভারতের সঙ্গে সামরিক বিবাদের পথ বেছে নেন। ১৯৭১ সালের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ খুব দ্রুত উবে যায়।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রক্তাক্ত সিপাহি বিদ্রোহের সময় আমার এক ফুফা বিদ্রোহীদের থেকে পালাতে সক্ষ